রবিবার, ১৫ সেপ্টেম্বর, ২০২৪

গল্প * যুগল কিশোর দাস অধিকারী





উত্তোরণ 

যুগল কিশোর দাস অধিকারী 


বিশু যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ক্যানিং লোকাল ধরে বাড়ী ফিরছিল। বাংলায় মাষ্টার ডিগ্রীর দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র। সোনারপুর স্টেশনে ট্রেন থামতে বন্ধুদের সাথে ট্রেন থেকে নেমে সিগারেটের কাউন্টারে সুখটান মারছিল। তখন স্টেশনে সিগারেট খাওয়া যেত। হটাৎ নজরে আসল দু একটা কম্পার্টমেন্ট পরে কিছু লোকের জটলা। হবে হয়তো কোন পকেটমার ধরা পড়েছে।ওদিকে তেমন ভ্রুক্ষেপ নেই, কে উটকো ঝামেলায় জড়াবে?

ট্রেন ছাড়তেই চার নাম্বার প্লাটফরমে দৌড়ে দরজায় ঝুলে পড়ল। এ অভ্যাস নিত্য নৈমিত্তিক। যা ভিড় ভিতরে যাওয়ার থেকে দরজায় ঝুললে হওয়া বাতাস গায়ে লাগে। সাড়ে পাঁচটার ট্রেনটায় কাজের মাসি, কাজ করা লোকই বেশি ফেরে। কেউ কেউ ঝি- এদের ট্রেন ও বলে। ইউনিভার্সিটিতে পড়ি বুক ফুলিয়ে বিনি পয়সায় যাই। বেশি সুবিধা আর কি চাই?

 হটাৎ চলন্ত ট্রেন থেকে বিশু দেখল কোন একজন লোককে সবাই ধরাধরি করে চোখে মুখে জল ছেটাচ্ছে। কেউ বলছে হারুদা কিচ্ছু হবে না, শ্বাস নাও জল খাও। বিশু স্পষ্ট দেখতে পেল তার বাবাই বোধ হয় অসুস্থ হয়ে পড়েছে। 

     জুনমাসের যা গরম তাতে এই ট্রেন হকারি করতে হলে বড় মাপের lic করে রাখা দরকার। মাথাটা ঘুরে গেল  মনে হয় চলন্ত ট্রেন থেকে ঝাঁপ দিই।

 হারাধন মণ্ডলকে সবাই হারুদা বলেই ডাকে। এই লাইনে প্রায় পঁচিশ বছর হকারি করছে। অনেকেই চেনে। কি করি না করি ভাবতে ভাবতে ট্রেন বিদ্যাধরপুর এসে গেল। নেমেই দৌড় অন্য প্লাটফর্মে। শিয়ালদা যাওয়ার ট্রেন আসতে আরো ১৫/২০ মিনিট বাকি। কি করবো। লাইন ধরে সোজা সোনারপুর দৌড়াব? যদি তাড়াতাড়ি পৌঁছে যাই? মনে হচ্ছে ওটা আমার বাবা ই। ওর নিজের সেলফোন নেই

 আর যখনকার কথা তখন সেলফোন বড় চাকুরীজীবী বা ব্যবসায়ী ছাড়া কারু হাতে দেখাই যেত না। ইনকামিং আউটগোয়িংকলও দুটোতেই পয়সা কাটত। এখন যেমন বাড়িতে লোকসংখ্যার থেকে ফোনের সংখ্যা ই বেশি । তখন তেমন ছিল না।

        যা হোক ইতস্তত বিভ্রান্ত বিশুকে দেখে প্ল্যাটফর্মের লোকেরা বললো এত ঝুঁকি নিয়ে লাইন দিয়ে দৌড়াবে না। কেননা এখন তুমি অন্যমনস্ক। যে কোন সময় লাইনে ট্রেন এসে গেলে বড় বিপদ হতে পারে। তার চে মিনিট পনেরো অপেক্ষা করে ট্রেনেই সোনারপুর যেও।

তাই হল। ফিরতি ট্রেনে সোনারপুরে নেমে চার নম্বর প্লাটফর্মে ছুটলাম। কিন্তু কেউ নেই। দু একজন হকারকে জিজ্ঞেস করলাম । কিছুক্ষন আগে ক্যানিং লোকালে যে হকার টি অসুস্থ হয়েছিল তার নাম কি? তিনি কোথায়?

কিছু কি বলতে পারবেন? দু জন কিছুই বলতে পারল না। শেষে স্টেশনের ঘুগনি মুড়ি বিক্রেতাকে ধরল। দাদা এর আগের ক্যানিং লোকালে একজন হকার অসুস্থ হয়েছিল তাকে কি দেখেছেন? কোথায় নিয়ে গেল কিছু কি বলতে পারবেন? লোকটি বলল হ্যাঁ উনি মসলামুড়ি বিক্রি করেন। ট্রেনেই অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিলেন। কিছুলোক ও একজন হ্কার মিলে ধরাধরি করে অবাক জলপান মিষ্টির দোকানের দিকে নিয়ে গেছে।কেউ যেন বলছিল হরসিত ডাক্তারের কাছে নিয়ে চল। এর পর কি হল তা বলতে পারব না। ধন্যবাদ দাদা।

    বিশু তাড়াতাড়ি রিক্স স্ট্যান্ডে এসে রিকশাওয়ালাকে জিজ্ঞেস করল হরষিত ডক্টরএর চেম্বার কোথায় আমাকে ওখানে নিয়ে চলুন খুব আর্জেন্ট। রিক্সাওয়ালা সব শুনে ওকে বললো হ্যাঁ জানি তুমি ওঠ। সোনারপুর বাজার থেকে ডাক্তারের চেম্বার কাছেই ছিল। ওখানে নেমে ছুট্টে ডাক্তারের চেম্বারে গিয়ে দেখল কিছু লোক বাইরে হাত চাপড়াচ্ছে। বিশু তাদের একজনকে জিজ্ঞেস করল দাদা কি হয়েছে? এখুনি কি কোন ইমার্জেন্সী পেশেন্ট এখানে এসেছে? লোকটি জিজ্ঞেস করলো তুমি কে? কার খোঁজ নিতে এসেছ?

     বিশু সংক্ষেপে সব খুলে বললো।

তখন লোকটি বলল এক্ষুনি ডক্টরের চেম্বারে একজন অসুস্থ লোককে নিয়ে এসেছিল । নাম হারাধন মণ্ডল। ট্রেনেই ম্যাসিভ হার্ট অ্যাটাক হয়েছে। ডাক্তারবাবু দেখেই ইঞ্জেকশন দিয়ে হসপিটালে নিয়ে যেতে বলেছিলেন ।  শুনলাম ওনাকে নিয়ে যেতে যেতেই রাস্তায় ওনি মারা গেছেন। ওরা এইমাত্র বডি নিয়ে স্টেশনের দিকে গেছে।

    খবরটা শোনামাত্র বিশুর মাথায় বাজ ভেঙ্গে পড়ল। পায়ের তলায় মাটি সরে যাচ্ছে। দাঁড়াতে দাঁড়াতে প্রায় পড়ে যাচ্ছিল  পাশের ক' জন ধরে ফেলল। একটা বেঞ্চে শুইয়ে দিয়ে চোখে মুখে জল দিল। সুস্থ হতেই ওরা জিজ্ঞেস করল তুমি কে?

        ঝাপসা চোখে জল উপচে আসছে। ভরা বালের মেঘের মতো অজান্তে ঝরে পড়ছে ফোঁটা।বুকের পাশে দলা পাকানো যন্ত্রনায় গলা দিয়ে স্বর বেরুচ্ছে না। মুহূর্তের মধ্যে পৃথিবীর সব আলো নিভে গেছে, অকাল তমিশ্রায় ডুবে গেছে। কথা বলার ভাষা ফুরিয়ে গেছে । জীবনের এক অদ্ভুত মোড়ে পৌঁছে গিয়ে সব পথ হারিয়ে গেছে।

     বুক চাপড়ে মাথায় হাত দিয়ে বললো আমি সেই অসহায় পিতার হতভাগ্য পুত্র। কাছের লোকেরা সান্তনা দিয়ে তাকে শক্ত হতে বললো।

কেউ একজন মোটরসাইকেলে তুলে দ্রুত স্টেশনের দিকে পৌঁছে দিল।

     সেখানে কয়েকজন মিলে ছোট টেম্পো ঠিক করে বডি গাড়িতে তোলার ব্যবস্থা করছিল।

বিশু পৌঁছেই সবাইকে আড় করে ভিড়ের মধ্যে উদভ্রান্তের মতো ঢুকে পড়ল। মনে মনে ভগবানকে বলছিল যদি ভুল হয়, তাহলেই ভালো। যদি ঐ নামে অন্য কোন লোক হয়? হলে ও তো হতে পারে!

       কিন্তু না ভিড় ঠেলে শায়িত শব যে তার বাবার তা বুঝতে বাকি রইলো না। মুহুর্তের মধ্যে কাটা কলাগাছের মত বুকের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। হাহাকার করে উচ্চস্বরে কাঁদতে কাঁদতে বললো বাবা আমি যে ভেসে গেলাম । আর আমি কাকে বাবা বলে ডাকবো? কে আমাদের বকবে  কে আদর করবে? আমি কি করব? কোথায় যাব?

     উপস্থিত সবাই অনুমান করতে পেরেছে যে এই হারাধন মণ্ডলের বড় ছেলে বিশ্বনাথ মণ্ডল। ওকে নিয়ে তার বাবা হকারদের সামনে খুব গর্ব করত। আমার ছেলে ইউনিভার্সিটিতে পড়ে, ওর খুব মাথা, পাস করে বেরুলেই দু এক বছরের মধ্যে চাকরি করবে। তখন আমার পায়ের ওপর পা। আমাকে আর কষ্ট করতে হবে না। একটা ঘর করবো, মেয়ের বিয়ে দেব। ছোট্ট ছেলেটার পাড়ায় তেমন মাথা নেই , ওটা হায়ার সেকেন্ডারি দেবার পর    বড় বাজারে কাপড়ের দোকানে মাস চারেক আগে ঢুকিয়ে দিয়েছি।

        কাছের সবাই বিশুকে ধরাধরি করে তুলে, সান্তনা দিল। কেউ বললো তুমি কি বিশু? সে ঘাড় নেড়ে সম্মতি জানাল। তুমি বাবার বড় ছেলে, তোমাকে ধৈর্য্য ধরতে হবে। ভেঙে পড়লে মা, বোন, ভাইকে কে দেখবে?

        হায় ভগবান এক মুহূর্তের মধ্যে ছাত্র থেকে দায়িত্ববান, দাদা, অভিভাবক! কিন্তু কিভাবে কি করব ভেবেই কূল কিনারা পাচ্ছি না। যা হোক বাবার বডি যখন বাড়ি এল মা, বোন, ভাই পুরো পাড়া কান্নায় ভেঙে পড়ল। ভাইটা একবার বাবা একবার মাকে জড়িয়ে শিশুর মত কাঁদতে লাগলো। সবার সহযোগিতায় শবদাহের কাজ শেষ হল।

         পর দিন সাদা ধুতি পরে দু'ভাই বসে আছে। মা কখন অজান্তে এসে দুজনের কাঁধে হাত রেখে বললো এবার তাদেরকেই সব দায়িত্ব সামলাতে হবে।কিন্তু তোর বাবা কি রেখে গেছে ত ও জানি না । লোকটা গাধার মত সারাটা জীবন খেটেই গেল, বিশ্রামের সুযোগ টুকুই পেল না । কয়েকদিন যেন হাঁসফাঁস করত, জিজ্ঞেস করলে বলতো গরম পড়েছে তাই ই।

   আমাদের আর কি হবে? মরে গেল একদিনের জন্য চিকিৎসা ও নিল না। বিশু দেখতো ভাঙ্গা ট্রাঙ্ক এ একটা ফাইল ছিল, যদি কোন কাগজপত্র পাওয়া যায়।

দু ভাই তাড়াতাড়ি ফাইল খুলে দেখল বোনের নামে একটা LIC আছে, ম্যাচিওর হতে ছ মাস বাকি। ম্যাচুরিটি ভ্যালু তিরিশ হাজার। SBI পাসবুকে ২৭৫০টাকা জমা আছে, ক্যাশ ১৫০০ টাকা - এই পুঁজি।

    মা বললো কি আর রাখবে চার চারটে পেট, তিন জনের পড়ার খরচ, বাজার হাট, জমা কাপড় , ওষুধ কত খরচ। কত বা আয় কি আর জমা করবে? যা হোক ছোট খাটোর মধ্যে শ্রাদ্ধর আয়োজন কর।

      নমো নমো করে শ্রাদ্ধশান্তি করে উঠতে তা ও প্রায় পনের বিশ হাজার খরচ হয়ে গেল। বাবার বন্ধুরা কিছু সাহায্য করেছিল। তবুও পাঁচ/ছ হাজার টাকা ধার হয়ে গেল। সে যা হোক এবার সংসার খরচ তারপর পড়াশুনার খরচ চলবে কি করে সেই চিন্তা।

       বিশু বললো মা বোন HS পর্যন্ত পড়ুক আমি আর ইউনিভার্সিটি যাব না তাতে তো কিছুটা খরচ বাঁচবে।

মা বললো তোর বাবার স্বপ্ন তোকে নিয়ে ছিল, তুই মাস্টার্স কমপ্লিট করবি। না হলে ওনার আত্মা মরে ও শান্তি পাবে না।

    বাবার এক পরিচিত গড়িয়াতে ছিল। বাবার বন্ধু শান্তি কাকু বললো তুই গড়িয়াতে ব্রজেন বসাকের কাছে যা। ওর অনেক রকমের ব্যবসা আছে  সে কোন বুদ্ধি দিতে পারবে। শুনেছি তোর বাবা কোন সময় ওর উপকার করেছিল। সে জন্য তোর বাবাকে সে ভীষণ বিশ্বাস করতো, ভালো ও বাসতো।

       পরদিন ইউনিভার্সিটি যেতে বন্ধুরা খুব সহানুভূতি দেখাল। আমরা তোর পড়ার জন্য যা খরচ সব বহন করবো, তোর যা রেজাল্ট তুই নিশ্চই মাস্টার্সর পর একটা চাকরি পাবিই।

      যা হোক ইউনিভার্সিটি ফেরত ব্রজেন কাকুর কাছে গড়িয়া পৌঁছালাম। বড় ভূসিমাল দোকান। আরো দুটো দোকান  হার্ডয়ার্স ও টাইলসের জন্য ভাড়া দেওয়া আছে। নিউগড়িয়াতে ফার্স্ট ফুডের দোকান নতুন খুলেছে। বিশু নিজের কথা সব খুলে বললো।

       মুন্ডিত মস্তিষ্ক বিশুকে দেখে ব্রজেনবাবু আন্দাজ করে ছিলেন এ হারাধনের ছেলেই হবে। তবু বললেন তুমি কি হারাধনের ছেলে? হ্যাঁ। তোমাদের খবর অনেক দেরিতে পেয়েছি। তুমি তো অনেক পড়াশুনো করেছ, তোমাকে আমি কি কাজ দেব ভেবে পাচ্ছিনা। তবে

পেট বাঁচাতে হলে মানসম্মানকে পুঁটলি বেঁধে তুলে রাখতে হবে। না হলে এ সময় বাঁচা যাবে না। তুমি বলো তুমি কি কাজ করতে চাও?

       আমার মাথায় এখন কোন বুদ্ধি কাজ করছে না। আপনি আমাকে পরামর্শ দিন।

      কিন্তু আমার পরামর্শ মতো কি কাজ করতে পারবে? আমার ফার্স্ট ফুডের দোকান আছে, সেটা দেখাশোনার কাজ দিতে পারি। তোমার বাবাকে আমি খুব বিশ্বাস করতাম তাই তোমাকে ও ঐ দায়িত্ব দিতে পারি। কিন্তু তাতে তোমার পড়াশুনার ব্যাঘাত ঘটবে। তোমাকে এমন কাজ করতে হবে যাতে তোমার পড়াশুনা ও চলবে এদিকে কিছু রোজগার ও হবে।

    সারাদিনে দু ' তিন ঘন্টা সময় দিতে পারবে?

পারবো। কিন্তু কাজটা কি?

  এই ধরো পাইকারী বাজারে মাছ তুলে বাঘাযতীন নিউগড়িয়ার যে সব নতুন অবসান হয়েছে ও গুলোতে সকাল সাতটা থেকে দশটা পর্যন্ত ঘুরলেই তোমার মোটামুটি একটা টাকা হাতে আসবে। যা দিয়ে তোমাদের সংসার চলে যাবে।

   তা বলে মাছ বেচা? তারপর ইউনিভার্সিটি যাব কি করে?

  তোমার এই মুহূর্তে অন্য কিছু জানা নেই তাই  তোমাকে বলছি। যদি রাজি থাক আড়তদারের সাথে পরিচয় করিয়ে দেব। সরঞ্জাম ও প্রথম কিস্তির টাকা যা লাগে আমি দেব। সে নিয়ে তোমায় ভাবতে হবে না।

তুমি মাছ বিক্রি করে জিনিসপত্র আমার কাছে রেখে ফ্রেশ হয়ে এখন থেকেই ইউনিভার্সিটি যাবে। এক সেট এক্সট্রা জামাকাপড় এখানে রেখে দিও।

    টাকা শুধতে হবে কবে?

সে নিয়ে তোমায় ভাবতে হবে না। যখন তুমি পারবে, হতে পুঁজি হবে তখন শোধ দিও।

   পরদিন থেকেই বিশু কাজে লেগে পড়ল। প্রথম দিন প্রায় তিন শ টাকা আয় হল। ভীষণ আনন্দ হচ্ছিল। নিজের জীবনের প্রথম উপার্জন কাকুর কাছে আসল টাকা জমা রেখে তিন শ টাকা নিয়ে ফ্রেশ হয়ে ইউনিভার্সিটি গেল।

    ক্লাসে গিয়ে সমস্যা হলো গা থেকে আঁশটে গন্ধ ছাড়ছে। অনেকে ওর কাছে বসতে চাইছে না । কেউ কেউ নাকে চাপা দিচ্ছে। তবে তিন চারজন ক্লোজ বন্ধু ছিল তারা সব শুনে বাহবাই দিল ।

 এভাবে চলছিল বছর খানেক। পয়সা এলে ও নিজের মন থেকে সায় পাচ্ছিল না। 

    একদিন স্নান সেরে বেরনোর সময় ব্রজেন কাকুর মেয়ের মুখোমুখি হল। ওকে খালি গায়ে দেখে মেয়েটি হতচকিত ও কিছুটা মুগ্ধতার চোখে ও দেখল। বিশুই কেমন যেন অপ্রস্তুত অবস্থায় পড়ে গেল।

কাকুর দোকানের উপরেই ওদের দোতলা থাকার বাড়ী। একদিন জোর করে উপরে নিয়ে গিয়েছিল। পেটভরে লুচি আলুরদম, ও মিষ্টি খাইয়ে ছেড়েছিল।

 মেয়েটি সেদিনই বিশুকে আড়াল থেকে দেখেছে। বাবার এই বহিরাগতের প্রতি প্রগাঢ় অপত্য স্নেহ, তার মনে প্রশ্ন জাগিয়েছিল। পরে ছেলেটির সমন্ধে তানিয়া সব জেনেছিল। তবে সো কলড ছেলেদের মতো লালিত্য ছিল না। তবে তার প্রতিটি অস্থিমজ্জায় হার না মানা সংগ্রামী লড়াকু মনোভাবের ছাপ ছিল। এবং তার তীব্র আত্মসম্মানবোধ তানিয়াকে  আকর্ষণ করত। কিন্তু কোন সময় কলে ভদ্রে দেখা হলেও অতলান্তিক গভীর চাউনি ছাড়া কিছুই বলতো না।

           তবে তানিয়া তার বাবার কাছে শুনেছে তার মা একবার খুবই অসুস্থ হয়ে পড়েছিল

 সে সময় বিশুর বাবা তার কাজের ফাঁকে বাবার সাথে সারা রাত হসপিটালে থেকেছে , তার চে আরো বড় কথা হসপিটালে এক ছিনতাইবাজ বাবার টাকার ব্যাগ নিয়ে পালাচ্ছিল। হারাধন কাকু জীবনের ঝুঁকি নিয়ে তার পিছু ধাওয়া করে সেই ব্যাগ উদ্ধার করেছিল। যাতে প্রায় ৭৫হাজার টাকা ছিল। এবং চিন্টাইবাজের ছুরির আঘাতে কাকু বেশ আহত হয়েছিল। সেই রক্তাক্ত অবস্থাতে টাকার ব্যাগ এনে বাবার হাতে দিয়েছিল। সে উপকারের কথা বাবা আজও ভোলেনি। তা যে শোধ করা যায় না তাও তিনি বলেন। সেই ঘটনা শুনে তানিয়ার বিশুর প্রতি আরো মমত্ব বেড়ে গিয়েছিল।

     তানিয়া ইংলিশ অনার্স দ্বতীয় বর্ষের পরীক্ষা চলছে। বাবা মা কেউ না কেউ সাথে যায়। কিন্তু সেদিন ব্রজেন বাবুর দু দুটো বিয়ে বাড়ীর ফর্দ পড়েছে। তিনি সময় করে উঠতে পারছেন না। মায়ের কয়েক দিন ধুম জ্বর। অনোন্যউপায় হয়ে ব্রজেন বাবু বিশুকে  বললো তার কি সময় হবে যদি আমার মেয়েকে কলেজে পৌঁছে দিতে পারে? বিকেলে আমি গিয়ে নিয়ে আসবো।

    অনিচ্ছা সত্ত্বেও বিশু না করতে পারলো না।

  সামনেই তার বোনের বিয়ে, সে ব্যাপারে ব্রজেন কাকুর পরামর্শ ও সাহায্য কিছুটা চাই, কিন্তু মুখ ফুটে বলতে পারেনি।

 বিশু ফ্রেশ হয়ে ব্রজেন বাবুর মোটর সাইকেল নিয়ে নীচে অপেক্ষা করছে। তানিয়া নেমে এসে পিছনে সামান্য দূরত্ব রেখে বসল। বিশু মোটরসাইকেল স্টার্ট দিয়ে বললো সাবধানে বসো - অসুবিধা হলে বলো।

  তানিয়া ভাবছে এই প্রথম কথা বললো। কি বলি কি বলি ভাবছে।

বললো না না ঠিক আছে দেখে চালান। একটা কথা কি বলবো? বিশু ভাবছে কি বলবে রে বাবা! হুম বলুন। বিকেলে কি সময় হবে? বিশু চিন্তায় পড়ল। আবার  না হ্যাঁ কি বলবে বুঝতে পারছে না।

   তানিয়া বললো অসুবিধে থাকলে আসতে হবে না। বিশু -না তা নয় কিছু কাজ ছিল। তা হোক আমি আসবো l

একটা কথা জিজ্ঞেস করবো ।

হ্যাঁ বলো

না থাক বিকেলেই বলবো।

বিশুর মনে খটকা লাগলো। ওর চোখের ভাষা কিছুটা আন্দাজ করতে পারলেও নিজে থেকে সাহস করে কিছু বলতে চায়নি। ও যা ভাবছে তা ভুল ও হতে পারে। পাছে ব্রাজেনকাকুর স্নেহ থেকে বঞ্চিত হয়। তাছাড়া ওদের সাথে বিশুদের কোনদিক থেকেই মানায় না। বিশুর মতো ছেলের সাথে এমন বিলাস বহুল জীবন যাপনে অভ্যস্ত মেয়ের চাহিদা মেটানো কোন দিন সম্ভব নয়।

     বিকেলে পরীক্ষা শেষ হলে বিশু মোটর সাইকেল নিয়ে দূরে দাঁড়িয়ে ছিল। মনের মধ্যে উদ্বেগ। কয়েকজন মেয়ের সাথে গল্প করতে করতে ও যেন আঙ্গুল দিয়ে এক বন্ধুকে ইঙ্গিত করে কি বললো। ওরা ও বেশ উৎসুক চোখে কাছে এসে হেসে টা টা করে যাবার সময় গুডলাক বলে চলে গেল।

  কি বলি না বলি ভেবে বিশু ক্যাজুয়ালি বললো পরীক্ষা কেমন হলো।

ভালো। তবে যতটা ভালো হবে ভেবেছিলাম ততটা ভালো হয়নি।

- হল না কেন?

- জানিনা মনটা কেমন উড়ু উড়ু করছিল।

- সে কি কোন সমস্যা?

- হুমম কিন্তু বললে সমাধান হবে না বাড়বে, তাই বলতে সাহস পাচ্ছি না।

বিশু ইঙ্গিত বুঝে ও বললো বলে দেখতে পারো। আমার সাধ্যের মধ্যে হলে নিশ্চই চেষ্টা করবো।

চলুন ওই সানের রেস্টুরেন্ট এ গিয়ে কিছু পেটে দিই, তারপর না হয়

চলো।

তানিয়া দুটো মার্টান বিরিয়ানির সাথে চিকেন ভর্তা অর্ডার করলো।

বিশু খেতে খেতে বললো সমস্যাটা কি বললে না তো?

- মনের।

- বুঝলাম না।

- বোঝার চেষ্টা করুন হয়তো বুঝতে পারবেন।

বিশু কিছুক্ষন চুপ করে খাবার টা নাড়াচাড়া করছিল। গলা দিয়ে খাবার নামছিল না। তবুও বললো বলো দেখি কি করতে পারি?

 আজকের শার্ট প্যান্ট টা কেমন লেগেছে?

বিশুর এক সেট জামাকাপড় থাকে। আজকের টা নতুন। মাসিমা বললেন তোমার পুরনো শার্ট প্যান্ট টা কেচে দিয়েছি। তুমি এটা পর।

এখন বুঝলাম। হুম ভালো হয়েছে।

- আমি পছন্দ করে কিনেছি।

- এত দামী সেট কি দরকার ছিল?

- ভালোলাগার জনকে ভালো জিনিসটাই দিতে ইচ্ছে করে।

বিশু নর্বাক হয়ে বসেছিল। যেন কানের কাছে খুবজোরে আতশবাজি ফাটালে যেমন কানে তালা ধরে যায় ঠিক তেমনি।

বিশু তানিয়া আমি যে তোমার চোখের ভাষা বুঝিনি তা নয়। তবে আমার সাথে তোমার স্ট্যান্ডার্ড এ মানায় না। তাছাড়া তোমার বাবা জানলে আমার শেষ ভালোবাসার আশ্রয় থেকে বঞ্চিত হব। তুমি অনেক ভালো স্বচ্ছল পরিবার পাবে।

তা হয়তো হবে তবে এত নির্লোভ ভালো মানুষ পাব না। জীবন সুধুটাকা পয়সাতেই সুখী হয় না। আর বাবা মার ব্যাপারটা আমার উপর ছেড়ে দাও। মাকে আমি কিছুটা ইঙ্গিত দিয়েছি। তাতে তিনি বাধা দেননি। তবে তোমার মত না পেলে বাবাকে জানাবো না। বাবা আমার ইচ্ছাতে কোনদিন বাধা দেয়নি। আমার এক দাদা ছিল তোমার বয়সি হবে। মোটরবাইক এক্সিডেন্টএ মারা যায়। সেই থেকে মা অসুস্থ। বাবার কাছে আমিই তার পৃথিবী।

বি কিন্তু আমার অবস্থা, দায়িত্ব সবই জানো ।

মা ভাইবোন ওদেরকে ছেড়ে আমি স্বার্থপরের বেরিয়ে আসতে পারবো না। আমি নিজের পায়ে দাঁড়াতে চাই।

তা  আমি তত দিন অপেক্ষা করব। তোমাকে দাযিত্বপালনে ও বাধা দেব না। শুধু তুমি বলো তুমি কি....?

বি - তোমাকে প্রথম দেখাতেই আমি তোমার চোখের চাউনিতে হারিয়ে ফেলেছিলাম। তবে এত বড় আশা আমি করিনি। তাই সাহস করে বলতে পারিনি। তাছাড়া আমার ব্যাক্তিগত অনেক সমস্যা আছে তার সাথে তোমাকে জড়াতে চাই নি।

তা - আজ থেকে তোমার সব সমস্যার ভাগীদার আমাকে কর। সব সময় তোমার পাশে থাকতে চাই, সেই সুযোগটুকু আমাকে দাও।

 কথা না বাড়িয়ে তানিয়াকে বাড়ী পৌছে দিয়ে, কাকু কাকিমার থেকে বিদায় নিয়ে বাড়ি ফিরল।

  বোনের জন্য হাওড়ায় বাবার এক বন্ধুর ছেলেকে দেখেছি। ছোট ব্যাবসায়ী। নিজেদের বাড়ীঘর আছে। বাবা মা ও ছেলে। ছোট পরিবার। মেয়েকে দেখে ওদের পছন্দ হয়েছে। দাবীদাওয়া কিছু নেই।

তা বলে খালি হাতে মেয়েকে পাঠানো যায় না।

মায়ের দুটো গয়না ছিল। তাই  । আর অল্পস্বল্প আসবাবপত্র , লোকজন খাওয়ানো সব মিলিয়ে প্রায় লাখ খানিকের ধাক্কা। এদিক ওদিক করে সাট সত্তর জোগাড় করলেও বাকিটা হচ্ছে না।

  ব্রজেন কাকুর বাড়িতে নিমন্ত্রণ করতে যেতে ওরা নিজেরাই খুঁচিয়ে সব জিজ্ঞেস করলো। বাকি টাকার কি হবে?

 বি  বাবা দু ডেসিমাল জায়গা কিনে রেখে গেছেন ভাবছি ওটাই বিক্রি করলে বাকি টাকাটা হয়ে কিছু বাঁচবে, তা দিয়ে বাড়িটা রিপেয়ার করে নেব।

   কিন্তু ও জায়গা কি আর কিনতে পারবে? এক কাজ কর। আমি বাকি টাকাটা দিচ্ছি তুমি তোমার সময় মতো শোধ দিও।

বি  কিন্ত কি করে শোধ করবো? তাছাড়া বন্ধক দেব এমন কোন কিছুও আমার কাছে নেই। আপনার অনেক সাহায্য নিয়েছি আমাকে আর ঋণী করবেন না।

  তানিয়া আড়াল থেকে সব শুনছিল। 

বিশু মাকে ডেকে বললো আপনাদের সবাইকে আমার বোনের বিয়েতে আসতে হবে। আপনাদের আশীর্বাদ না পেলে আমার বোন সুখী হবে না। 

ব্রজেন বাবু শেষে বললেন আমি ছেলে ও মেয়ের আশীর্বাদের আংটি দুটো দেব তুমি কিনবে না। তা না হলে আমি ভাববো তুমি আমাদের আপনিই মনে কর না।

অগত্যা বিশু রাজি হল।

সবাই চলে যেতে তানিয়া বললো আমার কিছু জমানো টাকা আছে, তা কোন কাজেই লাগে না, তুমি কি নেবে?

বি না, আমাকে নিজের ভার টুকু বইবার শক্তি অর্জন করতে দাও। সময়  হলে আমি তোমার থেকে চেয়ে নেব।

 বোনের বিয়ে বাড়ীঘর রিপেয়ারের পাঠ চুকিয়ে বিশু বড় দায়িত্ব থেকে মুক্ত হল। ব্রজেন কাকু ও তার ফ্যামেলি বিশুদের ঐকান্তিক আতিথেয়তায় মুগ্ধ হল।

 ইতিমধ্যেই বিশু নতুন ব্যবসা আরম্ভ করল। এতে কি হবে জানে না। জীবনে রিস্ক নিতে হবে। এটাকেই তার ধ্যান জ্ঞান করলো। বড়বাজার থেকে পাইকারী টেডিবিয়ার ও ওই ধরনের খেলনা এনে গড়িয়া হাটের ফুটপাথে বসে বিক্রি করতে আরম্ভ করলো।

 প্রথমে বসার জায়গাই কেউ দিতে রাজি নয়। শেষে ঢাকুরিয়াতে কোন দাদা ছিল তার হাতে পায়ধরে বসার অনুমতি পেল। বড় বাজারে যা দামে কেনে এখানে তার প্রায় দ্বিগুণ দামে বিক্রি হয়।প্রফিট মার্জিন খুব ভালো। কিন্তু একটা স্টল না হলে খদ্দের তেমন পাত্তা দেয় না। তাই আবার সেই দাদার সরনাপন্ন হয়ে কাজ উদ্ধার হল। তবে দক্ষিণা আরো বেশি লাগলো।

     এবার বিশু তানিয়াকে সব খুলে বললো। প্রায় ৭০/৮০ হাজার টাকার দরকার।তবে ওটা সে ধার হিসেবেই নেবে। অনুদান না। তানিয়া শুনে খুশী হল, শুধু মায়ের অনুমতি নিয়ে পুরোটাই দিল। রসিকতা করে বললো শুধু আসল নেব না শুধটাও নেব। বিশু মৃদু হেসে বললো আচ্ছা তাই হবে।

 দেখতে দেখতে বিশুর ব্যবহার, বুদ্ধিমত্তায় বিক্রির পরিমাণ দিন দিন বেড়েই চললো। এখন একা সামাল দিতে পারে না তিন/চার জন লোক রাখল। তবে তারা সবাই হ্যান্ডকাপ। বিশুর এই মানবিকতা বোধ অনেকেই মুগ্ধ করল। বিক্রির বহর বাড়তে আরো দুটো স্টল ভাড়া নিল। ঢাকুরিয়ায় একটা গুদামঘর ও নিল।

  তানিয়া এসে নিজের চোখে বিশুর এই উত্তোরণ দেখে মুগ্ধ হয়ে গেল। তত দিনে তানিয়ার টাকা ও শোধ দিয়ে দিয়েছে। তানিয়া বললো এবার আমাকে তোমার পার্টনার করে নাও। সুদ আসল সবই তোমার কাছে জমা থাকবে। সময় মতো ফেরৎ  নেব।

 তানিয়া মা বাবাকে তার ইচ্ছের কথা জানালো। ব্রাজেনবাবুর মনে তেমন সায় ছিল না শুধু মেয়ের খুশীর কথা ভেবে  আর বিশুর মতো পরিশ্রমী ও সৎ ছেলে দেখে তিনি ও রাজী হলেন।

     এখন সোনারপুরে পেল্লায় বাড়ী, গাড়ী, আধুনিক ফার্নিচার কি নেই? দিল্লী, মুম্বাই, ব্যাঙ্গালোরে ও তার মালের প্রচুর চাহিদা। নিজে কারখানা করেছে। নিজের নামে পেটেন্ট নিয়েছে। পরিশ্রম, সততা, পরিকল্পনা তার সাথে তানিয়ার ভালোবাসা কোন বাধাই তার উত্তোরণের পথে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করতে পারেনি। আজ সে বিজনেস ম্যাগনেট। কে বলে বাঙালি পারে না?



*********************************************************************************************************************



যুগল কিশোর দাস অধিকারী

 অবসর প্রাপ্ত কর্মচারী। বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে ফাইন্যান্স অ্যান্ড অ্যাকাউন্টস ইনচার্জ ছিলেন। ২০২১ এ অবসর গ্রহণ করেছেন। শিক্ষা M  Com, B Ed, Foreign Trade Mgt  । বর্তমান লেখালেখি বাগান, ও কিছু সমাজসেবা মূলক কাজ করেন


কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন