জল্লাদ
পার্থসারথি মহাপাত্র
'কলকাতায় একটা চাকুরীর পরীক্ষা আছে' এই মিথ্যা কথা বলে কয়েক জোড়া পোশাক নিয়ে সৃজা একাই যাওয়ার জন্য প্রস্তুত। ওর মা বলেছিল দাদাকে সাথে নিয়ে যা কিন্তু সৃজা তখনও মিথ্যা বলেছে, 'না, আরো দু'জন বান্ধবী আছে, আমরা একসাথে যাচ্ছি একটা গার্লস মেসে দু'রাত থাকতে হবে'। মেয়ে বড় হয়েছে, গ্রাজুয়েট। রাস্তাঘাট চলতে শিখেছে তাই বাড়ি থেকে জোরালো আপত্তি এলো না। সৃজার দুচোখ স্বপ্নজালে আবিষ্ট। একবার মাধবী লতা গাছটার কাছে গিয়ে দু ফোঁটা চোখের জল নিবেদন করলো। চালাঘরের খড়, দরজার চৌকাঠ, খাঁচার টিয়া সবই কেমন যেন বিমর্ষ। ওরা হয়তো টের পেয়েছে। সৃজা পিঠে ব্যাগ নিয়ে নিঃশব্দে উঠোনে এসে দাঁড়ালো। বিকেলের অস্তরাগ আবহে মা ও বাবাকে প্রণাম করতে গিয়ে আবারও অশ্রু পাত। বাবা মাকে একটুও বুঝতে না দিয়ে টোটোয় বসে পড়ল।
স্টেশন পর্যন্ত না গিয়ে সৃজা টোটোওয়ালাকে বজরংবলী মন্দিরের পাশে দাঁড়াতে বলল। বিচলিত মনের উপর প্রশান্তির প্রলেপ দিতে মন্দির উপযুক্ত স্থান। ফাঁকা মন্দিরের একপাশে ব্যাগ রেখে চুপচাপ বসে পড়ল বারান্দায়। মন্দিরের পাশের বাঁশ ঝোপের ফাঁক দিয়ে আসছে সূর্যের অঙ্কুশ। ওই অঙ্কুশ যেন সৃজার পথ নির্দেশক।
তখন দশম শ্রেণী। বাংলা টিউশন পড়াতে পড়াতে অমল স্যার বলল, '..... হিন্দু-মুসলমান বলে কোন ভেদ হয় না।'
সৃজা বলল, 'না স্যার হয়। মুসলমানরা বদমাশ। বাবা বলে, 'জল্হা আর জল্লাদ এক। ওদের সাথে একদম মেলামেশা করবি না।'
তারপর অমল স্যার সৃজাকে অনেক বুঝিয়েছে। ধর্ম নিয়ে মানুষের মধ্যে কোন ভেদ নেই। তবে হ্যাঁ মুসলমানদের মধ্যে বদমাশ আছে ভালো মানুষও আছে। আবার হিন্দুদের মধ্যেও ভালো মানুষ আছে বদমাশও আছে। ভেদটা ভালো খারাপের হতে পারে কিন্তু জাতে জাতে হয় না। সৃজা সেদিন অমল স্যারের সাথে তর্কে না গেলেও অন্তর থেকে বাবার মতকেই সঠিক বলে মান্যতা দিয়েছিল। এই বয়সের মেয়েদের কাছে বাবা আদর্শ পূরুষ। কিন্তু বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে অনেক মেয়ের মধ্যে এই মোহ মিহিয়ে যায়। তারপর সৃজারও কয়েক বছর কেটে গেল। কলেজে সেমিনার, ডিবেট সহ অন্যান্য অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করতে করতে এক ক্লাস সিনিয়র দানিশের সাথে বন্ধুত্বটা একটু অন্য পর্যায়ে পৌঁছে গেল। আনমনে কখন প্রেমে পড়েছে বুঝতেই পারেনি। সৃজা খেয়ালই করেনি যে দানিশ মুসলমান ছেলে। দানিশ এর ব্যবহার ও আন্তরিকতা দেখে সৃজার এ ধরনের কোন প্রশ্নই জাগেনি।
—কিরে তুই এখানে একা?
সৃজা তাকিয়ে দেখে দাদার বন্ধু বিকাশদা।
— ভবিষ্যতে প্রতিষ্ঠিত হতে চাই। সে জন্য পরীক্ষা দিতে যাচ্ছি। যাতে এক চান্সে পাস করতে পারি তাই একটু প্রণাম করতে ঢুকেছি। সৃজা ওর দাদা ও দাদার বন্ধুদের সাথে একটু তির্যক ভাবে কথা বলতে পছন্দ করে। আসলে সৃজার দাদা ও ওর কয়েকজন বন্ধু ভবিষ্যতের কথা ভুলে শুধু রাজনৈতিক নেতাদের পিছু পিছু ঘুরে বেড়ায়। এটা সিজার পছন্দ নয়। সৃজার দাদা, বিকাশ ও অন্য বন্ধুরা হিন্দু ধর্ম কেন্দ্রিক রাজনীতিতে বিশ্বাসী। তাই বিকাশ বলল— 'বাহ্! দেব দেবতার উপরে আস্থা রাখছিস, খুব ভালো করেছিস।'
বিকাশের এই কথাগুলো সৃজা কোন ভ্রুক্ষেপ করলো না।
— তা হ্যাঁরে দানিশও যাচ্ছে না কি?
সৃজার মুখমন্ডল গিরগিটির মতো লাল হয়ে গেল। — আমি কি করে বলব? ওর কথা আমাকে জিজ্ঞেস করছো কেন?
— না, মানে তোর সাথে একটু অন্যরকম বন্ধুত্ব আছে তাই।
— দেখ বিকাশদা, তুমি দাদার বন্ধু। ওই পর্যন্তই থেকো, অভিভাবক হতে যেও না। আমি কার সাথে কি বন্ধুত্ব করছি তা তোমাকে দেখতে হবে না। আমার বাড়ির লোকেরা আছে।
— তা হ্যাঁরে তুই নাকি ওকে বিয়ে করছিস?
— দেখো বিকাশদা খুব বাড়াবাড়ি হচ্ছে। এরপর আমি চিৎকার করে লোক জড়ো করবো।
— ও কে। ঠিক আছে, আমি চলে যাচ্ছি। বিকাশ ওখান থেকে সরে গিয়ে পাশের চা দোকানে বসলো।
একটু পরেই দানিশের ফোন। রিসিভ করতেই সৃজার রক্তের উষ্ণতা নামতে নামতে শীতল হয়ে পড়ে। সৃজার দ্বন্দ্ব এখনো কাটেনি। এখনো সিদ্ধান্ত নিতে পারছে না। সে কি ঠিক পথে এগোচ্ছে? নারায়ণগঞ্জের লক্ষী রসুলপুরের সিরাজের সাথে সেই যে পালিয়ে গিয়েছে আর কোনদিন ফিরে আসেনি। লোকে বলে ওকে নাকি ইরাকে পাচার করে দিয়েছে। আবার কেউ বলে ওরা গোয়াতে সুন্দর সংসার যাপন করছে। সঠিক খবর কেউ জানে না। আলাদা ধর্ম, আলাদা রীতিনীতি আচার ব্যবহার ধর্মীয় অনুষ্ঠান খাওয়া পরা সবই যেন এক্কেবারে বিপরীত। সৃজার ভয় লাগছে এই সুন্দর জীবন কোন পাঁকে যেন আটকে না যায়।
অপরদিকে দানিশ খুব ভালো ছেলে। পুরো কলেজ লাইফে ওর মত সাহায্য অন্য কেউ করেনি। দানিশ পড়াশুনাতেও বুদ্ধিমান। পাস করার দু'বছরের মধ্যে ব্যাংকে চাকরি পেয়ে গেল। দানিশ সৃজাকে বিবাহের প্রস্তাব দিতেই সৃজা হ্যাঁ বলতে এক মুহুর্ত ভাবেনি। কিন্তু আজ কেন জানিনা বারে বারে মন বলছে — ভুল করছি না তো! কম বয়সে প্রেমের সম্পর্ক আবেগের উপর স্থাপিত হয়। কিন্তু পরিপক্ক বয়সে আবেগের চেয়েও বাস্তব পরিস্থিতি ও পরস্পর বোঝাপড়ার উপর নির্ভর করে। হয়তো তাই সৃজার মনে এত দ্বন্দ্ব কাজ করছে।
অসবর্ণের বিবাহ দুপক্ষের কেউই মেনে নেবে না। তাই ওরা সিদ্ধান্ত নিয়েছে আইন অনুযায়ী রেজিস্ট্রি ম্যারেজ করবে তারপর দুপক্ষই দুজনেরই বাড়িতে জানিয়ে দেবে। যদি মেনে নেয় তাহলে আসা-যাওয়া থাকবে না হলে দুজন মিলেই সংসার যাপন শুরু করবে।
ফোনে দানিশ প্রশ্ন করলো, 'কি হলো কিছু বলছো না কেন? '
— হ্যাঁ বলছি তো, বল কি জানতে চাও। সৃজা ফোনে কথা বলছে দেখে বিকাশ চা দোকান থেকে ছুটে মন্দিরের কাছে এসে একটা দেওয়ালকে আড়াল করে দাঁড়ালো যাতে ফোনের কথাগুলো শুনতে পায়। ওপাশ থেকে দানিশ কি বলছে তা বিকাশ শুনতে পাচ্ছে না কিন্তু সৃজা যা বলছে বিকাশ সবই শুনতে পাচ্ছে। দানিশের প্রশ্নের উত্তরে সৃজা বললো, 'হ্যাঁ আমি বাড়ি থেকে বেরিয়ে স্টেশনের কাছে চলে এসেছি। তোমাদের স্টেশন থেকে ট্রেনে ছাড়লে আমাকে ফোন করে দিবে আমি তৎক্ষণাৎ প্লাটফর্মে চলে যাব। এরপর দানিশ কিছু বলল যা বিকাশ বিন্দুমাত্র শুনতে পেল না তাই বিকাশ টিকটিকির শিকার ধরার মতো নিঃশব্দে এগিয়ে এসে শোনার চেষ্টা করল।
সৃজা বলল, 'না না বাড়িতে তেমন কিছু বুঝতে পারেনি। দাদাও ছিল না আমি মিথ্যা কথা বলে একাই বেরিয়ে এসেছি। তবে ভীষণ ভয় করছে।'
ওপাশ থেকে দানিশের কথা শুনে সৃজা কখনো ঘাড় নাড়ছে, কখনও হুম হুম বলছে, কখনও মুখের উপর আতঙ্কের অভিব্যক্তি ফুটে উঠছে।
— ঠিক আছে। আর বেশি কথা বলছি না দেওয়ালেরও কান আছে। দাদা জানলে হেস্তনেস্ত করে দেবে। ও কে, বাই।
দেওয়ালের কান, বিকাশ সৃজার সব শুনে কেটে পড়ল। ইন্টারভিউ দিতে ঢোকার আগের মুহূর্তে চাকুরি প্রার্থীর মতো সৃজাও বিচলিত হয়ে পড়েছে। ঘেমে একসা। রুমাল দিয়ে মুছতে মুছতে ভাবনায় বিমোহিত।
কিছুক্ষণ পর হনুমান মূর্তির কাছে হাতজোড় করে বলল, 'হে সংকটমোচন বাবা আমাকে এই সংকট থেকে উদ্ধার কর।' প্রণাম করে উঠে দাঁড়াতেই সৃজা দেখে আচমকা কয়েকজন ছেলে মন্দিরে ঢুকলো। সৃজা কিছু বুঝে ওঠার আগেই সৃজার দাদা সৃজার হাত ধরে টেনে বলে বাড়ি চল।
সৃজা টেনে হাত ছাড়িয়ে নেয়। বলে, 'না আমি যাব না। আমার কলকাতায় পরীক্ষা আছে। আমি তো মা-বাবাকে বলে এসেছি।'
— মিথ্যা কথা। তুই মাকে মিথ্যা কথা বলে বেরিয়েছিস। আবার হাত টেনে বলে, চল, এক্ষুনি বাড়ি চল, নাহলে ভালো হবে না বলছি।
— না যাবো না।
— তা যাবি কেন? তুই ডুবে ডুবে জল খাবি আর ভাবছিস দাদা কিছু জানতে পারবে না! সব জানি। মুসলমান ছেলের সাথে প্রেম করা। ওকে বিয়ে করতে যাচ্ছিস। দেখ আজ তোর পা যদি না ভাঙ্গি তো আমার নামই মিথ্যা। সৃজা এরকম একটা পরিস্থিতির কথা কল্পনাও করতে পারেনি। ভেতরের উত্তেজনা ও দাদার বিরূপ আচরণ সৃজার উত্তেজিতাকে আরও উদ্দীপিত করলো। সৃজা রেগে বলল, 'বেশ করেছি। যদিও না বিয়ে করতাম এবার অবশ্যই মুসলমান ছেলেকে বিয়ে করবো।
— মুসলমানকে বিয়ে করবি? তবে রে! সৃজার দাদা ক্রোধের শেষ সীমায় পৌঁছে ডান হাত দিয়ে সৃজার গলা টিপে যেন দেওয়ালে টেঙে দিল। সৃজা চিৎকার শুরু করায় অন্য ছেলেগুলো ওর মুখে কাপড় গুঁজে দেয়। ইতিমধ্যে দু-চারজন লোক ভিড় করে। যেই পুলিশের গাড়ি হাজির সবাই পালিয়ে গেল। কিন্তু সৃজার দাদা পুলিশের হাতে ধরা পড়ে গেল। তৎক্ষণাৎ এম্বুলেন্স ডেকে সৃজাকেও হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা করল পুলিশ। পুলিশি তৎপরতায় অ্যাম্বুলেন্স এগিয়ে চলল হাসপাতালের দিকে। স্ট্রেচারে শুয়ে থাকা সৃজার স্নায়ুতন্ত্রে একটিই প্রশ্ন অনুরণিত হচ্ছে, 'তাহলে জল্লাদ কে?'
************************************************************
পার্থসারথি মহাপাত্র
৯ এর দশক থেকে লেখালেখির সাথে যুক্ত পুরুলিয়া জেলার বলরামপুরের পার্থসারথি মহাপাত্র। বাংলার বিভিন্ন ছোট পত্রপত্রিকায় তাঁর লেখা বিচ্ছিন্ন ভাবে প্রকাশিত হয়ে আসছে। কবিতা ছাড়াও ছোট গল্প ও অণুগল্প নিয়মিত লিখে চলেছেন । তাঁর লেখা দুটি কবিতার বই 'বড়মুকরুর ছা'( মানভূমী ভাষায়) এবং 'ক্ষুধার স্পর্শে বর্ণমালা কেঁপে যায়' সমাদৃত। এখনো কোনো গল্পের বই প্রকাশিত হয়নি। পরবর্তী ক্ষেত্রে প্রকাশ করার সম্ভাবনা আছে।


কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন