[ 'স্বরবর্ণ * ১২ সংখ্যা থেকে শুরু হয়েছে বিশ্বনাথ পালের ধারাবাহিক উপন্যাস 'বামনের চন্দ্রাভিযান'। উপেক্ষা, অনাদর আর দারিদ্র্যের তীব্র দংশনজ্বালা দাঁতে দাঁত চেপে, একটি যুবক কী ভাবে একক নিঃসঙ্গ লড়াইয়ে জীবনের সাফল্য ছিনিয়ে আনে, এই উপন্যাস তারই জীবন্ত আখ্যান। লক্ষ লক্ষ বেকার যুবকের বেকারত্বের জ্বালার বাণীরূপই শুধু নয়, তা থেকে উত্তরণের অমোঘ বিশল্যকরণীও বটে এই উপন্যাস।]
বামনের চন্দ্রাভিযান
পর্ব * চার
বিশ্বনাথ পাল

“টুকটাক জানি। ইমেল করতে পারি। চিঠি টাইপ করতে পারি। মানে এম এস ওয়ার্ডের কিছু কাজ জানি। কিন্তু কোনও প্রাতিষ্ঠানিক ডিগ্রি নেই।”
“আচ্ছা, তুই তাহলে একটা সিভি বানা কম্পিউটারে। তাতে তোর এডুকেশনাল কোয়ালিফিকেশন, কত পার্সেন্ট নম্বর পেয়েছিস সব দিবি। এর একটা প্রিন্ট আউট নিবি। আর স্টেটসম্যান পেপারটা ফলো কর। ওখানে দেখবি ওয়াক ইন ইন্টারভিউ, সিচুয়েশন ভাকেন্ট-এর বিজ্ঞাপন থাকে। ওগুলো দেখে অ্যাপ্লাই কর।”
ছোটনদার কথাগুলো আমারও মনে ধরল। মাধ্যমিক পরীক্ষা দিয়েই রেজাল্ট বেরনোর আগে থেকেই বাড়ি বাড়ি গিয়ে টিউশনি পড়াই। আমাকে প্রথম টিউশনির হদিশ দিয়েছিল আমাদের বাড়ির উল্টোদিকের মুদি দোকানি নির্মলদা। ছাত্র পাড়ারই এক মধুদার ছেলে। ক্লাস ওয়ান, সপ্তাহে পাঁচ দিন, ফি ষাট টাকা। বাচ্চাটিকে একদিন গোলাপ ইংরেজি জিজ্ঞেস করায় উত্তরে বলেছিল, “পদ্ম।” এখন আর অত নিচু ক্লাস পড়াই না। এখন আমার সব থেকে নিচু ক্লাসের ছাত্র পড়ে এইটে। কিন্তু বাড়ি বাড়ি গিয়ে পড়াতে আর ভাল লাগে না। সমাজ গৃহশিক্ষককে খুব তাচ্ছিল্যের চোখে দেখে। যেন যে টিউশনি করে তার আর অন্য কিছু করার যোগ্যতা নেই। তাই ভাবলাম একটা প্রাইভেট ফার্মে যদি ছোটখাট কাজ জোটানো যায়, যা দিয়ে আমার বেঁচে থাকা জারি থাকবে আর পাশাপাশি সরকারি চাকরির জন্য পড়ব, তাহলে ভালই হয়। টিউশনি ছেড়ে দেব।
মাস দুয়েকের মধ্যে বুঝে গেলাম যে সে গুড়ে বালি। ছোটনদার কথামতো স্টেটসম্যান রাখতে শুরু করেছি। লাল কালি দিয়ে সিচুয়েশন ভাকেন্ট দাগাতাম, যেগুলি আবেদন করতাম, সেগুলোর পেপার কাটিং একটা খাতায় আঠা দিয়ে সেঁটে রাখতাম। আশার সমাধি ঘটা কেসগুলির নিস্পত্তি হয়েছে মনে করে লাল কালির ক্রস দিতাম। বেশ কয়েকটা ওয়াক ইন ইন্টারভিউ দিতে গেলাম।
দেখলাম বেকারত্বের সমস্যা শুধু আমার একার নয়। বরং দেশের অধিকাংশ যুবক যুবতিই দেখছি বেকার বা মনের মতো কাজ খুঁজছে। আমি ক’দিন হাওড়া, পার্কস্ট্রিট, মানিকতলা করলাম। বেশ কিছু ইন্টারভিউ দিলাম। কিন্তু কাজের পূর্ব অভিজ্ঞতা যেহেতু শূন্য, যেহেতু টিউশনি করা কোনও কাজ হিসেবে গণ্য নয় (বেকারদের ক্ষেত্রে, স্কুল-কলেজের শিক্ষকদের ক্ষেত্রে নয়), আমার ভাগ্যে শিকে ছিড়ল না। এমনকী কলেজস্ট্রিটে এক প্রকাশকের দরবারে বইয়ের ক্যানভাসারের কাজের সন্ধানেও ছুটলাম। আমার ভাবনায় ছিল অবশ্য মেডিক্যাল রিপ্রেজেন্টেটিভের কাজ। কিন্তু এদিকে ডিগ্রি বিশুদ্ধ বিজ্ঞানের নয়, সমাজ বিজ্ঞানের। সত্যজিৎ রায়ের ‘জনঅরণ্য’-র সোমনাথের মতো আমাকে চাঁদের ওজন কত জিজ্ঞেস করা হয়নি ঠিকই, তবে একবার আমার সিভিতে প্রাপ্ত নম্বরের শতাংশে ক্রমাবন্নতি লক্ষ করে বোর্ডের একজন বলেছিলেন, “মানুষের বুদ্ধি কি দিনে দিনে কমে না বাড়ে?” বোঝো!
ভেবেছিলাম সাড়ে তিন হাজার টাকারও যদি একটা চাকরি পাই, তাহলে গাড়িভাড়া, টিফিনখরচ বাদে হাতে হাজার দুয়েক থাকবে। তার থেকে এক হাজার মাকে দেব সংসার খরচে আমার অবদান হিসেবে আর বাকিটা সরকারি চাকরির পড়ায় ব্যয় করব—দৈনিক খবরের কাগজ, বই-পত্রিকা, পরীক্ষার জন্য পোস্টাল অর্ডার কেনা, এটা-ওটা। টিউশনি আর করব না।
কিন্তু দেখলাম টিউশনির পথই অনেক নিরাপদ। বেসরকারি চাকরি যেন আমার জন্য নয়। আমার এম. এস-সিজ মার্কশীটের কোনও মূল্য নেই নিয়োগকর্তাদের কাছে। অথচ মার্কশীট কিন্তু একটা ছেলে বা মেয়ের পারদর্শিতার প্রকৃত পরিচয় বহন করে না বলেই মনে হয়। তার ওপর তেমন বলিয়ে-কইয়ে নই। কথা বেচে যারা খেতে পারা মানুষেরা অগ্রগণ্য।
ফলে বাপিদার সঙ্গে এক যৌথ কর্মপ্রচেষ্টায় সামিল হলাম। আমাদের পড়ানোর পেশাটিকে খানিকটা প্রাতিষ্ঠানিক রূপদানের প্রয়াসে। একটি কোচিং সেন্টার খুলতে চাইলাম। জীবনানন্দে অনুপ্রাণিত নামটা আমারই দেওয়া—‘সুচেতনা স্টাডি সেন্টার’। সুশিক্ষা তো সুচেতনা আনে, আবার জীবনানন্দের কবিতাতেও শব্দটা আছে—‘সুচেতনা, তুমি এক দূরতর দ্বীপ’, অর্থাৎ যা দুর্লভ।
বাপিদার আরেক অন্তরঙ্গ বন্ধু কিংশুকদাও আমাদের প্রচেষ্টায় সামিল হল। ঠিক হল বাপিদার সুবোধ পার্কের ফ্ল্যাটবাড়ি হবে আমাদের স্টাডি সেন্টারের প্রধান কেন্দ্র ও পড়ানোর জায়গা। ছাত্রছাত্রী বাড়লে আমার বাড়িও শাখাকেন্দ্র হিসাবে ভাবা যাবে। পড়ানোর জায়গা দেওয়ার জন্য বাপিদাকে কোনও বাড়িভাড়া দিতে হবে না। কিংশুকদা, বাপিদা এবং আমি তিনজনেই ভাগ করে পড়াব। এখানে বাপিদা ও কিংশুকদা দুজনেই সায়েন্সের পাশ গ্রাজুয়েট । তিন জনের সমান অংশীদারিত্ব এবং প্রাপ্ত অর্থ সমান ভাগে বণ্টিত হবে—এই আমাদের অলিখিত চুক্তি। এছাড়া আমাদের প্রত্যেকের যার যা আলাদা আলাদা টিউশনি আছে সে সেগুলি পড়াবে কোচিঙে পড়ানোর সময়ের সঙ্গে অ্যাডজাস্ট করে। পাশাপাশি বাপিদার সঙ্গে আমাদের সরকারি চাকরির প্রস্তুতিও জারি থাকবে। কিংশুকদা ও বাপিদা দুজনে আগে থেকেই একসঙ্গে পড়ত।
সেই সময় শয়নে স্বপনে কিছুদিন সুচেতনা স্টাডি সেন্টারের কথা ভাবতাম। ভাবতাম অচিরেই এটি আমাদের বাঁচার অবলম্বন হবে। তখন আর চাকরি খুঁজতে হবে না।
একদিনের কথা স্পষ্ট মনে পড়ে।
আমরা সেদিন দাঁড়িয়ে ছিলাম বাঁশদ্রোণী ব্রিজের গোড়ায়। আমার পাশে বাপিদা একটি ছেলের সঙ্গে কথা বলছে। কী বলছে আমার কানে ঢুকছে না। কারণ যন্ত্রণাটা সেসময় আমার মাথার ভিতর সংকেত পাঠাচ্ছে। এখনি হয়তো তাণ্ডবনৃত্য শুরু হবে। আমার পকেটে একটা ঠোঙায় রাখা কালো জিরে। বাঁ হাতের তালুতে কিছুটা কালো জিরে নিয়ে আমি ডান হাতের বুড়ো আঙুল দিয়ে ঘঁষছি। আমাকে কেউ এভাবে দেখলে ভাববে খইনি ডলছি। এরপর বাঁ হাত উপরে তুলে ডান হাতের বুড়ো আঙুল চেপে এমন ভঙ্গিতে কালো জিরের ঘ্রাণ নাকে টানছি যে সেটা দেখেও কেউ ভাবতে পারে আমি জনসমক্ষে কলকেতে গাঁজা টানছি। কিন্তু কে কী ভাবল সেটা ভাবার মতো মানসিকতা আমার ছিল না। বাপিদা আমাকে বলেছে, কালো জিরে ভাল করে ডলে তার ঘ্রাণ নিলে মাথার যন্ত্রণা কমে। কবিরাজি ওষুধ। চড়া রোদ উঠেছে আর যন্ত্রণাটাও আসব আসব করছে। আমি তাই ঠেকিয়ে রাখার আপ্রাণ চেষ্টা করছি। বছর তিনেক হল এই যন্ত্রণাটা আমার মাথায় অতিথি হয়েছে। শঙ্কর ডাক্তারকে একবার দেখিয়েছিলাম। ওষুধ খেয়ে কিছু দিন ভাল ছিলাম। তার পর যে কে সেই। একটু আগে বাঁশদ্রোণীর তিনটে ওষুধের দোকানে খোঁজ করেও একটা ওষুধ পেলাম না, ওটা খেলে সাময়িক নিস্তার পাওয়া যায়। বাধ্য হয়ে কালো জিরেই কিনলাম। তবে সারা বছর যন্ত্রণাটা আমার মনোযোগ দাবি করে না। গরম চলে গেলে সে-ও অদৃশ্য হয়।
দিনটা ছিল এপ্রিলের চব্বিশ। সূর্যপুর বয়েজের রেজাল্ট বেরোবে। আমি আর বাপিদা তাই বাঁশদ্রোণী ব্রিজের গোড়ায়। আমাদের সামনে মোশারফের ভাই। আমাদের লিফলেট বিলি করছে। সূর্যপুর স্কুলের যেসব ছাত্র ব্রিজে উঠতে যাচ্ছে, মোশারফের ভাই সহিদুল তাদের হাতে একটা করে লিফলেট ধরাচ্ছে। আর আমরা দাঁড়িয়ে আছি ছেলেরা সেই লিফলেট নিয়ে পড়ছে, না মুড়িয়ে ফেলে দিচ্ছে দেখার জন্য।
আমাদের কোচিং সেন্টারেরই প্রচারপত্র বিলি করছে সহিদুল। বন্ধুর ভাইকে একদম বিনা পয়সায় খাটাচ্ছি না। কাজটা নিজেরাই করতে পারতাম, কিন্তু পড়তে এসে ছাত্রছাত্রী যদি দেখে যে যারা পড়াবে অর্থাৎ স্যাররাই লিফলেট বিলি করেছে স্টুডেন্ট জোগাড় করতে, তবে ইম্প্রেশন খুব খারাপ হবে বলেই আমাদের ধারণা।
কালো জিরের গুণ আছে বলতে হবে। যন্ত্রণাটা যেন ব্রেক কষেছে। এই যন্ত্রণা যখন মাথার মধ্যে দাপাতে থাকে তখন আশঙ্কা হয়, মাথার ভিতর একটা টিউমার হয়েছে। এবং সেটা বাড়ছে। বাড়তে বাড়তে একটা বিস্ফোরণ ঘটিয়ে আমার প্রাণ কেড়ে নেবে। আর টের পাই এই বেঁচে থাকাকে কী ভীষণ ভালবাসি। আবার কখনও মনে হয় এটা সাইনাসের। চড়া রোদের সঙ্গে নির্ঘাত কোনও সম্পর্ক আছে। সাধারণত গরমকালে দিনের বেলাতেই যন্ত্রণাটা দেখা দেয়।
ছেলেরা লিফলেট নিচ্ছে বটে, তবে সকলে পড়ছে না। অনেকে রেজাল্ট দেখতেই ব্যস্ত।
একটু আগে বাপিদা সহিদুলকে বেশ কিছু সাদা লিফলেট দিয়ে এসেছে। সহিদুল এখন সাদা লিফলেটই দিচ্ছে। বাপিদার মনে হয়েছিল যে হলুদ লিফলেট কেউ পড়ছে না, সাদাটা হয়তো পড়বে। হলুদটা ইংরেজিতে লেখা আর সাদাটা বাংলায়। আমরা চার হাজার লিফলেট ছাপিয়েছি। প্রথমে দু’-হাজার ইংরেজিতে, পরে আরও দু’-হাজার বাংলায়। বাপিদা আমাকে বলেছে, “তুই কোনও চিন্তা করিস না, দশ-পনেরোটা স্টুডেন্ট আমি লিফলেট ছাড়াই জোগাড় করে দেব।” আরেক দিন বলেছে, “লিফলেট থেকে একজন স্টুডেন্ট আসলেই আমি খুশি।”
একটু আগেও সূর্যটা ঠিক মাথার উপর ছিল। এখন একটু হেলে পড়েছে। আর ছাত্রও আসছে না। আমি ব্রিজের ওপারে গিয়ে পাঁচ টাকা দিয়ে চারটে ডাসা পেয়ারা কিনলাম। বাপিদা খেল না। আমি একটা নিয়ে বাকিগুলো সহিদুলকে দিয়ে দিলাম। আর বাপিদা সহিদুলকে আজকের কাজের জন্য ওর প্রাপ্য টাকা দিয়ে দিল।
আমাদের তালিকায় ন’টি স্কুলের নাম ছিল। প্রায় সব ক’টা স্কুলই কভার করেছি। এপ্রিলের বাইশ থেকে উনত্রিশ প্রচুর খাটাখাটনি গিয়েছে। সকাল বেলা কোনওদিন এগারোটা থেকে বারোটা রোদের মধ্যে স্কুলের সামনে দাঁড়িয়ে থেকেছি। মোশারফের ভাই যেদিন আসতে পারেনি, আমরা নিজেরাই লিফলেট বিলি করেছি। ভাবমূর্তি নিয়ে তখন ভাবিনি। কখনও বাপিদা আঠা কিনে এনেছে—দু’চারটে লিফলেট পোস্টার করে সেঁটে দিয়েছি স্কুলের গেটে। একই দিনে দুটো স্কুলের রেজাল্ট বেরনোর দিন দুপুরের খাওয়ার সময়ও পাইনি আমরা। তবে সব লিফলেট আমাদের বিলি হয়নি। এখনও হাজার খানেক আছে। ওগুলো সকালের খবরের কাগজের মাধ্যমে বিলি করার ইচ্ছা বাপিদার। কাগজের হকারকে কিছু টাকা দিয়ে নাকি এভাবে বিলির ব্যবস্থা করা যায় খুব সহজেই। বাপিদা বলেছে। তবে একদিন ভোরে ওঠার কষ্ট করতে হবে।
আমাদের এই পরিশ্রমের মধ্যে মনে রাখার মতো উল্লেখযোগ্য কিছু নেই। তবে একদিন বাপিদা একটা বুদ্ধি বাতলেছিল। আমাদের লিফলেট কেউ পড়ছে না দেখে বাপিদা বলেছিল, বিশ্বকাপের ফিক্সার লিফলেটের পিছনে ছাপিয়ে দিলে হয়তো কেউ আর লিফলেটটা ছুঁড়ে ফেলবে না। মে-র ৩১ থেকে ফুটবল বিশ্বকাপ শুরু। সুতরাং প্রায় এক মাস বাকি, আরও এক মাস জুড়ে খেলা চলবে— এই দু’মাস আমাদের প্রচারপত্র মূল্যবান মনে হতে পারে। বাপিদার দ্বিতীয় বুদ্ধি, লিফলেটের পিছনে রুটিন লেখার ছক ছাপানো। তাতেও ছেলেমেয়েরা রুটিন লেখার কাজে লাগবে ভেবে হয়তো ফেলে দেবে না। যে সময়ের কথা বলছি পৃথিবী তখনও এত গ্যাজেটনির্ভর হয়নি। হাতে হাতে তথ্যভাণ্ডাররূপী ইন্টারনেটসমৃদ্ধ স্মার্ট ফোন তো দূরস্থান, কলকাতায় মোবাইল এসেছিল কিনা সন্দেহ।
বাপিদার দু’টি পরিকল্পনার সঙ্গে আমার সংযোজন— লেবেল। ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা বই মলাট দিয়ে নাম ক্লাস রোল নম্বর লেখার জন্য লেবেল লাগায়। আমরাও লেবেল ছাপিয়ে বিলি করতে পারি, যার একাংশে থাকবে আমাদের কোচিং-এর বিজ্ঞাপন ফোন নম্বরসহ। এই তিনটি পরিকল্পনাই আলোচনার স্তরে ছিল। কিন্তু আমরা কখনও ভাবতে পারিনি তিন পরিকল্পনারই বাস্তব রূপায়ন দেখতে পাব বৈকুন্ঠপুর শিক্ষা নিকেতনের রেজাল্টের দিন সকালে প্রোগ্রেসিভ কোচিং সেন্টারের সৌজন্যে। অবাক বাপিদা কিছুক্ষণ অ-বাক থেকে আমাকে বলল, “বুদ্ধি বাতাসে ওড়ে।”
এপ্রিল প্রায় শেষ। সকাল-দুপুর বাপিদার বাড়িতে কমপিউটারে একটি পোস্টার তৈরিতে ব্যস্ত ছিলাম। বাপিদাই আমাকে দেখিয়ে দিচ্ছিল। এ-ফোর কাগজে আমাদের কোচিং সেন্টারের বিজ্ঞাপন। ঠিক হয়েছে, এর প্রিন্ট আউটের কপি পিচবোর্ডে আঁটকে আমরা বিভিন্ন বইয়ের দোকানে ঝোলাব। তাতে বই খাতা পেন কিনতে এসে ছাত্রছাত্রী অভিভাবকদের নজরে পড়বে সুচেতনা স্টাডি সেন্টারের কথা।
বিকেলে পড়াতে গেলাম পাপাইকে। পাপাই ক্লাস সিক্সে উঠল। পুরো ফাইভটা আমার পড়ানো। পাপাইকে পড়িয়ে যখন ফিরে আসব তখনই এক অপ্রত্যাশিত ঘটনার আঁচ পেলাম। রতনদা মানে পাপাইয়ের বাবা আমাকে বসতে বললেন। দেখলাম, রতনদা পাশের ঘরে কিছু আনতে গেলেন। বুঝলাম টাকা, আমার ফিস। পাপাইরা সাত-আট তারিখের আগে আমার মাইনে দেয় না। অতএব আশঙ্কা জাগল, অন্য কিছু ঘটতে চলেছে। কিন্তু পক্ষপাতী মন বলছিল আশঙ্কা ভুল। খানিক পরেই সংশয়ের অবসান। রতনদা আমার ফিস এগিয়ে দিয়ে বললেন, “সোমনাথ, আমি একজন ইংরেজির টিচার পেয়েছি। কিন্তু লোকটা একটু খ্যাপাটে, সে আবার অল সাবজেক্ট ছাড়া পড়াবে না।”
বললাম, “হ্যাঁ-হ্যাঁ, কোনও ব্যাপার না। আপনি ওনাকে দিয়েই পড়ান।” এছাড়া অন্য কিছু বললে নিজের দৈন্যই প্রকাশ পেত। মুখে যত সহজে কথাগুলো বললাম, বুকের মধ্যে তত সহজ অনুভব হচ্ছিল না। পাপাইকে আমি অঙ্ক ও বিজ্ঞান পড়াতাম। অঙ্ক বিজ্ঞান দুটোতেই ও আশি শতাংশের বেশি নম্বর পেয়েছে। তাও যদি আমার টিউশনি না থাকে কিছু বলার নেই। রতনদা আরও বললেন, “লোকটা খ্যাপাটে হলেও পড়ায় ভাল।”
বুঝলাম রতনদা আমার থেকে ওই লোকটির উপরেই বেশি ভরসা করছেন। রতনদার বাড়িতে সপ্তাহে দু’দিন এসে মাস গেলে সাড়ে তিনশো টাকা পাওয়া আমার আর হচ্ছে না। শুধু টাকাটাই ফ্যাক্টর নয়, পাপাই বুদ্ধিমান। ওকে আমি পছন্দ করতাম। পড়ার বই ছাড়াও গল্পের বই পড়ার দিকে ওর ঝোঁক। যারা সাহিত্য পড়ে, তাদের প্রতি আমার দুর্বলতা সহজাত। ভাবতে চেষ্টা করলাম, আমার আর কি কোনও দোষ ছিল? রতনদা আমাকে ছেলের জন্য একজন ইংরেজির টিচার ঠিক করে দিতে বলেছিলেন। আমি চেষ্টা করেছিলাম। পারিনি। সেটা কি দোষের মধ্যে পড়ে? রতনদা আমাকে আরও বললেন, “ভাই তুমি কিন্তু কিছু মনে কোরো না। আবার ক্লাস সেভেনে যদি তোমাকে দরকার পড়ে পাব তো?”
শেষের কথাটা রসিকতা, না আমাকেও হাতে রাখা— ঠিক বোঝা গেল না। বললাম, “যদি কোনও কাজ না থাকে নিশ্চয়ই পাবেন।”
ফিরে আসার সময় মনটা খচখচ করছিল। কত ইচ্ছা ছিল যে আমার রোজগার মাসে দু’হাজার হলে বাড়িতে টেলিফোন নেব। আর সেশনের শুরুতেই একটা টিউশনি চলে গেল। নকুলের দোকান থেকে বাপিদাকে ফোন করলাম। বাপিদা খবরটা শুনেই বলল, “অত ভেঙে পড়ার কিছু হয়নি। ডিজহার্টেনড্ হোস না। এক্ষুনি একটা খবর শুনলে তোর ভেঙে পড়া ভাব কেটে যাবে।”
কান খাঁড়া করে জিজ্ঞেস করলাম, “কী খবর?”
ওপাশ থেকে জবাব এল, “একজন ফোন করেছিল। তাঁর দুই মেয়ে পড়বে। একজন এইট, একজন নাইন। নবভারতীতে পড়ে।”
নবভারতী এ-অঞ্চলের নাম-করা স্কুল। সুর্যপুর বা নিবেদিতা আশ্রমের যে সব মেয়েরা দ্বিতীয় বারের চেষ্টাতেও নতুন ক্লাসে উঠতে পারে না, তারা টিসি পেয়ে নবভারতীতে ভর্তি হয়। স্কুল কর্তৃপক্ষ অপরাধ নেবেন না, একটি কথা খুব প্রচলিত— যার নেই কোনও গতি, সে-ই যায় নবভারতী। তা হোক গিয়ে, রোগীদের জন্যই তো ডাক্তার প্রয়োজন। সুস্থ মানুষ সারিয়ে তোলার কৃতিত্ব কোথায়?
বাপিদা বলল, “ওই ভদ্রমহিলা তাঁর দুই মেয়েকে নিয়ে সকালে এসেছিলেন। ছোটটা ব্যাপক দেখতে। ঝুলে যেতে পারি।”
“দেখবে মাথা মোটা।” আমি বললাম।
আমরা সাইকেলে যাচ্ছি কিংশুকদার বাড়ি। কিংশুকদার আমাদের প্রচারযজ্ঞে অংশ নিতে না পারার কারণ মায়ের অসুস্থতা ও অকালমৃত্যু।
প্রায় প্রত্যেকদিনই আমার তখন দেখা হয় বাপিদার সঙ্গে। লিফলেটের জন্য প্রেসে কী ম্যাটার যাবে—দু’জনে ঠিক করি। কখনও আলোচনার বিষয় আমাদের কোচিং কোন নিয়ম মেনে চলবে। আর পাঁচটা প্রজাপতি সেন্টারের মতো আমাদের কোচিং চালাব না এমন মৌখিক প্রতিজ্ঞাও করি।
একদিন সকালে বাপিদার বাড়ি গিয়ে দেখলাম, বাপিদার মুখ ভার। পাশে কাকিমা দাঁড়ানো। বললাম, “কী হয়েছে?”
“আরে কিংশুকের মা কাল মারা গেছে।”
কিংশুকদা বাপিদার খুব ভাল বন্ধু। আমার সঙ্গেও আলাপ হয়েছিল। বাপিদার মুখে কিংশুকদার কথা অনেক শুনেছি।
কিংশুকদার মা অসুস্থ জানতাম। দীর্ঘ একমাস পিজিতে ভর্তি থাকার পর বাইপাশ সার্জারি হয় দিন পনেরো আগে। গত পরশু হাসপাতাল থেকে ছুটি দেওয়া হয়। আশ্বস্ত হয়েছিলাম যে, যাক এত দিনে কিংশুকদার ঝুট ঝামেলা কাটল। আর ভেবেছিলাম একদিন কিংশুকদার মাকে দেখতে যাব। আর আজ একী শুনলাম!
কিংশুকদার বাড়ি বাঘাযতীনে। আমরা তিনজনই সেসময় সাইকেল চালাতাম। কিংশুকদার মা মারা যাওয়ার পরে সমবেদনা জানাতে ওদের বাড়ি আমি আর বাপিদা একদিন গেলাম। বেশ খানিকক্ষণ থাকলাম।
মে মাসের শেষে আমাদের কোচিঙের ছাত্রছাত্রীর সংখ্যা আট-দশ জনে গিয়ে দাঁড়াল। কিংশুকদাও মায়ের কাজ করে আমাদের কোচিঙে যোগ দিল। আমাদের প্রচারযজ্ঞ এবং চেনা পরিচিত মানুষজনের সুপারিশে আমাদের সেন্টারে ছাত্রছাত্রী এসেছে, যা আমাদের স্বপ্নের প্রদীপে তেলের যোগান দিল। আমরা ভাবতাম আমাদের কোচিঙের একদিন ব্র্যান্ড ভ্যালু হবে। স্টুডেন্ড একদিন উপচে পড়বে। আমরা সবাইকে নিতে পারব না।
কিন্তু বাস্তব সব সময় মানুষের ভাবনার পথে এগোয় না। স্বপ্নের দেয়ালে একদিন মনখারাপের ফাটল দেখা গেল, যা উত্তরোত্তর বাড়তে থাকল। বাপিদার সঙ্গে সম্পর্ক বেশ জমে উঠেছিল। ঘনঘন বাপিদার বাড়ি যাই। কখনও পড়াতে বা কোচিঙের প্রচার সংক্রান্ত কাজে, আবার কখনও স্রেফ আড্ডা মারতে। বাপিদার মাকে কাকিমা বলি, বাবাকে কাকু, তারা আমাকেও বেশ পছন্দ করতে লাগলেন। গেলে পরে চা, এটা-ওটা খেতে দিতেন। বাপিদাও মাঝেমধ্যে আমাদের বাড়ি আসত। এমনিতে আমাদের বাড়ি কেউ এলে অপ্রস্তুত হওয়ারই আশঙ্কা, কারণ সচ্ছলতার ছাপওয়ালা সাজানো-গোছানো বাড়ি তো আমাদের ছিল না, বরং উল্টোটা। কিন্তু তা সত্ত্বেও বাপিদার ক্ষেত্রে কোনও সঙ্কোচ ছিল না, যেন ঘরের লোক। দরিদ্র হলেও দারিদ্রের প্রকাশে আমার আপত্তি ছিল। একবার স্কুলে, তখন ক্লাস টেনে পড়ি। শ্রীগুরু আশ্রম থেকে দুঃস্থ ছাত্রদের খাতা, পেন দেবে বলে ক্লাসে এসে তড়িৎ স্যার ছাত্রদের মধ্যে থেকে নাম চাইলেন। সুজিত বলে একটি ছেলে আমার নাম প্রস্তাব করল। আমি তখন দুঃস্থের মধ্যেই পড়ি। আমাকে দেখেও তা মনে হওয়াই স্বাভাবিক। স্কুলব্যাগ কেনার সামর্থ ছিল না বলে প্লাস্টিকে করে বই নিয়ে যাই। একটিমাত্র স্কুলের প্যান্ট। কিছুদিন আগেও হাওয়াই চটি পড়ে স্কুলে যেতাম। কিন্তু ক্লাস নাইনে ওঠার পর সুবিমল স্যার হেড স্যার হয়ে কেডস পরে যাওয়া বাধ্যতামূলক করলেন। ফলে আমার হাওয়াই চটি পরে যাওয়া বন্ধ হল। কিন্তু তড়িৎ স্যারের কাছে সুজিতের প্রস্তাবের বিরোধিতা করলাম।
স্যার বললেন, “তোর তাহলে খাতা-পেনের দরকার নেই?”
বললাম, “না স্যার দরকার আছে, কিন্তু আমার মনে হয় আমার চেয়েও দুঃস্থ ছাত্র আছে।”
স্যার আর কোনও কথা বাড়াননি।
তো, যাইহোক অল্পদিনেই যেন বাপিদার পরিবারের একজন হয়ে গেলাম। বাপিদার মাসির বাড়ি বর্ধমানের সমুদ্রগড়ে। কালীপুজো উপলক্ষ্যে সেখানেও আমি, বাপিদা ও কিংশুকদা গেলাম। কাছেই গঙ্গার কাছে নবদ্বীপে গিয়ে পোড়া মা-তলা ও সোনার গৌরাঙ্গ দেখলাম। খুব আনন্দ হয়েছিল সেবার।
কিন্তু একটা জিনিস লক্ষ্য করে মনে অশান্তি বাড়ছিল। যে উদ্দেশ্যে বাপিদার সঙ্গে সম্পর্কের সেতুর সূচনা, তাতে যেন বাপিদার উৎসাহে ভাটা। যাকে দেখে আমি নিজেই উদ্বুদ্ধ হব ভেবেছি দেখি তারই মোটিভেশনের অভাব।
একটি নামী সংস্থা থেকে বাপিদা কম্পিউটার শিখেছে। হার্ডওয়ার ও সফটওয়ার দুটোই। ফলে সুচেতনা স্টাডি সেন্টার ছাড়াও বাপিদার নিজস্ব কিছু কম্পিউটারের ছাত্রছাত্রী ছিল। আর ছিল বাপিদার কম্পিউটার সংক্রান্ত কাস্টমার। বাপিদা কম্পিউটারের বিভিন্ন সরঞ্জাম এসেম্বল করে বিক্রি করত। ক্রেতাদের আবার পরবর্তী সার্ভিস দিতে বা কারও কম্পিউটার বিকল হলে সারাতে যেত। সেই সময় যদি আমি কাছে থাকতাম তবে আমাকেও বাপিদার সঙ্গে যেতে হত। আমি বাড়ি যেতে চাইলে বলত, “চল না, বেশি ক্ষণের তো কাজ না, বাড়ি গিয়ে কী করবি?”
বাপিদাকে বেশ পজিটিভ মনে হয়েছিল। ফলে সাহচর্য ভাল লাগত এবং মনে কষ্ট দিতে চাইতাম না বলে দৃঢ়ভাবে ‘না’ করতে বাধত। বাপিদার প্রয়োজনে এখানে ওখানে সঙ্গে যেতাম। কিন্তু উপলব্ধি করলাম যে লক্ষ্য থেকে সরে আসছি যেন, আমার সময় নষ্ট হচ্ছে। লক্ষ্যটা ছিল একসঙ্গে সরকারি চাকরির পরীক্ষার প্রস্তুতি। কিন্তু বাপিদার যেন সে ব্যাপারে উৎসাহে ভাটা।
ছোটনদার বাড়ি যেদিন গিয়েছিলাম ছোটনদার বাবা মানে জ্যাঠামশাই আমাকে এক উপদেশ দিয়েছিলেন। বলেছিলেন, “দেখিস বাঁশের চেয়ে কঞ্চি যেন বড় না হয়ে যায়।” অর্থাৎ লক্ষ্যের চেয়ে উপলক্ষ্য যেন বড় না হয়। আমার সেই উপদেশ মনে ছিল।
তবে বাপিদার কাছে আমার কৃতজ্ঞতার শেষ নেই। সরকারি চাকরির প্রিলিমিনারি পরীক্ষার উত্তর করার ব্যাপারে বাপিদা আমাকে মূল্যবান পরামর্শ দিয়েছিল। প্রিলির প্রশ্ন হত এম.সি.কিউ. ধাঁচের। প্রতি প্রশ্নের সঙ্গে প্রদত্ত চারটি সম্ভাব্য উত্তর এবিসিডি-র মধ্যে থেকে সঠিকটা বেছে নিয়ে উত্তরপত্র বা ও.এম.আর. শীটের ডিম্বাকৃতি অংশ ভরাট করতে হবে। ভুল উত্তরের জন্য নেগেটিভ মার্কিং আছে। আমি বাপিদার সঙ্গে মেশার আগে প্রশ্নপত্রের একেকটি উত্তর বেছে ও.এম.আর. শীটে একটা করে ওভাল কালি করতাম। ফলে সময় বেশি লাগত। বাপিদা বলল, “ও.এম.আর. শীটে ব্ল্যাকেন করার জন্য হাতে কুড়ি-পঁচিশ মিনিট রাখ। এবার প্রশ্নপত্র ভাল করে পড়ে কোন উত্তর হবে সেটা খুঁজে রাখ, পেন্সিল দিয়ে প্রশ্নপত্রে দাগা। অঙ্কের ক্ষেত্রে রাফওয়ার্ক করে উত্তরটা বার করে রাখ। শেষ কুড়ি-পঁচিশ মিনিটে প্রশ্নপত্র দেখে ও.এম.আর.-এ সঠিক উত্তরটা ব্ল্যাকেন করতে হবে। সময় বাঁচাতে চার-পাঁচটা প্রশ্নের উত্তর একেক বারে দেখেও কাজটা করা যায়।”
বাপিদার পরামর্শ ম্যাজিকের মতো কাজ দিল।
কিন্তু বাপিদার লক্ষ্যচ্যূতি আমার মনখারাপের প্রধান কারণ ছিল না। ক্লাস নাইনের তিন-চার জনের একটা ব্যাচ গড়ে উঠেছিল। তারা শুধু সায়েন্স পড়ত। খেয়াল করে দেখলাম এই ব্যাচটা আমাকে পড়াতে দেওয়া হচ্ছে না। শিক্ষাগত যোগ্যতায় আমি ওদের থেকে বেশি সে কথা না হয় বাদই দিলাম, কিন্তু আমার অন্যতম প্রিয় বিষয় অঙ্কের অন্তত একটি বিভাগ যেমন বীজগণিত, পাটিগণিত বা জ্যামিতি কিছুই পড়ানোর অধিকার নেই আমারই গঠিত কোচিঙের একটি গুরুত্বপূর্ণ ব্যাচে— এটা ভুলে থাকা আমার পক্ষে সম্ভব হল না।
যেকোনও কাজেই একজন টিমলিডার থাকলে কাজটা সফলভাবে এগোয়। আমাদের কোচিঙেও বাপিদা অলিখিত লিডার। ফলে বাপিদার সম্মতি ছাড়া আমার পক্ষে কোনও ব্যাচের বিশেষ কোনও বিষয় পড়ানো সম্ভব ছিল না। অথচ বহু ছাত্রছাত্রীকে আমি সায়েন্স পড়াতাম। স্পেশালিস্ট হিসাবে মাধ্যমিকে শুধুমাত্র অঙ্ক করানোর টিউশনিও আমার ছিল। ফলে এই মনখারাপের ফাটলে যেন ডিনামাইটের বিস্ফোরণ ঘটল। শুধুমাত্র টাকার কারণে অপমান হজম করে টিকে থাকা আমার ধাতে ছিল না। ফলে একদিন বাপিদাকে সরাসরি অনুরোধ জানালাম যে মাধ্যমিকের ব্যাচটাকে আমাকে অন্তত একটা বিষয় পড়াতে দেওয়া হোক। অঙ্কের কোনও একটা বিভাগ বা ভৌত বিজ্ঞান কিছু একটা দিলেই আমি খুশি। কিন্তু বাপিদা তাতে রাজি হল না। আমি কারণ জানতে চাওয়ায় বাপিদা যে উত্তর দিল তাতে আমার চোখ ফেটে জল এল। আমি বিজ্ঞান পড়ালে নাকি ছাত্রছাত্রীদের ক্ষতি হবে। অভিভাবকদের তরফ থেকে নাকি এই কথা বলা হয়েছে।
এই অপমান সহ্য করা আমার পক্ষে সম্ভব ছিল না। ফলে সুচেতনা স্টাডি সেন্টার ছেড়ে দিলাম। স্বাভাবিক ভাবেই বাপিদা, কিংশুকদা, বাপিদার পরিবারের সকলের সঙ্গই আমাকে ছাড়তে হল। প্রেমে বিচ্ছেদের মতনই অসম্ভব যন্ত্রণায় ক’টা দিন কাটল। ঠিক করলাম গ্রুপ স্টাডি ছাড়া আর কোনও যৌথ প্রয়াসে মাথা গলাব না। নিজে টিউশনি করব আর যে করেই হোক আমাকে একটা সরকারি চাকরি পেতেই হবে।
(আগামী সংখ্যায়)
********************************************************************************************************