রবিবার, ১৫ সেপ্টেম্বর, ২০২৪

উপন্যাস * দীপংকর রায়


  



['স্বরবর্ণে'র চতুর্থ সংখ্যা থেকে শুরু হয়েছে কবি দীপংকর রায়ের আত্মজৈবনিক উপন্যাস ' কথা দিয়েছিলাম হেমন্তের নিয়রে '। এই উপন্যাস লেখকের ষোল-সতের বছর বয়সের কালপর্ব থেকে শুরু। যদিও লেখকের জন্ম এপার বাংলায়, কিন্তু শিকড় ছড়িয়ে থেকেছে ওপার বাংলায়। কাজেই যাতায়াত থেমে থাকেনি। ইতিমধ্যে ১৯৭১ সালে রক্তক্ষয়ী লড়াইয়ের পর বাংলাদেশ স্বাধীন হয়। সদ্য স্বাধীনতা পাওয়া একটি দেশ ছেড়ে চলে আসা আর তারই নাছোড় এক টানাটানির মধ্যে যে জীবনের ক্রমাগত আসা আর যাওয়া ,এই উপন্যাস মূলত তারই এক নির্মম নিষ্ঠুর ভাঙা-গড়ার আশ্চর্য কথোপকথন। ধারাবাহিকভাবে যা আমরা পড়ছি, কবি দীপংকর রায়ের মায়াময় কলমে।]



কথা দিয়েছিলাম হেমন্তের নিয়রে 

পর্ব * ১৫ 

দীপংকর রায়



সে বেশ কিছুক্ষণ চুপ করে চেয়ে থেকে এবারে এই কথাটিই বললো শুধু দেখলাম —- আমি তোমার সব কথা ঠিক ভাবে বুঝতেই পারলাম না ভাই । তাই বলে তোমার কথা ফেলেও দিচ্ছিনে , আবার খুব পরিষ্কার ভাবে গ্রহণও করতে পারছি না , তবে তোমাকে অনুরোধ করবো আমি যাদের কথা বললাম তোমাকে তাঁদের লেখা পত্র একটু পড়ে দেখো আগে আমাদের ক্লাবে আমরা একটি ছোট্ট লাইব্রেরী করেছি, তুমি ইচ্ছে করলে, তার সদস্য হয়ে যাও ।

        জিজ্ঞাসা করলাম , সদস্য চাঁদা কতো ?

        সে বললো , মাসে পাঁচ টাকা করে । 

        আচ্ছা , তাহলে এই মুহূর্তে আমার হাতের বইগুলি আগে শেষ করে নিয়ে দেখি , তারপরে আপনাদের সদস্য হওয়া যায় কি না ।

       সে তাতে বলে , হাতের বই কি তোমার শেষ হবে কোনোদিন ! যে হারে তুমি বই কিনে চলেছো ; কজন আর এইভাবে পারে ?  সব কিনে  কিনে কি সবার পড়া হয়ে ওঠে , তাই বলো ? 

       বিষয়টা কি জানেন , আমি একটু নিজস্বতায় ভুগি তো‌ , তাই , তারপরে আবার ঘর কুনো চরিত্রের ; এ বাদে আমার সমস্ত দিনের কাজকর্মও তো দেখছেন , গোরু-বাছুর এই সব নিয়ে একেবারে নাজেহাল দশা । তাঁদের পরিচর্যাতেই তো  কেটে যায় দিনের সবটা একরকম , তাই এখানে ওখানে যাই কখন ?

     সে বলে তাতে , সমস্যাটা তো সেখানেই । কিন্তু একটু ভেবে দেখো এই বিষয়টা নিয়ে , কারণ বই কিনে কিনে তুমি কত পড়বে ? তাছাড়া মানুষের সঙ্গে মিশতেও তো হবে ভাই, চায়ের আড্ডায় কখনো যাও কি ? দেখিনি তো তোমায় কোথাও !

      বললাম , না না , সেটা ঠিক হয়ে ওঠেনি । ঠিক চায়ের আড্ডা যেভাবে হয় , সেভাবে ঠিক হয়ে ওঠেনিই এখনো বলতে পারেন ; আসলে কথাটা কি জানেন , আমাকে আমার অভিভাবকেরা ছোটোবেলা থেকে একটু নিয়মের মধ্যেই বেড়ে উঠিয়েছেন । তাঁরা সেটাই চেয়েছিলেন । তারপরে এখানে এসেও যাঁদের সঙ্গে মেলামেশা শুরু হলো এখানে , তারাও বলতে পারেন সব একরকমের একটা গন্ডিবদ্ধ অবস্থা থেকে উঠে এসেছে তো , তাই।

     —- বুঝেছি বুঝেছি , ঐ মনিন্দ্র কর্মকারের ছেলেটিকেই তো দেখি তোমার সঙ্গে বেশি ;  তা , ও এরকম কেন ? ওর বাবা তো যথেষ্ট লোকজনের সঙ্গে মেলামেশা করে , কিন্তু তার ছেলেটি দেখেছি তোমাদের মতো এই কয়েকজনের সঙ্গেই ; এখন সে  হয়েছে যখন তোমার ও বন্ধু ,  তখন এরকম একটা মানসিক গঠন তো হবেই , আসলে এরা সব মিশনারী ইস্কুলে পড়া ছেলেপেলে তো , এদের একটা আলাদা আলাদা মানসিকতা তৈরি হবেই , সেটাই দেখেছি আজ পর্যন্ত — যদিও এতে তো এদের সবটা দোষ একার নয় , যতোটা পরিবারের —- 

        —-- না না ,  সে ঠিক একা তো না , আরো অনেকেই আছে । কিছু বাইরের ছেলে-পেলেও আছে তো ; —- তবে তারা ঠিক রকে বসে বসে আড্ডা মারা ছেলে-পেলে না । তাই আমারও সৌভাগ্য হয়নি হয়তো সেভাবে কোথাও বলতে পারেন ।

       আমার কথা শুনে কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে তারপরেই হঠাৎ বেশ একটু গলাটা চড়িয়েই বলে উঠলো সে , —- কিন্তু একটা কথা কেন তুমি বুঝতে পারছো না , ওঁরা কিন্তু একটি প্রথাবদ্ধ ব্যবস্থার মধ্যে দিয়ে লেখাপড়া শিখে ভালো একটা চাকরি বাকরি জুটিয়ে নিয়ে সুন্দর সাজুগুজু করা একটা জীবন কাটাবে । কিন্তু একবার ভেবে দেখেছ কি , ওদের সঙ্গে তোমার জীবনের কি কোনো  মিল আছে ?  মিল তো থাকার কথাও না ! তুমি তো গোরু বাছুর লালন-পালন করে , তার ভেতর দিয়ে জীবন তৈরি করতে নেমেছো! অথচ ঠিক গোরু বাছুরের মধ্যেও তুমি তো থাকো না ; তোমার লক্ষ্য তো  অন্য দিকে । তাই আমি বলি কি , ঘরে বসে বসে শুধু বই পড়ে , এইসব ছেলেপেলেদের সঙ্গে মেলামেশা করে , একটা ছোট্ট গন্ডির- ই মধ্যে ঘোরাফেরা করে বেড়াবে শুধু !  বৃহত্তর দুনিয়ার মানুষ জনের খোঁজ খবর না পেলে , তুমি লিখবে টা কি ? তাঁদের জীবনের গতিবিধি দেখ । চা ওয়ালার জীবন , মাতালের জীবন , গাঁজা খোর , লম্পট , দালাল , বাউন্ডুলে‌ ,  ঠগ- জোচ্চোর ,এই সব সকলের জীবনের কাছে যেতে না পারলে ;  তাদের ভেতরে যেয়ে একেবারে বুঝতে হবে তোমাকে , তা না হলে তুমি তাদের মনের কথা মুখের ভাষা এ সব জানতে পারবে কীভাবে ! তুমি কি মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের জীবনের কথা জানো কিছু ? সুকান্ত ভট্টাচার্যের কথা হয়তো লোক মুখে খানিকটা শুনেছ ; তুমি যে শরৎচন্দ্র পড়ছো , তাঁর জীবনের কথা জানো ? চরিত্রহীন পড়েছো তো , কার কথা ওখানে বর্ণিত করেছেন শরৎ বাবু ? ভালো করে পড়ো , দেখ লেখকের জীবনচরিত ; তবেই না , তা না হলে কীভাবে তুমি না জেনে অনুপ্রানিত হতে পারবে ?

     তাঁর সঙ্গে এই সব কথাবার্তা ভাইএর যখন পড়াশোনা হয়ে যায়‌ , কাজের দিদি যখন তাকে চা বিস্কুট দেয় ,  তখনি সে আমার সঙ্গে এই সব গল্প আরম্ভ করে । 

      আর আমিও জানি না কেন যেন সমস্ত কাজের শেষে সন্ধ্যে‌বেলাটায় একটুখানি ফাঁক খুঁজে রেখে দিই তাঁর সঙ্গে এই সব নিয়ে বকবক করার জন্যেই বুঝি !

        যদিও ঠিক বকবক করা বা নিতান্ত আড্ডাও না , যত দিন যাচ্ছে ততোই তাঁর সঙ্গে আমার বোঝাবুঝির মাত্রাটি যেন বেড়েই চলেছে । সে তাঁর মত বলে‌ ,হয়তো  তাঁর মতো‌ন করেই , আর আমিও বলি আমার মতো । তারপরে একজায়গায়‌ যেয়ে‌ শেষ হয় । সে হয়তো‌ তাঁকে এগিয়ে দিতে যেয়ে পথের পাশে দাঁড়িয়েই এক দুই ঘন্টা কাটিয়ে দিলাম তার‌ সঙ্গে আলাচোনায় । 

     এই তো , আজই তো সে আমাকে রাশিয়ান সাহিত্যের একটা খোঁজ দিলো । বললো , রাশিয়ান গদ্য‌ সাহিত্যটা পড়ে দেখ আগে একবার‌ । একটা জিনিস দেখতে পাবে , কত‌ মিল আমাদের সঙ্গে যেন খানিকটা , আবার মনে হবে নাতো  ! 

       সেই আমাকে ম্যাক্সিম গোর্কি, তলস্তয় , পুশকিন , আরো কত সব নামের লেখকদের কথা বললো ।

        সেই বললো , লেলিনের জীবন জানো ? রাশিয়ান বিপ্লবের কথা , জারের শাসন , এ সব তুমি জানো কি ?  কার্ল মার্ক্স পড়ে দেখতে হবে। দাশ ক্যাপিটাল ।  যা না পড়লে তোমার অনেক কিছুই বাকি থেকে যাবে । মার্ক্সের কথা জানতে হবেই । সে এই গোটা দুনিয়াটাকে নাড়িয়ে দিয়ে গেছিল একদিন । সর্বহারার জীবন কথা আমরা যেমন রাশিয়ান দার্শনিক লেখকদের কাছ থেকে জানতে পারি , সেরকম ভাবে আর কারো কাছ থেকে জানতে পাই না ।

          সব কিরকম তালগোল পাকিয়ে যাচ্ছে । ওরে বাবা ! কত কিছুই না জানতে হবে আমায় ! এত কিছু কীভাবেই বা জেনে উঠতে পারবো রে বাবা ? এত তাড়াতাড়ি কি এত কিছু জেনে বুঝে উঠতে পারবো !  আর এত কিছু জেনে নিজের কথা জেনে , নিজের কথা বলার শক্তি কি সঞ্চয় করে উঠতে পারবো ? এ আবার কীরকম বিভ্রাটে পড়লাম রে বাবা ! বিশ্বসাহিত্যের সম্ভার কি কম ? তার কতটুকুই বা জেনে ওঠা সম্ভব ? এত কিছু জানতে জানতেই তো সময় ফুরিয়ে যাবে একদিন , তাহলে লিখবো কখন ? বলবোই বা কী এমন নতুন করে ? এঁরা কত কিছু জেনেছে ইতিমধ্যেই ! আচ্ছা , এত কিছু জেনে এরা কিছু লেখবার সাহস পায় না কেন ? আর আমি প্রতিদিনই তো আমার ডাইরির পাতা ভরিয়ে ফেলছি কত কিছু লিখে লিখে ! তাহলে সেগুলো কি সবই হাবিজাবি ? সে গুলি কি আদেও কিছু হচ্ছে নাকি , কিছুই হচ্ছে না ?

         একদিকে শঙ্কর বলছে ভারতীয় দর্শনের কথা । বেদ । উপনিষদ । পুরানের কথা । ওদিকে আবার পাশ্চাত্য সাহিত্য শিল্পের কথা । পাশ্চাত্য দর্শন , কতো কিছু ! আমি কার কথা শুনে এগোই ? এত কিছু জানতে জানতেই তো একদিন জীবন ফুরিয়ে যাবে ! তাহলে লিখবো কবে ? আবার ভাবি , ধুস্ …. এগুলি কি সব তাহলে জলে ফেলে দেবো ! না , ফেলেই বা দেবো কেন ? নিতাই দাকে খানিকটা বলবো ভাবলাম একদিন  । যদিও এত কিছু শোনার  পর , সেই হক কি আছে আমার ? সত্যি সত্যিই তো , এইসবের নাম আমি শুনিনি তো আগে !  তাহলে এত কথা বলা কি উচিৎ হবে 

আদেও ? আমি কি সব ঠিকঠাক বললাম তাহলে ? 

     কোনো সমাধানে যেন নিজের মধ্যে নিজেই আসতে পারি না । ভীষণ লজ্জা হতে লাগলো নিজেরই বলা কথা গুলি নিয়েই যেন । 

      মনে মনে বলি , সত্যিই তো আমি নিজে কিছুই জানি না । তাহলে,  ওরকম গরগর করে কী সব বকে গেলাম ? না জেনে , না বুঝে , সেদিন কেন তাহলে ওরকম ক্রুদ্ধ হয়ে বকে গেলাম ! নিজের এখনো কত ত্রুটিই না রয়ে গেছে , তার অন্যের চিন্তাভাবনার ভুল ধরিয়ে দিতে গেছি !

       নিজেই নিজের কাছে স্বীকার করে নিই । নিতাই দাকে আর কিছুই বলি না । 

        আসলে বিষয়টি হলো আমি নিজের কাছে নিজেইতো ঠিক করে পরিষ্কার নয় । তাই , সব সময়  নিজের কাছে নিজেই নানা অসহায়তায় ভুগি ।

     তবু একটা মন আমার এই বলে যাওয়ার পক্ষেই সায় দেয় ।

       যাইহোক যে পাপবোধ জন্ম নিতে যাচ্ছিল তার থেকে নিজেই সরে দাঁড়িয়ে বলতে পেরেছি যে , এটাই নিজের কাছে নিজের শান্তনা ।

       এইভাবেই নিজেকে শান্তনা দিই নিজেই । মনে মনে ভাবি , যা কিছুই জানি বা বুঝি , তার থেকে প্রকৃত অর্জন বাড়ছে কি আমার নিজের মধ্যে নিজেরই একটুও ? তবে প্রকাশ্যে এভাবে সব কিছু বলা যাবে না আর । অর্থাৎ বলবো না সরাসরি এভাবে আর। একটু আড়াল তৈরি করে বলতে পারাটা চেষ্টা করবো । নিজের মধ্যে নিজে টলবো না একটুও । আমার জানা এবং নাজানার ভাষা এক জায়গাতেই দাঁড় করাতে হবে , তা না হলে এত জানার ভিড়ে আমার অন্তরের জানা পথ আর  পথ খুঁজে পাবে না কোথাও । যদিও তারপরেও ভুলটা তো ভুলই —- আর ঠিক টা তো ঠিকই ?

     এই দুইয়ের প্রকার ভেদ নিজের কাছে নিজে একবার পরিষ্কার করে নেবো না , সেটা কি করে হয় !

      এখানে আসার পর থেকে আজ পর্যন্ত কালিদাস মামার কোনো খোঁজ  নিইনি যেমন , তেমন , সেও এ মুখো হয়নি কখনো । সে যেন কোথায় হারিয়ে গেছে ! কিন্তু কেন ? 

        সে অনেক কথা । ইতিমধ্যে সে যা যা ঘটিয়েছে , এদেশে শুধু না , এখানেই , এই অঞ্চলেই – কোথাও রয়েছে যে এটাই জানি শুধু । এবং খুব বেশি দূরেও নেই যে তাও জানতাম । কিন্তু সঠিক কোথায় থাকে তা যেন আজই জানতে পারলাম ।  

        তার কথা বলতে গেলে একটুখানি পেছন থেকে না বললে বলাটা ঠিক হবে না । 

          দেশ স্বাধীন হলে সেই যে‌ সে আমাদের সঙ্গেই ফিরে গেল ওদেশে , তারপর আবার মাগুরাতে তার মামা কৃষ্ণপদ ভৌমিকের ( কেষ্ট দাদু ) ওখান থেকেই আই এস সি  পাশ করলো রিলিফের সুযোগে । যেবার কাইলে মামা শিবু দা-রা সব হোই হোই করে ম্যাট্রিক পাশ করলো রিলিফের সুযোগে , সেইবার । আমরাও যেমন যুদ্ধের কারণে এক ক্লাস এগিয়ে পরের ক্লাসে উঠে গেলাম । শুনু মামা তার ভূবন দাকে বললো , “ ও ভূবন দা , তুমিও পরীক্ষে দিলি অক্লাসে ম্যাট্রিকটা এবারে  পাশ করে যাতি পারতে কিন্তু কলাম , হে … হে … ও ভূবন দা , তালি দ্যাখপা নাহি একবার চিষ্টা করে কী হতি পারে , আরে দেহোই না ….. এত মানুষ দেচ্ছে…. তুমিও দিয়ে দিলি মন্দ হয় না , …. উ … হু … হা… হা.. হা…..” 

      এসব সব তো ইতিমধ্যেই আবার কত পেছনে চলে গেছে ! এই তো দেখতে দেখতে সেও হয়ে গেল প্রায় দেড় দশক ! 

          কালীদাস মামার সেবারে রেজাল্ট বেরোনোর পরে , বড় দাদুর একান্ত ইচ্ছেতেই , সে আবার এদেশে চলে এলো । তবে সে ক্ষেত্রে তারও যে একেবারে ইচ্ছে ছিল না তা না । ফিরে এসে সে এই নিতাই দা দেরই একটি বাড়ি পরের বাড়িতে ভাড়া থাকা শুরু করলো । যেখানে একাত্তরের গন্ডগোলের সময় তাদের পরিবারকে যেখানে ভাড়া বাড়ি করে রাখা হয়েছিল । এবারে সেখানেই সে তার মাসতুত এক ভাইকে সঙ্গে নিয়ে‌ থাকা শুরু করে দিল । 

       দীলিপদার কথা পূর্বেও এসেছে । তার সঙ্গে অনেক কথা আগে হয়েছে যে , সে কথা মনে আছে সব ই ।

       কালীদাস মামা বাড়ি বাড়ি টিউশন পড়ায় । এই বিষয়ে শুনি তার নাকি ইদানীং একটা সুনাম ও হয়ে গেছে এই অঞ্চলে । এবং আর একটি কাজ সে এই সুযোগে এখানে এসে করে নিয়েছে , সেটা হলো নেতাজি নগরের নৈশ বিভাগ থেকে বি এ পাশটিও করে নিয়েছে । এদিক ওদিক চাকরির দরখাস্ত ও করেছে । কিন্তু ঐ যা হয় , তাইই হয়েছে । শেষ পর্যন্ত আর সেই যুদ্ধে লেগে না থাকতে পেরে টিউশন পড়ানোই তার জীবিকার মাধ্যম বা উপার্জনের মাধ্যম বলেই ধরে নেয় সে  ।

       ইতিমধ্যে যে বাড়িতে সে ভাড়া থাকে সেই বাড়িরই বড় মেয়েটির সঙ্গে পরে বিবাহের সম্পর্কে জড়িয়ে পরে । 

        তার পছন্দের এই সিদ্ধান্ত আমাদের পরিবারের কারোরই নাকি সম্মতি মেলেনি  । তার বিবাহের অনুষ্ঠানে আমাদের বাড়ির কারোরই উপস্থিতি ছিল না । 

     এবং এই না থাকাকে কেন্দ্র করেই হয়তো এই দূরত্ব । এবং এমনই সেটা , এত কাছে থেকেও , সে যত দিন তার শ্বশুরালয়ের এখানে ছিলো , ততোদিন পর্যন্ত কোনো যোগাযোগ সেও করেনি যেমন তেমন আমাদের বাড়ির তরফ থেকেও সেটাই ঘটেছে । ইতিমধ্যে সে শ্বশুর বাড়ির ভাড়ার ঘর ছেড়েছে এবং বর্তমানে কোথায় আছে সেটাও আমাদের জানা ছিল না । তবে এই অঞ্চলেই রয়েছে যে তার আভাস তো পাই এদিক ওদিক থেকে ঠিকই ।


       ওদেশ থেকে চলে আসবার আগে বড় দাদু আমার চলে আসবার খবর জানতে পেরে আমাকে অনুরোধ করেছিল কয়েকটি কথা বলে এই ভাবে , ভাইডি , তুমি তো শুনতিছি যাবা চলে , তা যাবাই যহনে ,  তহনে তোমারে এটটা কথা কই , তারে এটটু বুঝোয়ে কোয়ো , সে যেন একটিবারের জন্যি এই দ্যাশটায়  আইসে ঘুরে যায় । আমাগের কথা না হয়ে ছাইড়েই দিলাম , তার ও তো ইডা নিজির দ্যাশ ? জন্মভূমি । তারেও কি সে ভুলে গ্যালো ? পারলো কী কোইরে ! ওরে কি এই শিক্ষা দিছিলাম ! যাক গে , যাক গে , সব ই ভুল ; সবই আমাগের কপালের ভাইডি , সবই আমাগের কপালের দোষ , তা না হলি এমনডা হবে ক্যান ? তুমিও যাতি চাচ্ছো যাও , কিন্তু কথা ডা তোমারে মনে করালাম শুধু ,  আর কিছু না । এই আর কি ……

        কথা দিয়েছিলাম বললে ভুল হবে , তবে বলেছিলাম —- ঠিক আছে দাদু , সে যদি আমাগের বাড়ির দিকি আসে , তালি আমি তারে অবশ্যিই কবার চিষ্টা করবানে  । তবে শুনিছি , মা অনেক দুঃখ করে লিখিছিল একবার তার কথা অনেক কিছু , শুনিছি সে নাকি আমাগের বাড়ি মুখোটি হয় না‌ একেবারেই । তার বিয়ের পরে এমন উন্নতির কথা বলে মা অনেক দুঃখির কথা লিখিছিল একবার । আর সে সব সব তো আপনারও জানার কথা না , তাও  তো না ! আর তারপরেও আরেক কথা , আমি যদি যাতি পারি ওদ্যাশে তবেই তো ! না হলি আর কার কথা কারে কিডা কচ্ছে , তাই কন ?

       এই সব কথপোকথনের মধ্যে এমনই এক বাস্তব রূপ অনেক কাল অবধি এমন ভাবে প্রত্যক্ষ করেছি , যে‌ কথা মূল বেদনার সুরটি যে কত দূর যেয়ে ধাক্কা খাচ্ছে , সে কথা আর কাকে বুঝিয়ে বলি !

        তাছাড়া কালীদাস মামার ক্ষেত্রে সেটা এমন রূপ নেবে যে , সেটা ভাবতে গেলেও কষ্ট হয় বড় । কারণ সেই একাত্তরের দিনগুলি , তার আগে এবং পরে , তার সঙ্গে আমার যে দিনগুলি কেটেছে , নানা অনুভব গুলি দেওয়া নেওয়া হতো যেভাবে সে সময় তার সঙ্গে যে যে ভাবে , সেই দিনগুলির সঙ্গে তাকে আমি এভাবে ভাবতে গেলে আমাদের জীবনের সব মূল্যবোধ গুলি ভেঙেচুরে চুরমার হয়ে যায় যে ! 

        তাই আমার জীবনে তাকে পরবর্তীতে দেখে , বা তার কথা শুনে যে বড়সড়ো একটা ধাক্কা খেয়েছিলাম , এমন ধাক্কা যেন তার আগে কেউ আমার অনুভবে এই ভাবে  দিতে পারেনি !

      তাই তার সংবাদ যেটুকু জানি , তাতে সেটাই যেন বাঞ্ছনীয় ছিলো আমাদের সকলের কাছেই । 

       তবুও তাকে নিয়ে এখনো আমার ভেতরটার একটা হু হুঁ করা ভাব যে তৈরি হয় সে কথাও স্বীকার করি । আর সেটাকে আমি এড়িয়ে চলতে পারি না একেবারেই । 

        তার শ্বশুরবাড়ির সামনে দিয়েই আমাদের সকলের হাঁটা পথ । সে মায়ের দু-বেলার অফিস যাওয়াও যেমন , তেমন আমার ও তো দানাভুসি আনতে যাওয়ার জন্যেই বলো , আর সদর কলকাতার দিকে কাজেকর্মে যাওয়ার জন্যেই বলো , পথ তো সেই একটাই আমাদের সকলের ।

       কালীদাস মামার বিবাহের পরে দীলিপ দাও কেন জানি না এই অঞ্চল থেকে একেবারে মিলিয়ে গেল। অথচ সেই মানুষটির কাছের থেকেই আমার প্রথম সমাজ সচেততার প্রথম পাঠ নেওয়া । যার কাছের থেকেই জানতে পেরেছি এই ভূমণ্ডলে এমন একটি দেশ আছে যার নাম ভিয়েতনাম । যেখানের মানুষেরা দীর্ঘকাল ধরে স্বাধীনতার জন্যে লড়াই করেছে একটি শক্তিশালী শাসনতন্ত্রের বিরুদ্ধে । একটি শক্তিশালী ক্ষমতার বিরূদ্ধে । 

          সেই দীলিপদা মানুষটি যে কোথায় হারিয়ে গেল , তাও জানতে পারলাম না , বা বুঝতেও পারলাম না একবারটিও !

          দীলিপ দার সঙ্গে তাদের দুই মাসতুতো ভাইএর একে অন্যের কী নিয়ে বিবাদ হয়ে ছাড়াছাড়ি হলো সে বিষয়েও বিন্দুমাত্র  জানতে পারিনি অনেক কাল অবধি । 

      আজ সেই কালীদাস মামাকে বহুকাল পরে একেবারে মুখোমুখি হলাম গাছতলায় একটি পান সিগারেটের দোকানের সামনে । প্রথমটায় খানিকটা অবাক হবার পালা তাকে ধুমপান করতে দেখে । এ যেন আর একটি চমক ! যাইহোক কত চমকই তো ঘটে মানুষের নানা পরিবর্তন দেখে । সে কি কম দেখতে পাচ্ছি যত দিন যাচ্ছে সর্বক্ষেত্রেই তো বিস্ময়ের এই হতবাক দৃষ্টান্ত তুলে ধরা যায় । তাই এ আর এমনকি ! তবুও তো একটু চমকে যাওয়া থাকেই । 

         আজ সে আমাকে দেখতে পেয়ে নিজেই ডেকে দাঁড় করালো । যদিও তার আগেই তাকে আমি দেখেছি । কিন্তু কি করবো ভাবার আগেই সে আমাকে ডেকে নিলো । 

       কী একটা কারণে যে ব্যাস্ত ছিলাম সেটা মনে নেই । সে বেশ একটি মস্ত টান দিয়ে সিগারেটে বললো , কোথায় যাচ্ছিলি ? 

           বললাম , এই একটা কাজে বেরোইছিলাম … ।

            সে বললো , জানি , আমি সব-ই জানি , তুই যে এহেনে আইছিস সে কথা জানি , কিন্তু তোগের কোনো খোঁজ নিতি পারিনি নানা কারণে ।

            আমি খানিকটা সে কথায় গুরুত্ব না দিয়েই বললাম তাকে ,  জিজ্ঞাসা করলাম , আপনি এই বস্তুটি কবে ধরলেন ? 

               — সে বেশ কিছুকাল , মুখি খুব গন্ধ হোত তো তাই , ডাক্তারবাবুই ধরাইছেন ; তিনিই 

কোইছিলেন , আপনি পড়ানোর আগে পড়ে একটা দুটো খাবেন ।

                —- তাহলি তো এই ডাক্তার বাবু বেশ অন্যরকমের কতি হবে মামা ! ডাক্তার রা তো আগেই ধুপপান করে কিনা রুগী সেই কথা জিজ্ঞাসা করেন , এবং এই বিষয়টিতে একেবারেই তাদের ‘ না’  আগেই , আর আপনাকে কোলো কিনা ধুমপান করেন !

              —  না না , তার সঙ্গে আরো কিছু কারণ ছিল , একেবারে ঘুমোতি পারতাম না । ঘুম আসতোই না । রাত্তিরে জাইগে বসে থাকতাম সারারাত্তির একা একা । তাইতি । তা তুই কি ধরিছিস নাকি ? নে , নে না নে , ধর ….

               —- খাই না যে একেবারে সে কথা কলি মিথ্যে বলা হবেনে , মাঝে মধ্যে খাই , তবে নিয়মিত না । 

              —-- তালি আর কি আছে , নে , ধর একটা । সংকোচ করবার কী আছে ? ও কিছু না , এহনে বড় হোইছিস , এতে দোষের কিছু নেই । এহনে সবাই সমান । 

            সংকোচ যে হয়নি তাও না , আবার ইচ্ছেও যে হয়নি তাও না । ভাবলাম , আচ্ছা , এই সূত্রে যদি তার সঙ্গে কিছুক্ষণ কথা বলে মনের এই দূরত্বটুকু খানিকটাও কাটিয়ে ওঠা যায় , তাহলে মন্দ কি !

            সেও তারপরে দেখলাম বেশ খানিকটা মন খুলেই যেন বলতে লাগলো , জানিস তো তোর সঙ্গে মনে হয় ভগবান আজ দেখা করাইছেন । তা না হলি আমার তো এখনে এখেনে দাঁড়ানোর কথাই না ! এটটা টিউশন বাদ গ্যালো বলেই‌ তো এহেনে দাঁড়াই ছিলাম এটটা সিগারেট ধরানোর জন্যি । যদিও আজ কদিন কেন জানি নে তোর কথা ভাবতিছিলাম ; কথায় কয় না , কেউ কারো কথা ভাবলি ঈশ্বর তারে তার সংবাদটা অন্তরাল থাইকেই সেই ব্যাক্তির কাছে পৌঁছোয়ে দেন মনে‌ হয়‌ , তা না হলি এই ক্ষেত্রে সেইটা  হোল কী করে !

         কালীদাস মামার মুখের ভাষায় দু-দিককারই টান । দু-প্রান্তের মিশ্রণ-ই ঘটে চলেছে… । তবে এই মিশ্রণ তার অন্তরে কতটুকু আজও ওদেশের জন্যে অনুভবে আছে , তা সেই জানে । তবে কিছুক্ষণ কথা বলার মধ্যে একটা কথাই মনে হচ্ছে সে যেন কিছু বলতে চায় , অথচ বলতে চেয়েও থেমে যাচ্ছে ! হয়তো ভাবছে কিছু । তবে আমি তার কথাবার্তার মধ্যে বেশ বুঝতে পারছি  বারবার সে বলতে চাচ্ছে যেন কিছু , অথচ বলতে পারছে না । বারবারই প্রসঙ্গ তুলছে , কেন তার এতকাল  আমাদের কারো সঙ্গে কোনো যোগাযোগ রাখতে না পারার কারণের কথা । যেন এর পেছনে অনেক কারণ রয়েছে , এমন কিছু উল্লেখ সে করছে । আবার থেমে যাচ্ছে এই বলে , জানিস না তো তোরা কিছুই , আমি এহনে কেমন রইছি যে …. ;



















****************************************************************

আগামী পর্বে 

****************************************************************

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন