মঙ্গলবার, ৩১ অক্টোবর, ২০২৩

লেখা আহ্বান

  




স্বরবর্ণ

সৃজনের মৌলিক স্বর


########################################

স্বরবর্ণ * ১৬ / শীত সংখ্যা-র জন্য লেখা জমা নেওয়া হবে ২০ নভেম্বর পর্যন্ত। পত্রিকা প্রকাশিত হবে ১৫ ডিসেম্বর ২০২৩ 

########################################


লেখা পাঠানোর আগে নীচের বিষয়গুলি নিশ্চিত হয়ে নিন 

---------------------------------------------------------------------------


১.  স্বরবর্ণ দ্বিমাসিক ওয়েব ম্যাগাজিন । 

২. লেখা মনোনয়নের ব্যাপারে সম্পাদকমন্ডলীর সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত।

৩. প্রাপ্তি সংবাদ জানানো সম্ভব নয়। নিৰ্বাচিত লেখকসূচি আমরা একমাসের মধ্যে ফেসবুকে প্রকাশ করি । 

৪.পরবর্তী  সংখ্যার জন্য আপনার মৌলিক ও অপ্রকাশিত লেখা ( গল্প কবিতা প্রবন্ধ  অণুগল্প  অনুবাদ কবিতা  ভ্রমণ কাহিনি  ইত্যাদি  ) ২০ নভেম্বর  ২০২৩- এর মধ্যে পাঠান । 

৫. শব্দসীমা অনির্দিষ্ট। 

৬. কবিতার ক্ষেত্রে কমপক্ষে দুটি কবিতা পাঠাবেন।  

৭. লেখার সঙ্গে আপনার একটি ছবি এবং সংক্ষিপ্ত পরিচিতি, প্রকাশিত গ্রন্থ (থাকলে)  ছবিসহ পাঠান । 

৮. "স্বরবর্ণ " সামগ্রিক চিন্তার ফসল। আগে থেকে লেখা পাঠান। লেখা পাঠাবেন ওয়ার্ড ফাইলে, হোয়াটসঅ্যাপ কিংবা ই-মেইল বডিতে টাইপ করে। পিডিএফ বা লেখার ছবি তুলে পাঠাবেন না।


* হোয়াটসঅ্যাপ নম্বর   8777891532

*ই-মেইল --- debasishsaha610@gmail.com 


সম্পাদকমণ্ডলী                                             

ড : শুভঙ্কর দে           অলোক কোৱা

সৌম্যজিৎ দত্ত             দেবাশিস সাহা

শনিবার, ২৮ অক্টোবর, ২০২৩

পাঠকের মতামত: শারদীয় ১৪৩০ স্বরবর্ণ * ১৫




শারদীয় স্বরবর্ণ * ১৪৩০ সংখ্যাটি কেমন হল ? কী বলছেন সুধী পাঠকমন্ডলী ? এ বিষয়ে ব্লগে অনেকেই মতামত দিয়েছেন। আবার ব্লগে স্বচ্ছন্দ না হওয়ায়, অনেকে সম্পাদকের হোয়াটসঅ্যাপ নম্বরে মতামত জানিয়েছেন। ফোনেও অনেকে অভিমত ব্যক্ত করেছেন। তাছাড়া, এ সংখ্যার কবি-লেখকেরা অনেকেই তাঁদের নিজস্ব ওয়ালে সংশ্লিষ্ট লেখাটি শেয়ার করেছেন। সেখানেও অনেকে মতামত দিয়েছেন। সুচিন্তিত মতামত দেওয়ার জন্য সকল পাঠককে জানাই আন্তরিক ধন্যবাদ।

পাঠকের মতামত শিরোধার্য করে আমরা ক্রমান্বয়ে সেগুলি প্রকাশ করব । আজ পাঠ প্রতিক্রিয়ার প্রথম পর্ব -----


কল্যাণ ভট্টাচার্য লিখেছেন   অসম অসাধারণ একটি পত্রিকা। আর কী ভীষণ যত্নশীল এর সম্পাদক। কোনো অভিনন্দনই যথেষ্ট নয়। আমি ধরে ধরে পড়লাম। জাস্ট মুগ্ধ।

শ্রীদাম কুমার লিখছেন   দেবাশিসদা, স্বরবর্ণ পত্রিকাটি দেখলাম ৷ খুব সুন্দর হয়েছে। শারদীয়ার উপহার হয়ে মন ভালো করে দেয় ৷ দাদা অনেক অনেক শুভেচ্ছা অভিনন্দন । প্রণাম নেবেন। ভালো থাকবেন। সম সময়ের যন্ত্রনার দিনলিপিকে ছুঁয়ে  সম্পাদকীয় অভিনব হয়ে উঠেছে ৷ কবিতার বিভায় প্রাণময় অন্তরস্পর্শী ...

চিন্ময় ঘোষ শতদল মিত্রের 'মায়াগাছ' গল্পটি পড়ে লিখেছেন   গল্পটি পড়লাম। গল্পের চলনে গদ‍্যাকারে হলেও একটি কাব‍্যিক ঢং সুন্দর গড়িয়ে নিয়ে যায়। শব্দ, বাক‍্যবিন‍্যাস এবং চরিত্র চিত্রায়ণে একান্ত যা শতদলময় নিজস্বতার শৈলী। ভাল লাগল।

কাজী নুদরত হোসেন গৌরীশঙ্কর দে-র কবিতা পড়ে লিখছেন  সুন্দর দুটি কবিতা। সমসাময়িক বিষয়কে ভাবনার কেন্দ্রে রেখে কবি গূঢ়তর ভাবকে অনবদ্য কাব্যরূপ দিয়েছেন।

আশিস সরকার চন্দন রায়-এর কবিতা পড়ে লিখেছেন   সকাল বেলাতে অসাধারণ দুটো কবিতা পড়লাম। দিনটা ভালো হয়ে গেল।  কী সুন্দর করে ছাপিয়েছেন কবিতা, সম্পাদককেও আন্তরিক ধন্যবাদ জানাই।

অগ্রজ কবি পঙ্কজ মান্না লিখছেন   কবি তপন পাত্রের আঞ্চলিক ভাষায় লেখা রুখা শুখা পুরুলিয়া জেলার কৃষি জীবনের বাস্তবতা চমৎকার । কবি পার্থ প্রতিম গোস্বামীর কবিতা এক কথায় অসাধারণ, ভাবে ভাষায় পরিমিতিবোধে এবং লাবণ্যময় কাব্যিকতায় আমার চমৎকার লেগেছে।  কবি শ্রীদাম কুমার -এর 'ছায়াগাছ' কবিতার ২ নম্বরটিতে  শেষ দিকে যে চিন্তার বাঁকবদল আছে,তা সত্যবোধের আলোয় ভাস্বর। আর 'স্তাবকতা ' -'কাঁখে কলসির মতো দাঁড়িয়ে ফুলদানি 'একটি অসাধারণ চিত্রকল্প,কবির কল্পনার দৌড় দেখে বিস্মিত হয়ে গেছি।

কেতকী বসু অ-নিরুদ্ধ সুব্রত-র কবিতা পড়ে জানাচ্ছেন  দু'টি লেখাই পড়লাম। অসাধারণ গভীরতা ছুঁয়ে গেলো মনে।

কিঙ্কর দাস লিখছেন নিমাই জানা-র কবিতা পড়ে  দুটো কবিতাই অসাধারণ...এমন কবিতা পড়ে মুগ্ধ হয়ে যেতে হয় 

নির্মল দেবনাথ লিখছেন চন্দ্রাণী গোস্বামীর কবিতা সম্পর্কে  বাহ্ অপূর্ব কবিতা। প্রতিটি লাইনে যেন... আলাদা উপলব্ধি ও অপূর্ব  আলোর অন্বেষণ।

কবি শুভ্রনীলের 'নক্ষত্র রঙের আত্মহত্যা' বইটির আলোচনা করেছেন দেবার্ঘ সেন। ভুবন ডাঙা ওয়েব পাবলিকেশন সেটি পড়ে জানাচ্ছেন   খুব সুন্দর আলোচনা। আলোচনা এমন যে বইটির প্রতি স্পৃহা বাড়িয়ে তুললো। ভালোবাসা দেবার্ঘ ও শুভ্রনীলকে।

রুমা ঢ্যাং অধিকারীকৃত অক্টাভিও পাজের কবিতার অনুবাদ প্রসঙ্গে রুদ্র শংকর ভট্টাচার্য লিখেছেন  অনুবাদও স্বতন্ত্র কবিতা মনে হচ্ছে...অনুবাদের এর চেয়ে ভালো চরিত্র আর কী হতে পারে।

অরিত্র দ্বিবেদীর প্রতিক্রিয়া সব্যসাচী মজুমদারের কবিতা পড়ে  মারাত্মক! Charlie Kaufman, এর কথা মনে পড়ে গেল! কী অসামান্য! ওঁর দুটো বিখ্যাত script এর বিখ্যাত দুটো লাইন, যেমন সহজতর, তেমনি আমাদের জটিলতা খুলে রেখে দেয়! আশ্চর্য হচ্ছে যে সে দুটোই ওই দৃশ্যের প্রথম লাইন "And its grey...""Nothing is as emptier as an empty swimming pool.,"

পলাশ দাসের অণুগল্প 'পিছন ফিরে তাকাই' পড়ে সমাজ বসু লিখেছেন   সুন্দর একটা বাস্তব ছবি। সৎ ও ভদ্র মানুষের এক অস্বস্তিকর পরিস্থিতির বর্ণনা ভালো লাগলো।

দেবদাস রজক মায়াবী প্রভাত ভট্টাচার্যের অণুগল্প পড়ে লিখছেন  দুর্দান্ত ভাবনা। সিন্ধু সভ্যতার যুগে ওটাই ছিল আরাম। ঘড়ি ছিল না। একই গল্প সম্পর্কে প্রদীপ ঘোষের অভিমত: ভালো লাগলো। তবে অণুগল্প বোধহয় নয়, একটি মুক্তগদ্য।

দেবাশীষ মুখোপাধ্যায়ের অণুগল্প পড়ে দীপক বসু জানাচ্ছেন  দারুণ সাহিত্য অলংকারে সজ্জিত লেখনি। আপনাকে ধন্যবাদ। লিখে যান। 

তনুজা চক্রবর্তী শুভাশিস ঘোষের অণুগল্প পড়ে লিখছেন  চমৎকার লিখেছেন 'লেডিকেনি' গল্পটি!

শতদল মিত্র দেবাশিস সাহার গল্প পড়ে লিখছেন  আপনার গল্পটা আমার খুব ভালো লেগেছে। বর্তমান পৃথিবীর যুদ্ধ-হত্যা, তার বিপরীতে চৈতন্যের প্রেমময় সহজিয়া প্রতিরোধ... একটা বার্তা দিল। গল্পের গঠনও চমৎকার।



বুধবার, ৪ অক্টোবর, ২০২৩

প্রিয় কবি লেখক এবং পাঠকদের প্রতি

 



স্বরবর্ণ

সৃজনের মৌলিক স্বর

স্বরবর্ণ * ১৫  শারদীয় * ১৪৩০  

###########################

সংখ্যাটি সম্পর্কে আপনার মূল্যবান মতামত আমাদের অকপটে জানান । প্রাপ্ত মতামতগুলি আমরা ক্রমান্বয়ে প্রকাশ করব ২৫ অক্টোবরের পর থেকে । স্বরবর্ণ * ১৬ * শীত সংখ্যা-র জন্য লেখা জমা নেওয়া হবে নভেম্বর ৩১ তারিখ পর্যন্ত।

############################


লেখা পাঠানোর আগে নীচের বিষয়গুলি নিশ্চিত হয়ে নিন ---------------------------------------------------------------------------


১.  স্বরবর্ণ দ্বিমাসিক ওয়েব ম্যাগাজিন । 

২. লেখা মনোনয়নের ব্যাপারে সম্পাদকমন্ডলীর সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত।

৩. প্রাপ্তি সংবাদ জানানো সম্ভব নয়। নিৰ্বাচিত লেখকসূচি আমরা একমাসের মধ্যে ফেসবুকে প্রকাশ করি । 

৪.পরবর্তী  সংখ্যার জন্য আপনার মৌলিক ও অপ্রকাশিত লেখা ( গল্প কবিতা প্রবন্ধ  অণুগল্প  অনুবাদ কবিতা  ভ্রমণ কাহিনি  ইত্যাদি  ) ৩১ নভেম্বর  ২০২৩- এর মধ্যে পাঠান । 

৫. শব্দসীমা অনির্দিষ্ট। 

৬. কবিতার ক্ষেত্রে কমপক্ষে দুটি কবিতা পাঠাবেন।  

৭. লেখার সঙ্গে আপনার একটি ছবি এবং সংক্ষিপ্ত পরিচিতি, প্রকাশিত গ্রন্থ (থাকলে)  ছবিসহ পাঠান । 

৮. "স্বরবর্ণ " সামগ্রিক চিন্তার ফসল। আগে থেকে লেখা পাঠান। লেখা পাঠাবেন ওয়ার্ড ফাইলে, হোয়াটসঅ্যাপ কিংবা ই-মেইল বডিতে টাইপ করে। পিডিএফ বা লেখার ছবি তুলে পাঠাবেন না।


* হোয়াটসঅ্যাপ নম্বর   8777891532

*ই-মেইল --- debasishsaha610@gmail.com 


সম্পাদকমণ্ডলী                                             

ড : শুভঙ্কর দে           অলোক কোৱা

সৌম্যজিৎ দত্ত             দেবাশিস সাহা

ভ্রমণ কাহিনি * শ্যামল চক্রবর্ত্তী সবুজ





ব্যাঘ্রতটে সুন্দর বনের আতঙ্ক

শ্যামল চক্রবর্ত্তী সবুজ


সুখেন --   মণ্টা--আ, সোমবার সুন্দর বনে বাঘ দেখতে যাবো। যাবি ?

যাবো ---

সুন্দরবন মানেই শিহরণ।  সুন্দরী গড়ার হেতাল গাছের গভীর অরণ্য সঙ্গে বাঘ কুমির গোসাপের আনাগোনা।

সোমবার সকালে যথারীতি, গাড়িতে করে আমরা চারজন রওনা দিলাম সুন্দরবনের উদ্দেশ্যে।  মেট্রোপলিটন বাইপাস ধরে গাড়ি এগিয়ে চললো । বারইপুর কুলপি রোড ধরে পাশেই ছিল কৃষ্ণমোহন হল্ট স্টেশন, লাইন ক্রস করেই বারইপুর-কুলপি রোড-গড়িয়া । আবার পেলাম জয়নগর রোড, আবার পাশে নিমপীঠ রামকৃষ্ণ মিশন, বকুলতলা, কানকাটার মোড় ,নতুন বাজার ,জামতলা হয়ে কৈখালী। কুলতলী রোড হয়ে পেটকুল চাঁদ ব্রিজ পেলাম। কিছুটা পৌছে মৈপীঠ  রাস্তা ধরলাম। মৈপীঠ কোস্টাল পুলিশের সহায়তায় অম্বিকা নগর হয়ে, সোমবারের বাজার পৌঁছানোর সৌভাগ্য জুটলো। সত্যিই সৌভাগ্য কারণ বর্ষাকাল, সরু রাস্তা, ঘন অরণ্য সঙ্গে বৃষ্টি।

ওখান থেকেই লঞ্চে  যাত্রা শুরু।

--- বর্ষাকালে মাতলা নদীর পার হয়ে যেতে হলো। তবে লঞ্চ থাকায়, মাতাল করা নদীতে যাওয়ার কোন আভাস ই পেলাম না।

কি মনোরম পরিবেশ কি মনোরম আবহাওয়া, বলে বোঝানো যাবে না। আর মনের মধ্যে শিহরণ জাগছে, আশেপাশ থেকে গল্প করছে যে,  সামনের দ্বীপ গুলো থেকে বাঘ নাকি সাঁতার দিয়ে চলে আসার সম্ভাবনা আছে। ভয় লাগছিল , বাঘ মামা এসে পড়বে না তো।

লঞ্চের সহায়ক বলে উঠলো---হ্যাঁ সামনের দিক দেখছেন দ্বীপ-- , ওখান থেকে   অনায়সে সাঁতার দিয়ে চলে আসার সম্ভাবনা আছে বাঘ মামার।

কিন্তু হলে কি হবে। ওরা কিন্তু পিছন পায়ে ভর দিয়ে  উঠার সম্ভাবনা নেই।

Newton's third law,তখন বুঝলাম আচ্ছা আচ্ছা, অর্থাৎ পিছন পায়ে ভর দেওয়ার মতন কোন তো সাপোর্ট নেই।আমাদের খেয়ে ফেলার ও সম্ভাবনা একেবারে নেই বললেই চলে।

সুখেন, ওই  তো এটাই বনী ক্যাম্প ঐতো সামনে লেখা। পৌঁছে গেলাম।

আমরা তো চিড়িয়াখানা অনেকেই গেছি। ওখানে পশুদের খাঁচায় বন্দি করে রাখা হয়, যাতে করে বাঘ বেরিয়ে আসতে না পারে। কিন্তু এই বনী ক্যাম্পে মানুষকে খাঁচায় বন্দি করে রাখা হয়, বাঘ ভেতরে ঢুকতে না পারে। এই বনী ক্যাম্পের ভেতর একটু ৫০ ফটের ওয়াচ টাওয়ার আছে, দূরে একটি মিষ্টি জলের পুকুর আছে, ওইখানে বাঘেরা জল খেতে আসে, হরিণ ও জল খেতে আসে । সত্যিই হরিণের সামনে থেকে দেখতে পেলাম।

এই ক্যাম্পের আসল নাম  সুন্দরীকাটি ইকো কনজারভেশন ক্যম্প (আজমলমারী)। এটা সূর্যদ্বীপে অবস্থিত।

২০০৩ সালে ১৫ই জুলাই বিখ্যাত সাহিত্যিক মাননীয় শ্রীযুক্ত বুদ্ধদেব গুহ এর নামকরণ করেন বনী ক্যাম্প। ক্যাম্পের অভ্যন্তরে চারিদিকে সুন্দরী গাছের ছড়াছড়ি। হ্যাঁ এই সুন্দরী গাছ থেকেই সুন্দরবনের নামকরণ হয়েছে।কিছুর অপেক্ষা না রেখে , অবকাশ নষ্ট না করে, ক্যামেরা নিয়ে উঠে পড়লাম ওয়াচ টাওয়ারে। তার আগে সামান্য চা জল খাবার খেয়ে নিয়েছি। হাতের নাগালে ছিল বাইনোকুল,  দূরের সবুজ জঙ্গল গভীর অরণ্যে  চোখ যেতেই দেখি একপাল হরিণ দৌড়াচ্ছে! সে কি অপূর্ব দৃশ্য।  পাসেই পুকুর মিষ্টি জল খেতে চার-পাঁচটা কুমির ছানা এসে হাজির।

মুঠোফোনে কিছু ছবি ধরে রাখার চেষ্টা করলাম। চলমান ছবি তুললাম একপাল হরিণ দৌড়ে যাচ্ছে।

পাখির আওয়াজ এপাশ-ওপাশ যেন মাতাল করে দিল।মহীরুহ গাছ তেমন চোখে পড়ছে না ।আমাকে

সুখেন -প্রস্তুত হতে বলল ছোট ডিঙি নৌকায় আশেপাশের  যাবার জন্য।

একজন রেঞ্জার অফিসার, আমরা চার বন্ধু, বনী ক্যাম্পের গেটের সামনে এসে দেখি জলের স্তর নিচে নেমে গেছে। দূরের ওপারে দেখলাম যেন মৃত কুমির শুয়ে আছে। আমার সঙ্গী লেন্স দিয়ে সেই জীবন্ত কুমিরের ছবি তুলল। আবার বলল দেখুন ওই যে, ওইগুলো হেতাল গাছ। ওখানে বাঘ লুকিয়ে থাকলে বোঝা যাবে না।

সত্যি তো হেতাল গাছটা ঠিক দেখতে যেন খেজুর গাছের মতো লম্বা লম্বা পাতা। কিছুটা হলুদ হলুদ সবুজ।

এবার আমারা লঞ্চে উঠলাম। চায়ের বন্দোবস্ত সঙ্গে টিফিন খেয়ে নিলাম। লঞ্চ এগিয়ে চললো  টলটল করছে জল । সুন্দরবনের পরিবেশ আবহাওয়ার  দ্বীপ ঘুরে দেখলাম। একটা মস্ত বড় টাওয়ার। যেখানে দূষণ পরিমাপ  স্বয়ংক্রিয় ভাবেকরা হয়।

আবার কয়েক ঘন্টা লঞ্চে যাত্রা করে পৌঁছলাম কলস দ্বীপে। চারিদিকে ইতস্তত অনেক ছোট ছোট ভটভটি নৌকা। কিছু মানুষজন আসেছে কাঁকড়া ধরতে।

ওই দিনেই, কিছুক্ষণ আগে ঘটে যাওয়া ভয়ংকর দুর্ঘটনা, স্বামী-স্ত্রী ধরতে এসেছিল কাঁকড়া, মনোসংযোগ ছিল  কাঁকড়া ধরার দিকে। অতর্কিতে জঙ্গল থেকে ঝাঁপ দিয়ে লোকটার ঘাড়ে আঘাত করে।  যা শেষ পরিণতি তাই হলো। লোকটা ফিরতে পারল না বাড়িতে। ধড়টা পড়ে থাকলো।

যাই হোক এইভাবে ফিরে এলাম বনী ক্যাম্পে। এবার , বিকেল হতেই ছোট যন্ত্র চালিত নৌকা 

যাওয়ার জন্য প্রস্তুত হলাম। সময়টা ঠিক সন্ধে সাড়ে ছটা। ভুটভুটি নৌকার ,সহায়ক এর হাতে বন্দুক, সার্চলাইট আমার কয়েক বন্ধুর, হ্যাঁ, বাঘ দেখার নেশায়। এক ভয়ঙ্কর নেশা।

সঙ্গে সুখেন, দুখেন ,রঞ্জু ,ও বনি  তারা বাঘ দেখবে।  ছোট্ট ডিঙি নৌকা চলতে শুরু করলো, আকাশটা আধখানা গোল ঘন অন্ধকার। নক্ষত্র খচিত । রাতের আকাশে নক্ষত্র গোনা যাচ্ছে। আর জল টলটল করছে। চাঁদনী রাত। প্রায় এক ঘন্টা চলার ঘন জঙ্গলের দেখা মিলল। ৫০০ ফিট দূরে, এবার ডানদিকে বাঁদিকে খারি সরু। সার্চলাইট যেটা বড় টর্চ বলা যেতে পারে, দুজন ধরে আছে। একজন ডানদিকে আর একজন বামদিকের বালুচরে। কোন সময় বাঁদিকে দেখি কোন সময় ডানদিকে দেখছি, সার্চলাইট টা এত জোর দূরের ঘন জঙ্গলের কিনারা দেখা যাচ্ছে। হেতাল-সুন্দরী গাছের কিছু কিছু অংশ বোঝা যাচ্ছে। খালি মনে হচ্ছে এই বোধহয় বাঘ দেখা যাচ্ছে। দূরের দিকে দেখি ,চোখ জ্বলজ্বল করছে জলের মধ্যে। ওরে, এ তো  কুমির হ্যাঁ। কাছে গিয়ে ভটভটি  শব্দে  দেখি ডুবে গেল নিচে। ঘন অন্ধকার আবার সুখেন-দুখেন সবাই বলে আরেকটু ভেতরে যেতে। খাড়িতে জল কম রয়েছে বালুচর, খানিকটা নিচে নেমে এসেছে। যেন ভাটা মনে হচ্ছে। অন্ধকারের  টর্চের ফোকাসে দেখা যাচ্ছে অনেক কিছু কাঁকড়া, পার্সে মাছের ঝাঁক।

দুখেন বলে উঠলো-আরে ভটভটির মেশিনটা বন্ধ করে দিন ।শব্দ করলে বাঘ আসবে না। সত্যি সত্যিই বন্ধ করে দিল।

আবার সুখেন --বলে উঠলো সাজলাইট গুলো  বন্ধ করে দিন। সত্যি সত্যি সাজলাইট দু ,তিন মিনিটের জন্য বন্ধ রেখে দিল। এক ভয়ঙ্কর অবস্থা।ভটভটির শব্দটা মনের মধ্যে খানিকটা সাহস যুগিয়ে ছিল। এমনিতেই ছোট ডিঙ্গি নৌকা। আবার ঘন ঘুটঘুটে অন্ধকার। আবার জলের মধ্যে একটা শব্দ হচ্ছে। ভাবলাম কি? মাছের লাফিয়ে ওঠা শব্দ! নাকি কিসের শব্দ? কিংকর্তব্যবিমূঢ় অবস্থা।মনের মধ্যে ভয়ের সঞ্চার হচ্ছে। ভাবছি না এলেই ভালো হতো। কারো চোখের সামনে ঘটে যাওয়া সেই কলস দ্বীপের বাঘের দুর্ঘটনা না ঘটনা যাই হোক, খালি খালি মনে পড়ছে। এদিকে ছোট  ভটভটি টা, জল কম থাকায় বালুচরে আটকে গেল।

তখন মনে হতে লাগলো , এখানে প্রাণ যাবে না তো! মরতে কেন যে এসেছিলাম। সুখেন আস্তে আস্তে বলছিল, মন্টা ও রঞ্জুর ভাগ্য যদি ভালো থাকে তাহলে বাঘ দেখতে পারবো। এটা কি ভাগ্য ভালো হওয়ার লক্ষণ?

আবার মাঝে মাঝে সার্চ লাইট অন করে,   ক্যামেরা তাক করে রইল, বাঘের ছবি তুলবে।

শব্দ নেই-- । এই ঘন অন্ধকার। আমি বলে উঠলাম না না লাইট জ্বালিয়ে দিন। ভটভটির শব্দটা মনের মধ্যে খানিকটা সাহস যুগিয়ে ছিল। খাড়ির মধ্যে ছোট নৌকাটা আটকে গেছে, জল কম। চালক, বাঁশটা দিয়ে বালুচরে ক্রমশ শক্তি প্রয়োগ করে আপ্রাণ চেষ্টায় জলের মধ্যে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করল।  ভয়ে আঁতকে উঠলাম । হাত পা ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছিল । আমি বলে উঠলাম নানা আর বাঘ দেখার দরকার নেই । ভটভটি মেশিন অন করে দিন। তাড়াতাড়ি নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা করুন। গুরু গম্ভীর সংকট মুহূর্ত যেন। হাসাহাসি করুক না কেন, মনের মধ্যে  কয়েকজনের ভয়ের উদ্রেক হলো। পৃথিবীতে এসেছি অনেক কিছুই বাকি রয়েছে।শেষ হয়ে যাবে নাকি ? যাইহোক সঙ্গে সঙ্গেই ঘুরিয়ে ফেলল ছোট্ট নৌকা। এবার মনটা আনন্দে ভরে উঠলো। বাঘ মামা খেলতে পারবে না। এবার তো বেঁচে গেলাম। এইতো চলতে শুরু করলে একটু দূরেই, একটা হালুম হালুম শব্দ যেন কানে আসছে। কি বীভৎস গর্জন। ভাবুন ! ভাবলাম , সুখেন যদি বলে সুন্দরবন আসার কথা। আর কোনদিন আসবো কিনা ভেবে দেখবো। আবার ঘন্টাখানেক ওই অন্ধকারের মধ্যে দিয়ে ভটভটি ফিরে এল বনী ক্যাম্পে। পরের দিন, দিনের বেলা আবার দশটা নাগাদ বেরোলাম বৃষ্টির মধ্যে। ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি। চারিদিকে মেঘাচ্ছন্ন যেহেতু বর্ষাকাল। স্বয়ংক্রিয় স্থির চিত্রে স্মৃতি ধরে রাখার চেষ্টা করলাম। এই ঘটনা আমার মনে সারা জীবন ভয়ের স্মৃতি হয়ে থেকে যাবে।


**********************************************************************************************



শ্যামল চক্রবর্ত্তী সবুজ

কবি পরিচয় : কবি শ্যামল চক্রবর্ত্তী, জন্ম মধ্যমগ্রামে।
১৯৭৩ সানে,১৫ ই আগস্ট। পিতা  ৺সনৎ কুমার চক্রবর্ত্তী,
 মাতা নীলিমা চক্রবর্ত্তী। বিজ্ঞানে স্নাতক(অঙ্ক)।
মস্তিষ্কে অঙ্ক  গিজগিজ করছে। হার্মনিকা, আড় বাঁশি
বাজাতে ভালোবাসেন।
সাহিত্যকর্ম: 'অপেক্ষারা আপেক্ষিক'- প্রকাশিত বই।  
2022 ও 2023 বই মেলায়ায় যৌথ কবিতার বই
 'কবিতার সাতকাহন' প্রকাশিত হয়েছে । পথের সুজন ,
 লিটল ম্যাগাজিনের  লেখক ।
ছোটগল্প  ধারাবাহিক গল্প লিখেছেন।
 দুটি কবিতা প্রকাশিত হয়েছে।" দিশা শারদীয়া সংখ্যা",
"নীরব আলো শারদীয়া সংখ্যা"," সাজের বেলা শারদীয়া সংখ্যা",।
"প্রভাতী সাহিত্য পত্রিকা", "আকাঙ্ক্ষা শুভঙ্কর শারদীয় সংখ্যা", 
"লেখাঘর সাহিত্য পত্রিকা( শারদীয়া সংখ্যা)", "উজান শারদ সংখ্যা'', 
"সমান্তরাল সাহিত্য পত্রিকা","বাঁকুড়ার নীরব আলো" ইত্যাদি কবিতা এবং গল্প প্রকাশিত হয়েছে।
এছাড়াও অনলাইন অসংখ্য পত্রিকায় , এবং প্রতিলিপি, শপিজেনে নিয়মিত লেখক।
কয়েকটি বিখ্যাত কবিতা "সৃষ্টি সুখের উল্লাসে ভবঘুরে", "প্রভাতফেরির সূর্য পাহাড় চিরে করছে উপাসনা",
"নির্জন সমাজ", "অপেক্ষা ","অপেক্ষার দিন গোনা", "মধ্যবিত্তের সংজ্ঞা", "করুনার সাগর বিদ্যাসাগর"। এ ছাড়াও তার লেখা অসংখ্য ছোট গল্প, কবিতা কৃষ্টি সৃষ্টির সম্ভার।


ভ্রমণ কাহিনি * কল্পোত্তম


 


ত্যাগ

কল্পোত্তম


পুজোর আগে কলকাতা যাবি?------নির্মলদা একথা বলতেই আমি জিজ্ঞেস করি-----কেন?

         তিনি বলেন,"তোর যদি কাজ না থাকে, একবার গিয়ে ফিরে আয়। আমার একটু উপকার হবে। কালীদা, স্বপনদা, ঝুপ্পিদি, দুর্গাদা এদের সঙ্গে দেখা করবি। বইপত্র, চিঠি যা দেবে নিয়ে আসবি। দুর্গার কাছে বেশ কিছু পুরনো জামা কাপড়ও রয়েছে। পারলে নিয়ে আসিস। পুজোর সময় গরিব মানুষদের দেওয়া যাবে। কত মানুষ তাকিয়ে থাকে। প্রতিবছর দিই। চেয়েও নিয়ে যায় অনেকে। না দিতে পারলে খারাপ লাগবে।

          গেলে তোরও উপকার হবে। আলোপৃথিবীর শুভদীপ সেনশর্মা, মৌমিতা এদের সঙ্গে দেখা করবি। তোর বইটা করছে যখন, দেখা করলে ভালো লাগবে ওদের। সময়টা জেনে নিবি দেখা করার। ফোন করে না গেলে পাবি না। নানা কাজে ব্যস্ত থাকে সবসময়।

       হেমন্তের(কবি হেমন্ত বন্দ্যোপাধ্যায়) সঙ্গেও দেখা করিস। সত্তরের কবি অরণি বসু হেমন্তকে তোর বিষয়ে বলার পর দেখা করতে চেয়েছে। আমার পান্ডুলিটা সেই করে দিচ্ছে। যেটা তুই জেরক্স করে দিলি। আমার ব্লগের লেখাগুলো।"

------বাড়ি কোথায় ওনার?

       আমি জিজ্ঞেস করতেই নির্মলদা জানান------দক্ষিণেশ্বর।

-------সে তো অনেক দূর। সম্পূর্ণ উল্টোদিকে। সেখান থেকে ফিরতেই বেলা হয়ে যাবে। 

-------তোকে একটা প্রোগ্রাম করে নিতে হবে। কার সঙ্গে কখন দেখা করবি সেটা ঠিক করে নিয়ে সেইভাবে এগোতে হবে। না হলে শেষ করতে পারবি না। সম্ভব হলে অনুবর্তনের অনির্বাণ ধরিত্রীপুত্রের সঙ্গেও দেখা করিস। ওরও তোকে নিয়ে উৎসাহ। দেখা করলে ভালো লাগবে। তবে যাওয়ার আগে ফোন। না হলে পাবি না । তোর হোয়াটসঅ্যাপ নাম্বারে ওর তিনটে নাম্বারই পাঠিয়ে দিয়েছি। একটাতে না ধরলে অন্যটাতে করবি। তিনটার কোনোটাতে ধরবেই।

-------ঠিক আছে।

        আমি উত্তর দিয়ে নির্মলদার বুক সেলফের দিকে তাকিয়ে থাকি। নির্মলদা মাথা নিচু করে কিছু একটা লিখতে লিখতে বলেন,"আমার কাছে ভাড়া নিয়ে নিস। আগেই রিজার্ভেশন করে নিলে অসুবিধা হবে না।

          পুজোর সময় তো। অনেক মানুষ যাতায়াত করেন। অনেক ভিড়। আগে থেকে রিজার্ভেশন না করলে পাবি না। আজকেই বাড়িতে গিয়ে রিজার্ভেশন করে নিস।"

          আমি নির্মলদার দিকে নজর ঘুরিয়ে বলি-----দেখা যাক। রিজার্ভেশন করে নেওয়ার চেষ্টা করবো। না পেলে বাসে গেলেও হবে।

          আমার উত্তর শুনে বলেন,"বাসে ঘুম হবে না। গিয়ে পরের দিন ঘুরতে পারবি না। উত্তর থেকে দক্ষিণ, অনেক জায়গায় ঘুরতে হবে।

         কবে যাবি, দিনটা ঠিক করে নে আগে। সেটা ঠিক হলে সেই ভাবে প্ল্যান করবো।"

         ২১ সেপ্টেম্বর রিজার্ভেশন হয়ে যায়। ২১ তারিখ রাত্রে গিয়ে ২৪ তারিখ ফেরা। সেটাও রাত্রে, সিকেপি ধরে। রাত দশটার মধ্যে হাওড়া স্টেশন। ১২টা ৫-এ ট্রেন।

         ট্রেনের টিকিট কাটা হয়, ট্রেনে চাপা হয় না। ২০ তারিখ সকাল থেকে শুরু হয় কুড়মিদের ট্রেন অবরোধ। পুরুলিয়ার ছররা, ঝাড়গ্ৰামের খেমাশুলিতে আটকে দেওয়া হয় ট্রেন। স্তব্ধ হয়ে যায় ট্রেন চলাচল। বন্ধ হয়ে যায় যাতায়াত। টানা ৫ দিন চলে অবরোধ। টিকিট ক্যানসেল করতে হয় আমাকে।

          অগত্যা বাসে যাওয়া। কিন্তু তারও কী কম হেপা? ট্রেন না চললে বাসের যা অবস্থা সে তো জানা কথা। পা রাখার জায়গা নেই বাসে! শেষমেশ নিজের রুট বলরামপুর, বাগমুন্ডি, সুইসার বাস ছেড়ে পুরুলিয়া থেকে ঝালদা রুটের বাস ধরি আমি। পেয়ে যায় সিট।

        তখন সাতটা ত্রিশ। আটটা বাজতে আধ ঘণ্টা বাকি। সামান্য কিছু খেয়ে নেওয়াই ভালো। রাস্তায় খাওয়া-দাওয়ার সেরকম কোনো উপায় নেই। খুব বেশি দাঁড়ায় না কোথাও। শোঁ শোঁ করে ছুটতে থাকে গাড়ি। বনলতা রিসর্টে দাঁড়ালেও পাওয়া যায় না ভাত রুটি। খেলে খেতে হবে তেলেভাজা, বাচ্চার বলের মতো সাইজের ইয়া বড় পঁয়ত্রিশ টাকা দামের মিষ্টি। জঙ্গলের মাঝে বলে অন্য কোনো দোকানও নেই সেভাবে। তাছাড়া ওই গভীর রাতে আমার পক্ষে খাওয়া সম্ভবও না। 

        পুরুলিয়ার গ্ৰামে থাকি আমরা। বড়জোর ন'টার মধ্যে ঘুমিয়ে পড়ি। খাওয়া দাওয়া সেরে ফেলি আটটাতেই। দশটা এগারোটা মানে গভীর রাত। তারও অনেক পরে মাঝরাতে বনলতায় থামে গাড়িটা। চিৎকার করে বলে দেয় খালাসি,"কারো কোনকিছু খাওয়ার থাকলে খেয়ে নিন। আর কোথাও দাঁড়াবে না গাড়ি।"

          সঙ্গে সঙ্গে নেমে পড়ে সবাই। কেউ কেউ খায় কেউ কেউ খায় না। জঙ্গলের ধারে গিয়ে কমিয়ে আসে জমে ওঠা পেচ্ছাবের চাপ। খানিকক্ষণ হাঁটাচলা করে। বসে বসে আড়ষ্ট হয়ে ওঠা পা গুলো আরাম পায়। তারপর আবার উঠে পড়া বাসে।

         আমি পুরুলিয়া বাস স্ট্যান্ডেই খেয়ে নিই রুটি-সবজি। রিলাক্সের উপর খেয়ে পায়চারি মারতে থাকি বাসের সামনে। সংবাদপত্র বিক্রি করা দোকানের সামনে তখনও দু-একজন খদ্দের। তাদেরকে সাপ্তাহিক কর্মসংস্থান দিয়ে দোকান বন্ধ করতে শুরু করে তারা। সেই দোকানের বগলেই একটা কুকুর। কুন্ডলী পাকিয়ে ঘুমোচ্ছে। মহিলা বিশ্রাম কক্ষের সামনে দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে আরো একটা কুকুর। তার ছায়া দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হচ্ছে ল্যাম্পপোস্টের আলোয়। দু' তিনজন মহিলা টিউবয়েল থেকে ভরে নিচ্ছে খাবার জল। তারপর স্টার্ট হয় গাড়ি। হুড়মুড় করে উঠে পড়ে সবাই।

         দেবাশিসদা, আমি আপনার বাড়ির সামনে পৌঁছে গেছি।-----ফোন করে এ কথা বললে উনি বলেন,"আচ্ছা আচ্ছা, আমি বেরোচ্ছি। কোনদিন তো আসোনি। খুঁজে পাবে না রাস্তা।

         গিয়ে উঠলাম শিল্পী দেবাশিস সাহার নাকতলার বাড়িতে। সেখানে মায়ের সঙ্গে একা থাকেন তিনি। বউ থাকেন উত্তরবঙ্গে। শিক্ষকতা করেন। আর দেবাশিসদা নাকতলার বাড়িতে থেকে বৃদ্ধা মাকে দেখাশোনা করার সাথে সাথে এঁকে যান বইয়ের প্রচ্ছদ। সেটাই নেশা সেটাই পেশা। রাতের বেলা খাওয়া-দাওয়ার পর কাজ করতে করতে কখন যে চারটা বেজে যায় খেয়াল থাকে না। কাজ শেষে ভোর বেলা শুয়ে পড়েন তিনি।

         শিল্পকলাকে নিয়ে এক সময় অনেক স্বপ্ন ছিল। এখানে সেখানে গিয়েওছেন নিজেকে নিপুন করে গড়ে তুলতে। কাজ করতে। কিন্তু এখন আর সেই সব স্বপ্ন নেই। অন্তত প্রকট ভাবে নেই। তাই বইয়ের বিষয়ের সঙ্গে সাযুজ্য রেখে যতটুকু শৈল্পিক কাজ করে তোলা যায় প্রচ্ছদে, সেই চেষ্টাটুকুর মধ্যেই সীমায়িত করে নিয়েছেন নিজেকে। সেই চেষ্টা টুকুর মধ্যেই কাটিয়ে দেন রাতের পর রাত। সেই শিল্পীর বাড়িতেই গিয়ে উঠলাম আমি। সেখান থেকেই ঘুরব কলকাতার এ প্রান্ত থেকে সে প্রান্ত। গড়িয়ার দুর্গা দত্ত, সুনৃতা রায়চৌধুরী। নেতাজী নগরের স্বপন চক্রবর্তী, বাঁশদ্রোনী প্লেসের দীপংর রায়। সল্টলেকের কালীকৃষ্ণ গুহ, হাতিবাগানের ঝুপ্পিদি ইত্যাদি ইত্যাদি।

          সময় কম অথচ অনেক জনের সঙ্গে সাক্ষাৎ করা। একবার বেরিয়েই টুকটুক করে চলে যাওয়া অনেক জায়গায়।

          সকাল আটটার দিকে বেরিয়ে কবি দীপংকর রায়ের বাড়ি। "এবং কথা"-র সম্পাদক। সেখানেই নাস্তা খাওয়া। তারপর বেরিয়ে যাওয়া দূর্গা দত্তের উদ্দেশ্যে। তখনই ফোন আসে কবি অনির্বাণ ধরিত্রী পুত্রের,"উত্তম, এ যাত্রায় আমার সঙ্গে দেখা হচ্ছে না ভাই। ক্ষমা করো। আমাকে বেরোতে হবে এক জায়গায়। নির্মলকে বলে দিও।"

-----আচ্ছা দাদা।

     তারপর বলে ওঠেন-----নির্মল সম্পর্কে আমার একটা লেখা বেরিয়েছিল অনেক দিন আগে। সেটা আমার কাছে নেই। কোথায় বেরিয়েছিল তাও মনে নেই এখন। অনেক জনকেই বলেছি। কেউ সন্ধান দিতে পারেনি। তুমি কী একটু খোঁজ নিয়ে জানাতে পারবে?

-----চেষ্টা করব দাদা।

-----হ্যাঁ হ্যাঁ চেষ্টা করো। লেখাটা পেলে আমার খুব ভালো লাগবে।

       তারপর খানিক শ্বাস নিয়ে বলেন-----তোমরা জানো না, নির্মল কত বড় কবি! তোমরা কাছে থাকো তো, তাই বুঝতে পারো না। কিন্তু আমি বুঝতে পারি। পাহাড়ের কাছে দাঁড়িয়ে যেমন পাহাড় কতটা উঁচু, তা বোঝা যায় না। এক্ষেত্রেও তাই। কিন্তু দূর থেকে আমরা বুঝতে পারি, সে কত বড়!

         আমি কিছু মন্তব্য করি না। কে বড় কে ছোট সেই বিষয় অনুধাবন করার বয়স বোধহয় হয়নি এখনো। তাই হুঁ হাঁ করেই শুনে যাই কথাগুলো। আর উনি ফোনের ও প্রান্ত থেকে আবেগি গলায় বলে গেলেন একটানা।

এর আগে সেইভাবে কথা হয়নি ওনার সঙ্গে। কয়েক বছর আগে অনুবর্তনে লেখা পাঠিয়েছিলাম কয়েকটা। বেরিয়েওছিল। তারপর দীর্ঘদিন পাঠানো হয়নি। কিন্তু অসম্ভব স্মৃতিশক্তি! সবকিছুই মনে আছে ওনার! নাম বলতে বলতেই বলে দিলেন, "তোমার কবিতা তো বেরিয়েছে আগেও।" 

         বারো পনেরো বছর আগের বিষয় নিখুঁতভাবে মনে রাখতে পারেন তিনি! এমন মানুষ ছাড়া কী সম্পাদক হওয়া মানায়?

         দূর্গা দত্তের বাড়ি থেকে বেশ কয়েকটা প্লাস্টিকের প্যাকেট নিয়ে বেরিয়ে পড়ি। আমার বউ, নির্মলদার ভাইপো রাজাদার বউয়ের জন্য উপহার কিনে রেখেছিলেন তিনি। পুজোয় পরার শাড়ি। আর গরিব মানুষকে দেওয়ার জন্য জড়ো করে রেখেছিলেন অনেক পুরনো কাপড়। কিন্তু সেই সব নিয়ে কীভাবে ফিরব পুরুলিয়ায়? আমার একার পক্ষে কি সম্ভব? লাগেজ তো নিজেরও আছে। তাই পুরনো কাপড়ের বস্তা থেকে কয়েকটা দিয়ে বাকিগুলো অন্যভাবে পাঠানোর কথা জানালেন তিনি। 

         সেখান থেকে বেরিয়ে কবি হেমন্ত বন্দ্যোপাধ্যায়কে ফোন,"আপনি বাড়িতে আছেন তো দাদা?"

      মিহি গলায় বলে উঠলেন তিনি-----হ্যাঁ বাড়িতেই আছি।

-----তাহলে আমি আসছি?

-----না উত্তম, এসো না। পরে কখনো দেখা হবে। আমি খুব অসুস্থ জানো? একটু পরেই ডাক্তার দেখানোর জন্য বেরোতে হবে। কিছু মনে করো না।

-----না না মনে করার কী আছে? আপনি দেখা করতে বলেছিলেন তাই...

-----সে বলেছিলাম। কিন্তু এবার আর হলো না। তুমি যখন পরে কলকাতায় আসবে। তখন এসো।

       ওদিকে আর না গিয়ে রওনা দিই সল্টলেকের উদ্দেশ্যে। সল্টলেকের এইচবি-৬। কবি কালীকৃষ্ণ গুহের বাড়ি। 

-----উত্তমদা তুমি কি আসছো আমাদের এখানে?

      আলোপৃথিবী প্রকাশনের মৌমিতা ফোন করে জানতে চাই আমার কাছে।

-----হ্যাঁ আসবো, তবে একটু দেরি হবে। আমি এখন সল্টলেকে। কালীদার বাড়ি যাচ্ছি।

-----কত দেরি হবে? এক ঘণ্টার মধ্যে আসতে পারবে তো?

-----হ্যাঁ হ্যাঁ, হয়ে যাবে।

-----আচ্ছা।

      বলেই ফোন কেটে দেয় মৌমিতা।

-----এই নাও, দুটো খাম দিলাম। একটা নির্মলের জন্য। আরেকটা তোমার। নির্মলের খামের ওপর ওর নাম লেখা আছে, দেখে নিও। কয়েকটা ম্যাগাজিন নিয়ে যাও। নির্মলকে দিয়ে দেবে। আর আমার ছেলের একটা কাব্যগ্রন্থ। বেশি কপি নেই আমার কাছে। না হলে তোমাকেও দিতাম। এটা তার প্রথম কাব্যগ্রন্থ।

       বইটার দিকে তাকাতেই চিনতে পারি আমি। কালীদাকে বলি-----এটা আমাকে আগেই দিয়েছেন আপনি। এর আগেরবার যখন এসেছিলাম, তখন। বইটা বেশ ভালো।

-----ও দিয়েছি। তাহলে ভালোই হল। এখন আমার অনেক কিছুই মনে থাকে না। বয়স হলো তো।

-----হ্যাঁ।

       ওনার কথাতে সায় দিই আমি। তারপর বলেন,"দুপুরে খেয়েছো?"

-----না খাইনি।

-----আজ আমার বাড়িতে কেউ নেই। তোমাকে কিছু খাওয়াতে পারবো না। রাস্তার পাশেই একটা হোটেল আছে। সুন্দর খাবার দেয়। সেখানে গিয়ে খেয়ে নিও।

        বলেই ১০০ টাকা ধরিয়ে দেন হাতে। আমি বেরিয়ে পড়ি।

        মৌমিতার ওখানে এর আগে যাইনি। যাওয়ার সময় অনেকবার জিজ্ঞেস করতে হয় রাস্তা। শহরের রাস্তাগুলো আমার কাছে কেমন যেন। সব সময় একই মনে হয়। একটার থেকে আরেকটাকে আলাদা করা কঠিন হয়ে ওঠে। গুলিয়ে যায়। গ্রামাঞ্চলে এত তো আর রাস্তা নেই। থাকলেও এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্ত দেখা যায় অনায়াসে। এ পাড়ার বাড়ি থেকে ও পাড়ার বাড়ি দেখিয়ে দেওয়া যায় আঙুল তুলে। সেই জিনিসটা হয়ে ওঠে না শহরে। তাই হারিয়ে যায়। জানা জায়গাকে যাওয়ার জন্যও বারবার জিজ্ঞেস করতে হয় পথচারীদের।

      স্বপন চক্রবর্তীর বাড়ির পথ নতুন কিছু নয়। শুন্য দশক থেকে যাতায়াত করছি সেখানে। ১৮-২০ বছর হয়ে গেল। তবুও ভুলে যাই। কাউকে জিজ্ঞাস না করলেও ঘুরতে হয় অনেকক্ষণ।

       মৌমিতা শুভদীপের সঙ্গে নিজের বই নিয়ে অনেকক্ষণ কথা হলো। কথা হলো আমার "অরন্ধন" ওয়েব ম্যাগাজিন সম্পর্কেও। সুন্দর একটা ছোট রুমের মধ্যে সাজানো গোছানো অফিস। থরে থরে বই, ম্যাগাজিন। কার বই নেই সেখানে? পুরনো থেকে শুরু করে নতুন, প্রায় সকলেরই বই হয়েছে ইতিমধ্যেই। চলছে কাজও। একটা রুদ্ধশ্বাস যাত্রা নিয়ে এগিয়ে চলা তাদের। অটুট প্রাণশক্তি!

        সেখান থেকে হাতিবাগান। কবি প্রসূন বন্দ্যোপাধ্যায়ের বোন ঝুপ্পিদির বাড়ি। তারপর বেরিয়ে পড়া নাকতলা। শিল্পী দেবাশিস সাহার আস্তানায়।

        তখন সন্ধ্যা। নাকতলার পূজা প্যান্ডেলে জাঁকিয়ে ভিড়। আমি আর দেবাশিসদা বেরিয়ে গেলাম মূল রাস্তায়। খানিকটা ফাঁকা এটিএম খুঁজছেন তিনি। টাকা তুলবেন। হাতে নগদ প্রায় শেষ।

        দেবাশিসদা দোতলায় একটা রুম বানিয়েছেন। ছোট্ট রুম। সেখানেই স্টুডিও করতে চান তিনি। নিরিবিলি ভাবে কাজ করতে চান একা একা। কোনো বন্ধু এলেও রাখতে চান সেখানেই। যাতে অসুবিধায় হয় পড়তে না হয় তাঁকে।

        আমাকে নিয়ে ঢুকে পড়েন শপিং মলে। "উত্তম, তুমি তোমার বর্তিকার জন্য একটা জামা পছন্দ কর। সুন্দর একটা জামা। আমি তো ওর মাপ জানি না। তুমিই বুঝতে পারবে, কোনটা হবে কোনটা হবে না।"

-----ওর জন্য কিনতে হবে না। আমি ভাবলাম আপনি নিজের কিছু কিনতে আসছেন। ছেড়ে দিন ছেড়ে দিন।

      বলেই শপিং মল থেকে বেরিয়ে যেতে উদ্যত হলে ধরে ঘোরান তিনি।

-----আরে নাও না। ও তো আমারও মেয়ের মতো। ওকে খুব ভালো লাগে আমার। তুমি যে ওর ছবির সঙ্গে একটু একটু করে লেখা দাও না ফেসবুকে, আমি পড়ি। আর অবাক হয়ে যায়। এত ভালো লাগে না, কি আর বলি। আমাদের শহুরে জীবন কেমন যেন। তোমাদের মুক্ত গ্রাম্য জীবনের ওইসব কথাগুলো পড়তে পড়তে ছোটবেলার কথাগুলো মনে পড়ে যায়। ছোটবেলায় আমরাও গ্রামেই থাকতাম। তারপর শহরে চলে এলাম। কতদিন হয়ে গেল। এখন বোরিং লাগে এইসব।

        আমি আর কথা না বাড়িয়ে বাছতে শুরু করি। একটা পছন্দও হয়ে যায়। শংকর মাছের আকার বিশিষ্ট। জামাটা পরার পর হাতগুলো দুপাশে মেললেই শংকর মাছের মতো দেখতে লাগবে মেয়েকে। সেটাই কিনে নিই আমরা। তারপর বেরিয়ে পড়ি।

        ট্রেন থেকে নেমে সোজা নির্মলদার বাসায়। তাঁর জিনিসপত্র দিয়ে ফিরতে হবে বাড়ি। তিন চার দিন হয়ে গেল। বউ বাচ্চার দায়িত্বে রেখে এসেছি সবিতাকে। আমার ছোট শ্যালিকা। সেও বিরক্ত হবে এতদিন।

-----অসুবিধা হয়েছিল কিছু?

       বাসায় পা রাখতে জিজ্ঞেস করেন নির্মলদা। আমি চটি খুলতে খুলতে উত্তর দিই-----না। কলকাতায় গেলে আমার কোনো অসুবিধা হয় না। তবে এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্ত যাওয়া আসা করতে করতে ক্লান্ত হয়ে যায়। কম কী দূরত্ব?

-----যতদিন বেঁচে আছি, করে দে ভাই। তুই ছাড়া কে আর করবে? দেখেছিস তো, আমাদের ছানাপোনাদের কান্ডকারখানা। নিজের ভালোর জন্য যেতে বললেও যেতে চায় না। নিজের স্বার্থেও তো যাওয়া দরকার বল? এদের যে কি হবে? স্বার্থ ত্যাগ না করলে সাহিত্য হয় না। এমনি এমনি আশীর্বাদ দেয় না মা সরস্বতী। ত্যাগ করতে শিখতে হবে। শুধু পাওয়ার আশা করব, দেব না কিছুই, এভাবে হয় না।


*******************************************************************************************************



 কল্পোত্তম

নিরলস সাহিত্যচর্চায় মগ্ন তরুণ কবি কল্পোতম । একটি উপন্যাস সহ ইতিমধ্যেই তিনি লিখে ফেলেছেন পাঁচটি গ্রন্থ । কাব্যগ্রন্থ  *  সাতরঙা পাড়  *  বত্রিশ নম্বর জাতীয় সড়ক* ঝুমুর সঙ্গীতের বই  * রিঝে রঙে  উপন্যাস  *  পেইন্টেড ট্রেন  গল্পগ্ৰন্থ  *  স্বপ্নসিঁড়ি* সম্প্রতি প্রকাশিত





পাঠ পরিক্রমা * দেবার্ঘ সেন





নন-ফিলজফিকাল আত্মহত্যা ও ক্রোমোজোমাল সিম্ফনি

দেবার্ঘ সেন 


অখিলেশ সুর সম্পাদিত 'ঋকবেদ' পত্রিকার বিশেষ 'সাক্ষাৎকার সংখ্যা'য় বাংলা কবিতার মহাজাগতিক কবি শম্ভু রক্ষিত-এর এক সাক্ষাৎকার প্রকাশিত হয়েছিল, যেখানে তিনি বলেছিলেন—" কবি চান বা না চান, যে কোনো কবিতাকর্মের প্রধান লক্ষ্য পাঠকের সঙ্গে সংযোগ স্থাপন। প্রাথমিকভাবে হয়তো কবির কিছু আসে যায় না। বিশ্বসংসারে তাঁর কীর্তি কতজনের হৃদয়ে কী বার্তা পৌঁছে দিল সে নিয়ে তিনি বিন্দুমাত্র ভাবেন না। কিন্তু মজার কথা এই, তার অজ্ঞাতসারে কাজটি ঘটে যায়। সংযোগ স্থাপিত হয়— এটাই অনিবার্য এবং তা দু'ভাবে। প্রথমত— কবিতা যেহেতু বিশ্বজনীন পতনশীলতা এবং অসঙ্গতির মধ্যে নিয়ে আসে এক পরম সাযুজ্য ও সংহতি অতএব এইভাবে নিজের যথার্থতা নিরূপণ করাই হয়ে ওঠে কবিতার বার্তা। কিন্তু এছাড়াও আছে আরেকটি দিক। তুমুল জাগতিক সমাচারের মধ্যে কবিতার এবং কবিতারই ক্ষমতা আছে হৃদয়কে পরিশুদ্ধ করার। কোনো মহৎ স্তরে হৃদয়কে উত্তরিত করতে একমাত্র কবিতাই সক্ষম।" এখন কথা হলো যে, কবি শম্ভু রক্ষিতের এই অভিমতটি কেন হঠাৎ মনে এলো, তরুণ কবি শুভ্রনীলের কবিতার বই 'নক্ষত্র রঙের আত্মহত্যা' পড়তে পড়তে শম্ভুদার এই কথাগুলিতেই আচ্ছন্ন হতে হয়। শুভ্রনীলের কবিতার যে মহাজাগতিক নিরীক্ষণ আছে তা যেন বিশ্বাস ভেঙে নতুন বিশ্বাসের জন্ম দেয়। যে বিশ্বাসকে স্নায়ুজনিত দিক থেকে বিভেদ করা যেতে পারে। বর্তমানে যে সমস্ত তরুণ কবি কবিতা নিয়ে বিভিন্ন নিরীক্ষা ও অন্বেষণ করে চলেছেন সেখানে শুভ্রনীলের স্বর ও ভঙ্গি বেশ ব্যতিক্রমী, 'মহাজাগতিক মৈথুন' শীর্ষক একটি কবিতায় শুভ্রনীল লেখেন—

' আমার শিরা-উপশিরার অন্ধকার কেটে

পথ খুঁজে নিচ্ছে 

সদ্য জন্মানো অ্যামিবার অলিন্দে

ঊরু থেকে হাড় কেটে

আদম বানাচ্ছে 

ইভের গুটি হাতে রেখে,

         বিশ্বাস

         ভয়

         কাম

             সহস্র বিষ ঢেলে দিল

               স্থাবর অবয়ব রক্ষার্থে 

ঈশ্বর আমার গা বেয়ে উঠে আসছে 

ঘুঙুরের ফাঁকে সমুদ্র

     সমান্তরাল মহাবিশ্বের সময়-শেল

পলাশের লাল ভেদ করে 

      প্রকৃতির সাথে সহবাস'


'মহাজাগতিক মৈথুন' কবিতার উপরিউক্ত অংশটিকে নিয়েই এক দীর্ঘ আলোচনা সম্ভব বলে মনে করি। 'আমার শিরা-উপশিরার অন্ধকার কেটে পথ খুঁজে নিচ্ছে ' এটি যেন কবিমননের নিরীক্ষার এক বিশেষ দিক। এখান থেকে যে স্পন্দ চিহ্নিত হয় সেখানে কবি যেন নিশ্চেষ্ট, অপ্রতিরোধী। 

' সদ্য জন্মানো অ্যামিবার অলিন্দে

ঊরু থেকে হাড় কেটে 

আদম বানাচ্ছে 

           ইভের গুটি হাতে রেখে 

                    বিশ্বাস

                    ভয়

                    কাম'

এখন এখানে পূর্বপঙক্তির সাথে কবিতার বিবর্তন বেশ লক্ষ্যণীয় ; লক্ষ্যণীয় কবিমনে অ্যামিবার আগমন। এই আগমন কোথাও যেন এক কোশী থেকে আদিমের চরে নিয়ে যেতে চাইছে অথচ তার নির্দেশ ভারাক্রান্ত করছে না। তাই বোধহয় শুভ্রনীল লিখছেন, স্থাবর অবয়ব রক্ষার্থে সহস্র বিষ ঢেলে দেওয়ার কথা—

অনুভূতির দাহ্য-পরীক্ষা কতদূর পৌঁছোলে নির্দ্বিধার মতো উঠে আসে নিঃশর্ত এই স্বীকার যে,

'ঈশ্বর আমার গা বেয়ে উঠে আসছে

ঘুঙুরের ফাঁকে সমুদ্র 

সমান্তরাল মহাবিশ্বের সময়-শেল

পলাশের লাল ভেদ করে 

প্রকৃতির সাথে সহবাস।'

ভারি অদ্ভূত এই উচ্চারণে কবি যেন আচ্ছন্ন হয়ে পড়েছেন অনাবিল এক ভূতগ্রস্ততায়। সমান্তরালে অকাতরে আচ্ছন্ন করে দিচ্ছেন আমাদেরকেও। অথচ কোথাও কিন্তু ঈশ্বর এতোটুকুও অতিকায় হচ্ছে না। এ যেন বিমূর্ত কথনের অবিচ্ছেদ্য এক ভাঙাগড়ার প্রলয়।

        বইটি পড়তে গিয়ে শুভ্রনীলের কবিতার যে অন্যতম বৈশিষ্ট্য পাওয়া যায়, তা হ'ল তার প্রেক্ষণ অন্বেষা। যেমন 'বিভীষিকা গহ্বর' কবিতায় তিনি লিখছেন—' একটা বিভীষিকা গহ্বর/ পারস্পরিক ভাব বিনিময় করছে/ উদ্বেল মেরুদোষ/ প্রবাহ সৃষ্টির অন্তিমে।' লক্ষ্য করুন, এ লেখার মধ্যে তাঁর পর্যবেক্ষণ, যা আমাদেরকে সিক্ত করছে অবক্ষয়ের বিভীষিকায়, যেখানে পরিবেশনের ক্ষেত্রে মাথা ধুয়ে দিয়ে যাচ্ছে উত্তর আধুনিকতার জল।


মনে করাই, এ লেখার শুরুতেই উল্লেখ করেছিলাম কবি শম্ভু রক্ষিতের সাক্ষাৎকারের আংশিক কিছু কথা, যেখানে তিনি বলছেন— 'কবিতা যেহেতু বিশ্বজনীন পতনশীলতা এবং অসঙ্গতির মধ্যে নিয়ে আসে এক পরম সাযুজ্য ও সংহতি অতএব এইভাবে নিজের যথার্থতা নিরূপণ করাই হয়ে ওঠে কবিতার বার্তা'। আর প্রকৃতই অজ্ঞাতসারে শুভ্রনীলের কলমও যেন 'সভ্যতার পোড়া রেক্সিন' কবিতায় সেই দিকটাই স্বতঃস্ফূর্তভাবে ছুঁয়ে যাচ্ছে। এই কবিতার নিম্নে উল্লিখিত কয়েকটি পঙক্তিতেই তা যেন নিবিড় হয়ে আসে।

'সভ্যতার স্ট্যাটাস আপডেট—/ ঢিনচ্যাক ধরনা ও ফর্টিনাইন আদার্স / —ফেসবুক/ টুইটার / ওয়াটস আপ / কান্না হাসি কৌতুক কথা, খরস্রোতা দেয়াল/ কিন্তু / দেনার দায়ে ডুবন্ত চাষা / হঠাৎ কোনো সকালে লক-আউট হওয়া শ্রমিক / সীমান্তে শহিদ জঠরের ফুল/ গণতন্ত্র চুপ! / সভ্যতা বধির। '

   ব্যক্তিগতভাবে আমি মনে করি, যে কোনও কবিরই রাজনৈতিক সচেতনতা থাকা ভীষণরকম জরুরি। যা আজ একপ্রকার নেই বললেই চলে, সে কথা থাক বরং শুভ্রনীলের রাজনৈতিক সচেতনতা স্বরূপ একটি কবিতার কথা বলি। '৮/৪ গণতন্ত্র' শীর্ষক উক্ত কবিতায় এই ফ্যাসিস্টিক সময়ে দাঁড়িয়ে তিনি গণতন্ত্রকে কীভাবে দেখছেন এ কবিতার প্রেক্ষিত ও ভাষা তারই প্রকাশ ঘটায়। আপনাদেরকে পড়াতে চেয়ে সম্পূর্ণ কবিতাটিই তুলে দিলাম —


' ৮/৪ গণতন্ত্র 


৮/৪ এর একটা কাঠের বাক্স

ওপরে কিছু উল্কি কাটা, হায়ারোগ্লিফিক ডিজাইন 

২০০০ বছর ধরে এভাবেই শুয়ে আছি 

সঙ্গী কিছু আতর,পুরনো কাঠ-গয়না 


না আমি জীবনানন্দের বনলতা নই,

তারও উপক্রম ছিল প্রেমের 

আমার মত কাঠ পুতুল নয় সে,


আমাকে লোকে দেখতে আসছে রোজ

কিন্তু আমি কাউকে দেখতে পাইনা, চেষ্টা করেও পারিনা 


মৃত্যুর পরও শান্তি দেয়নি ওরা আমায়—

     কাঠ পুতুল বানিয়ে রেখেছে হাজার হাজার বছর ধরে ,


ভুল ভাবছো আমি মমি না ,

      তোমাদের রোজকার গণতন্ত্র '


এরপর চলে আসি তার 'অ্যান্টি কসমিক' কবিতায়। যেখানে তিনি লেখেন—

' আকাশ থেকে নেমে আসছে—

অতিভুজের সিঁড়ি বেয়ে

শক্তি—

বিপরীত শক্তি—

তরঙ্গ—

অভিকর্ষ—

অ্যান্টি অভিকর্ষ—


সরাসরি যুদ্ধ ঘোষণা X শূন্যের প্লাজমা '

  

     বিস্মিত হতে হয় তাঁর এই বোধে, যেখানে বৈজ্ঞানিক অলংকারকে তিনি ব্যবহার করে স্থাপন করতে চাইছেন তাঁর নিজস্ব দর্শনকে। আর এভাবেই তিনি তাঁর কবিতায় হয়তো অজান্তেই ছুঁয়ে যাচ্ছেন বিনির্মাণের প্রগতি।

   কবিতা যেভাবেই লেখা হোক না কেন বা যে ফর্মেই লেখা হোক না কেন আসলে তা দর্শন ব্যতীত কিছু নয় অর্থাৎ তার একটা ফিলোজফিকাল সেন্টিমেন্ট থাকবেই। এখন, এই ফিলোজফির পাশাপাশি উঠে আসে যে টার্ম তা হ'ল 'নন-ফিলজফি' আবার যদি বলি পোয়েট্রি তাহলে উঠে আসে 'অ্যান্টি-পোয়েট্রি'। এ প্রসঙ্গে জানিয়ে রাখা দরকার নন-ফিলজফি যেমন কোনও অ্যান্টি-ফিলজফি নয় তেমনই অ্যান্টি-পোয়েট্রিও আসলে এক ধরণের পোয়েট্রিই। বুঝতে হবে এখানে 'নন' অর্থে কোনও নেগেশনের কথা বলা হচ্ছে না। ঠিক সেভাবেই শুভ্রনীলের 'স্বপ্নের সিঁড়ি ভাঙায়' কবিতায় অদ্ভুত এক বাস্তব বেষ্টিত মিউটেটেড ফিলজফির দিকই যেন উঠে আসতে চায়, উঠে আসতে চায় ক্রোমোজোমাল সিম্ফনি অথবা ডেস্ট্রাকশনের যেন কোনও এক মডেল।

  'নক্ষত্র রঙের আত্নহত্যা'য় বেশ কিছু কবিতার পঙক্তি আমাদেরকে ভাবিয়ে তোলার অনিমিখ দাবি রাখে। যেমন—

'একেকটা বিন্দু জীবন

    সান্নিধ্যের সঙ্গমে যেভাবে বেড়ে ওঠে আতশ মুক্ত করে—

      জীবনের নীচে দাঁড়িয়ে থাকা একেকটা বিন্দু সত্য, আরও আলো করে দেয়

                     অন্ধকারের গতিপথ'  অথবা

'সন্তান প্রথমবার স্তনে ঠোঁট দিলেই প্রতিটি অবৈধ মা ঈশ্বরী হয়ে ওঠে'। 


  বইটির প্রধান বৈশিষ্ট্য হচ্ছে বইটির নামকরণ কোনও কবিতার নামকরণ থেকে উঠে আসেনি এবং কোনও কবিতাতেই শব্দবন্ধ রূপে 'নক্ষত্র রঙের আত্মহত্যা'রও কোনও প্রয়োগ নেই। জীবনের জীবিত এই আত্মহত্যার সাথে অনুভবের পরিচিতি ঘটাতে হলে আপনাকে গ্রন্থটির পাতা ওল্টাতে হবে। আর একটা একটা করে পাতা ওল্টালে ভীষণ স্বচ্ছভাবেই আপ্যায়ন করতে ইচ্ছে করবে এই মহাশূন্যে সকল চর্বি-বিসর্জনের সমূহ প্রক্রিয়াকে। আর কবি শুভ্রনীল চক্রবর্তী তখনও হয়তো তাঁর কবিতাতেই বলে যাবেন—

' ভেবেছিলে সব প্রতিবাদ একদিন ক্লোরোফর্ম হয়ে যাবে

শ্মশানের সালোকসংশ্লেষে—'










কাব্যগ্রন্থঃ নক্ষত্র রঙের আত্মহত্যা 

প্রকাশনঃ ধানসিড়ি

প্রকাশকালঃ জানুয়ারি, ২০২৩

প্রচ্ছদঃ রাজদীপ পুরী


গ্রন্থঋণঃ সাক্ষাৎকারসংগ্রহ শম্ভু রক্ষিত


****************************************************************************************************



দেবার্ঘ সেন

এ সময়ের অন্যতম শক্তিশালী তরুণ কবি। বিষয় ভাবনার নানাবিধ বৈচিত্র ছুঁয়ে থাকে তাঁর কবিতা। স্বকাল ও স্বদেশ ভাবনা তার মধ্যে অন্যতম । দেবার্ঘ সেন-এরকবিতার বই---) সমান্তরাল, দিগন্ত প্রকাশন ২) এক্সকিউজ মি, বার্তা প্রকাশন ৩) কাজল বাঁশী, বার্তা প্রকাশন ৪) নির্বীর্যতার জতুগৃহ, বার্তা প্রকাশন ৫) স্পর্শ নামক জেলখানা, একটি গীর্বাণ প্রকাশনা ৬) ভাতের জন্ম, সাপ্তাহিক ব্ল্যাকহোল প্রকাশনা । গত বইমেলায় প্রকাশিত ----



উপন্যাস * বিশ্বনাথ পাল




[ 'স্বরবর্ণ * ১২ সংখ্যা থেকে শুরু হয়েছে বিশ্বনাথ পালের ধারাবাহিক উপন্যাস 'বামনের চন্দ্রাভিযান'। উপেক্ষা, অনাদর আর দারিদ্র্যের তীব্র দংশনজ্বালা দাঁতে দাঁত চেপে, একটি যুবক কী ভাবে একক নিঃসঙ্গ লড়াইয়ে জীবনের সাফল্য ছিনিয়ে আনে, এই উপন্যাস তারই জীবন্ত আখ্যান। লক্ষ লক্ষ  বেকার যুবকের বেকারত্বের জ্বালার বাণীরূপই শুধু নয়, তা থেকে উত্তরণের অমোঘ বিশল্যকরণীও বটে এই উপন্যাস।]


বামনের চন্দ্রাভিযান 

পর্ব * চার

বিশ্বনাথ পাল

 “টুকটাক জানি। ইমেল করতে পারি। চিঠি টাইপ করতে পারি। মানে এম এস ওয়ার্ডের কিছু কাজ জানি। কিন্তু কোনও প্রাতিষ্ঠানিক ডিগ্রি নেই।” 

“আচ্ছা, তুই তাহলে একটা সিভি বানা কম্পিউটারে। তাতে তোর এডুকেশনাল কোয়ালিফিকেশন, কত পার্সেন্ট নম্বর পেয়েছিস সব দিবি। এর একটা প্রিন্ট আউট নিবি। আর স্টেটসম্যান পেপারটা ফলো কর। ওখানে দেখবি ওয়াক ইন ইন্টারভিউ, সিচুয়েশন ভাকেন্ট-এর বিজ্ঞাপন থাকে। ওগুলো দেখে অ্যাপ্লাই কর।” 

ছোটনদার কথাগুলো আমারও মনে ধরল। মাধ্যমিক পরীক্ষা দিয়েই রেজাল্ট বেরনোর আগে থেকেই বাড়ি বাড়ি গিয়ে টিউশনি পড়াই। আমাকে প্রথম টিউশনির হদিশ দিয়েছিল আমাদের বাড়ির উল্টোদিকের মুদি দোকানি নির্মলদা। ছাত্র পাড়ারই এক মধুদার ছেলে। ক্লাস ওয়ান, সপ্তাহে পাঁচ দিন, ফি ষাট টাকা। বাচ্চাটিকে একদিন গোলাপ ইংরেজি জিজ্ঞেস করায় উত্তরে বলেছিল, “পদ্ম।”  এখন আর অত নিচু ক্লাস পড়াই না। এখন আমার সব থেকে নিচু ক্লাসের ছাত্র পড়ে এইটে।  কিন্তু বাড়ি বাড়ি গিয়ে পড়াতে আর ভাল লাগে না। সমাজ গৃহশিক্ষককে খুব তাচ্ছিল্যের চোখে দেখে। যেন যে টিউশনি করে তার আর অন্য কিছু করার যোগ্যতা নেই। তাই ভাবলাম একটা প্রাইভেট ফার্মে যদি ছোটখাট কাজ জোটানো যায়, যা দিয়ে আমার বেঁচে থাকা জারি থাকবে আর পাশাপাশি সরকারি চাকরির জন্য পড়ব, তাহলে ভালই হয়। টিউশনি ছেড়ে দেব।  

মাস দুয়েকের মধ্যে বুঝে গেলাম যে সে গুড়ে বালি। ছোটনদার কথামতো স্টেটসম্যান রাখতে শুরু করেছি। লাল কালি দিয়ে সিচুয়েশন ভাকেন্ট দাগাতাম, যেগুলি আবেদন করতাম, সেগুলোর পেপার কাটিং একটা খাতায় আঠা দিয়ে সেঁটে রাখতাম। আশার সমাধি ঘটা কেসগুলির নিস্পত্তি হয়েছে মনে করে লাল কালির ক্রস দিতাম। বেশ কয়েকটা ওয়াক ইন ইন্টারভিউ দিতে গেলাম। 

দেখলাম বেকারত্বের সমস্যা শুধু আমার একার নয়। বরং দেশের অধিকাংশ যুবক যুবতিই দেখছি বেকার বা মনের মতো কাজ খুঁজছে। আমি ক’দিন হাওড়া, পার্কস্ট্রিট, মানিকতলা করলাম। বেশ কিছু ইন্টারভিউ দিলাম। কিন্তু কাজের পূর্ব অভিজ্ঞতা যেহেতু শূন্য, যেহেতু টিউশনি করা কোনও কাজ হিসেবে গণ্য নয় (বেকারদের ক্ষেত্রে, স্কুল-কলেজের শিক্ষকদের ক্ষেত্রে নয়), আমার ভাগ্যে শিকে ছিড়ল না। এমনকী কলেজস্ট্রিটে এক প্রকাশকের দরবারে বইয়ের ক্যানভাসারের কাজের সন্ধানেও ছুটলাম। আমার ভাবনায় ছিল অবশ্য মেডিক্যাল রিপ্রেজেন্টেটিভের কাজ। কিন্তু এদিকে ডিগ্রি বিশুদ্ধ বিজ্ঞানের নয়, সমাজ বিজ্ঞানের। সত্যজিৎ   রায়ের ‘জনঅরণ্য’-র সোমনাথের মতো আমাকে চাঁদের ওজন কত জিজ্ঞেস করা হয়নি ঠিকই, তবে একবার আমার সিভিতে প্রাপ্ত নম্বরের শতাংশে ক্রমাবন্নতি লক্ষ করে বোর্ডের একজন বলেছিলেন, “মানুষের বুদ্ধি কি দিনে দিনে কমে না বাড়ে?” বোঝো!

ভেবেছিলাম সাড়ে তিন হাজার টাকারও যদি একটা চাকরি পাই, তাহলে গাড়িভাড়া, টিফিনখরচ বাদে হাতে হাজার দুয়েক থাকবে। তার থেকে এক হাজার মাকে দেব সংসার খরচে আমার অবদান হিসেবে আর বাকিটা সরকারি চাকরির পড়ায় ব্যয় করব—দৈনিক খবরের কাগজ, বই-পত্রিকা, পরীক্ষার জন্য পোস্টাল অর্ডার কেনা, এটা-ওটা। টিউশনি আর করব না।

কিন্তু দেখলাম টিউশনির পথই অনেক নিরাপদ। বেসরকারি চাকরি যেন আমার জন্য নয়। আমার এম. এস-সিজ মার্কশীটের কোনও মূল্য নেই নিয়োগকর্তাদের কাছে। অথচ মার্কশীট কিন্তু একটা ছেলে বা মেয়ের পারদর্শিতার প্রকৃত পরিচয় বহন করে না বলেই মনে হয়। তার ওপর তেমন বলিয়ে-কইয়ে নই। কথা বেচে যারা খেতে পারা মানুষেরা অগ্রগণ্য।   

ফলে বাপিদার সঙ্গে এক যৌথ কর্মপ্রচেষ্টায় সামিল হলাম। আমাদের পড়ানোর পেশাটিকে খানিকটা প্রাতিষ্ঠানিক রূপদানের প্রয়াসে।  একটি কোচিং সেন্টার খুলতে চাইলাম। জীবনানন্দে অনুপ্রাণিত নামটা আমারই দেওয়া—‘সুচেতনা স্টাডি সেন্টার’। সুশিক্ষা তো সুচেতনা আনে, আবার জীবনানন্দের কবিতাতেও শব্দটা আছে—‘সুচেতনা, তুমি এক দূরতর দ্বীপ’, অর্থাৎ যা দুর্লভ।   


বাপিদার আরেক অন্তরঙ্গ বন্ধু কিংশুকদাও আমাদের প্রচেষ্টায় সামিল হল। ঠিক হল বাপিদার সুবোধ পার্কের ফ্ল্যাটবাড়ি হবে আমাদের স্টাডি সেন্টারের প্রধান কেন্দ্র ও পড়ানোর  জায়গা। ছাত্রছাত্রী বাড়লে আমার বাড়িও শাখাকেন্দ্র হিসাবে ভাবা যাবে। পড়ানোর জায়গা দেওয়ার জন্য বাপিদাকে কোনও বাড়িভাড়া দিতে হবে না। কিংশুকদা, বাপিদা এবং আমি তিনজনেই ভাগ করে পড়াব। এখানে বাপিদা ও কিংশুকদা দুজনেই সায়েন্সের পাশ গ্রাজুয়েট ।  তিন জনের সমান অংশীদারিত্ব এবং প্রাপ্ত অর্থ সমান ভাগে বণ্টিত হবে—এই আমাদের অলিখিত চুক্তি। এছাড়া আমাদের প্রত্যেকের যার যা আলাদা আলাদা টিউশনি আছে সে সেগুলি পড়াবে কোচিঙে পড়ানোর সময়ের সঙ্গে অ্যাডজাস্ট করে। পাশাপাশি বাপিদার সঙ্গে আমাদের সরকারি চাকরির প্রস্তুতিও জারি থাকবে। কিংশুকদা ও বাপিদা দুজনে আগে থেকেই একসঙ্গে পড়ত।

সেই সময় শয়নে স্বপনে কিছুদিন সুচেতনা স্টাডি সেন্টারের কথা ভাবতাম। ভাবতাম অচিরেই এটি আমাদের বাঁচার অবলম্বন হবে। তখন আর চাকরি খুঁজতে হবে না।

একদিনের কথা স্পষ্ট মনে পড়ে।

আমরা সেদিন দাঁড়িয়ে ছিলাম বাঁশদ্রোণী ব্রিজের গোড়ায়। আমার পাশে বাপিদা একটি ছেলের সঙ্গে কথা বলছে। কী বলছে আমার কানে ঢুকছে না। কারণ যন্ত্রণাটা সেসময় আমার মাথার ভিতর সংকেত পাঠাচ্ছে। এখনি হয়তো তাণ্ডবনৃত্য শুরু হবে। আমার পকেটে একটা ঠোঙায় রাখা কালো জিরে। বাঁ হাতের তালুতে কিছুটা কালো  জিরে নিয়ে আমি ডান হাতের বুড়ো আঙুল দিয়ে ঘঁষছি। আমাকে কেউ এভাবে দেখলে ভাববে খইনি ডলছি। এরপর বাঁ হাত উপরে তুলে ডান হাতের বুড়ো আঙুল চেপে এমন ভঙ্গিতে কালো জিরের ঘ্রাণ নাকে টানছি যে সেটা দেখেও কেউ ভাবতে পারে আমি জনসমক্ষে কলকেতে গাঁজা টানছি। কিন্তু কে কী ভাবল সেটা ভাবার মতো মানসিকতা আমার ছিল না। বাপিদা আমাকে বলেছে, কালো জিরে ভাল করে ডলে তার ঘ্রাণ নিলে মাথার যন্ত্রণা কমে। কবিরাজি ওষুধ। চড়া রোদ উঠেছে আর যন্ত্রণাটাও আসব আসব করছে। আমি তাই ঠেকিয়ে রাখার আপ্রাণ চেষ্টা করছি। বছর তিনেক হল এই যন্ত্রণাটা আমার মাথায় অতিথি হয়েছে। শঙ্কর ডাক্তারকে একবার দেখিয়েছিলাম। ওষুধ খেয়ে কিছু দিন ভাল ছিলাম। তার পর যে কে সেই। একটু আগে বাঁশদ্রোণীর তিনটে ওষুধের দোকানে খোঁজ করেও একটা ওষুধ পেলাম না, ওটা খেলে সাময়িক নিস্তার পাওয়া যায়। বাধ্য হয়ে কালো জিরেই কিনলাম। তবে সারা বছর যন্ত্রণাটা আমার মনোযোগ দাবি করে না। গরম চলে গেলে সে-ও অদৃশ্য হয়।

দিনটা ছিল এপ্রিলের চব্বিশ। সূর্যপুর বয়েজের রেজাল্ট বেরোবে। আমি আর বাপিদা তাই বাঁশদ্রোণী ব্রিজের গোড়ায়। আমাদের সামনে মোশারফের ভাই। আমাদের লিফলেট বিলি করছে। সূর্যপুর স্কুলের যেসব ছাত্র ব্রিজে উঠতে যাচ্ছে, মোশারফের ভাই সহিদুল তাদের হাতে একটা করে লিফলেট ধরাচ্ছে। আর আমরা দাঁড়িয়ে আছি ছেলেরা সেই লিফলেট নিয়ে পড়ছে, না মুড়িয়ে ফেলে দিচ্ছে দেখার জন্য।

আমাদের কোচিং সেন্টারেরই প্রচারপত্র বিলি করছে সহিদুল। বন্ধুর ভাইকে একদম বিনা পয়সায় খাটাচ্ছি না। কাজটা নিজেরাই করতে পারতাম, কিন্তু পড়তে এসে ছাত্রছাত্রী যদি দেখে যে যারা পড়াবে অর্থাৎ স্যাররাই লিফলেট  বিলি করেছে স্টুডেন্ট জোগাড় করতে, তবে ইম্প্রেশন খুব খারাপ হবে বলেই আমাদের ধারণা।

কালো জিরের গুণ আছে বলতে হবে। যন্ত্রণাটা যেন ব্রেক কষেছে। এই যন্ত্রণা যখন মাথার মধ্যে দাপাতে থাকে তখন আশঙ্কা হয়, মাথার ভিতর একটা টিউমার হয়েছে। এবং সেটা বাড়ছে। বাড়তে বাড়তে একটা বিস্ফোরণ ঘটিয়ে আমার প্রাণ কেড়ে নেবে। আর টের পাই এই বেঁচে থাকাকে কী ভীষণ ভালবাসি। আবার কখনও মনে হয় এটা সাইনাসের। চড়া রোদের সঙ্গে নির্ঘাত কোনও সম্পর্ক আছে। সাধারণত গরমকালে দিনের বেলাতেই যন্ত্রণাটা দেখা দেয়। 

ছেলেরা লিফলেট নিচ্ছে বটে, তবে সকলে পড়ছে না। অনেকে রেজাল্ট দেখতেই ব্যস্ত।

একটু আগে বাপিদা সহিদুলকে বেশ কিছু সাদা লিফলেট দিয়ে এসেছে। সহিদুল এখন সাদা লিফলেটই দিচ্ছে। বাপিদার মনে হয়েছিল যে হলুদ লিফলেট কেউ পড়ছে না, সাদাটা হয়তো পড়বে। হলুদটা ইংরেজিতে লেখা আর সাদাটা বাংলায়। আমরা চার হাজার লিফলেট ছাপিয়েছি। প্রথমে দু’-হাজার ইংরেজিতে, পরে আরও দু’-হাজার বাংলায়। বাপিদা আমাকে বলেছে, “তুই কোনও চিন্তা করিস না, দশ-পনেরোটা স্টুডেন্ট আমি লিফলেট ছাড়াই জোগাড় করে দেব।” আরেক দিন বলেছে, “লিফলেট থেকে একজন স্টুডেন্ট আসলেই আমি খুশি।”

একটু আগেও সূর্যটা ঠিক মাথার উপর ছিল। এখন একটু হেলে পড়েছে। আর ছাত্রও আসছে না। আমি ব্রিজের ওপারে গিয়ে পাঁচ টাকা দিয়ে চারটে ডাসা পেয়ারা কিনলাম। বাপিদা খেল না। আমি একটা নিয়ে বাকিগুলো সহিদুলকে দিয়ে দিলাম। আর বাপিদা সহিদুলকে আজকের কাজের জন্য ওর প্রাপ্য টাকা দিয়ে দিল। 

আমাদের তালিকায় ন’টি স্কুলের নাম ছিল। প্রায় সব ক’টা স্কুলই কভার করেছি। এপ্রিলের বাইশ থেকে উনত্রিশ প্রচুর খাটাখাটনি গিয়েছে। সকাল বেলা কোনওদিন এগারোটা থেকে বারোটা রোদের মধ্যে স্কুলের সামনে দাঁড়িয়ে থেকেছি। মোশারফের ভাই যেদিন আসতে পারেনি, আমরা নিজেরাই লিফলেট বিলি করেছি। ভাবমূর্তি নিয়ে তখন ভাবিনি। কখনও বাপিদা আঠা কিনে এনেছে—দু’চারটে লিফলেট পোস্টার করে সেঁটে দিয়েছি স্কুলের গেটে। একই দিনে দুটো স্কুলের রেজাল্ট বেরনোর দিন দুপুরের খাওয়ার সময়ও পাইনি আমরা। তবে সব লিফলেট আমাদের বিলি হয়নি। এখনও হাজার খানেক আছে। ওগুলো সকালের খবরের কাগজের মাধ্যমে বিলি করার ইচ্ছা বাপিদার। কাগজের হকারকে কিছু টাকা দিয়ে নাকি এভাবে বিলির ব্যবস্থা করা যায় খুব সহজেই। বাপিদা বলেছে। তবে একদিন ভোরে ওঠার কষ্ট করতে হবে।

আমাদের এই পরিশ্রমের মধ্যে মনে রাখার মতো উল্লেখযোগ্য কিছু নেই। তবে একদিন বাপিদা একটা বুদ্ধি বাতলেছিল। আমাদের লিফলেট কেউ পড়ছে না দেখে বাপিদা বলেছিল, বিশ্বকাপের ফিক্সার লিফলেটের পিছনে ছাপিয়ে দিলে হয়তো কেউ আর লিফলেটটা ছুঁড়ে ফেলবে  না। মে-র ৩১ থেকে ফুটবল বিশ্বকাপ শুরু। সুতরাং প্রায় এক মাস বাকি, আরও এক মাস জুড়ে খেলা চলবে— এই দু’মাস আমাদের প্রচারপত্র মূল্যবান মনে হতে পারে। বাপিদার দ্বিতীয় বুদ্ধি, লিফলেটের পিছনে রুটিন লেখার ছক ছাপানো। তাতেও ছেলেমেয়েরা রুটিন লেখার কাজে লাগবে ভেবে হয়তো ফেলে দেবে না। যে সময়ের কথা বলছি পৃথিবী তখনও এত গ্যাজেটনির্ভর হয়নি। হাতে হাতে তথ্যভাণ্ডাররূপী ইন্টারনেটসমৃদ্ধ স্মার্ট ফোন তো দূরস্থান, কলকাতায় মোবাইল এসেছিল কিনা সন্দেহ।  

বাপিদার দু’টি পরিকল্পনার সঙ্গে আমার সংযোজন— লেবেল। ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা বই মলাট দিয়ে নাম ক্লাস রোল নম্বর লেখার জন্য লেবেল লাগায়। আমরাও লেবেল ছাপিয়ে বিলি করতে পারি, যার একাংশে থাকবে আমাদের কোচিং-এর বিজ্ঞাপন ফোন নম্বরসহ। এই তিনটি পরিকল্পনাই আলোচনার স্তরে ছিল। কিন্তু আমরা কখনও ভাবতে পারিনি তিন পরিকল্পনারই বাস্তব রূপায়ন দেখতে পাব বৈকুন্ঠপুর শিক্ষা নিকেতনের রেজাল্টের দিন সকালে প্রোগ্রেসিভ কোচিং সেন্টারের সৌজন্যে। অবাক বাপিদা কিছুক্ষণ অ-বাক থেকে আমাকে বলল, “বুদ্ধি বাতাসে ওড়ে।” 

এপ্রিল প্রায় শেষ। সকাল-দুপুর বাপিদার বাড়িতে কমপিউটারে একটি  পোস্টার তৈরিতে ব্যস্ত ছিলাম। বাপিদাই আমাকে দেখিয়ে দিচ্ছিল। এ-ফোর কাগজে  আমাদের কোচিং সেন্টারের বিজ্ঞাপন। ঠিক হয়েছে, এর প্রিন্ট আউটের কপি পিচবোর্ডে আঁটকে আমরা বিভিন্ন বইয়ের দোকানে ঝোলাব। তাতে বই খাতা পেন কিনতে এসে ছাত্রছাত্রী অভিভাবকদের নজরে পড়বে সুচেতনা স্টাডি সেন্টারের কথা।  

বিকেলে পড়াতে গেলাম পাপাইকে। পাপাই ক্লাস সিক্সে উঠল। পুরো ফাইভটা আমার পড়ানো। পাপাইকে পড়িয়ে যখন ফিরে আসব তখনই এক অপ্রত্যাশিত ঘটনার আঁচ পেলাম। রতনদা মানে পাপাইয়ের বাবা আমাকে বসতে বললেন। দেখলাম, রতনদা পাশের ঘরে কিছু আনতে গেলেন। বুঝলাম টাকা, আমার ফিস। পাপাইরা সাত-আট তারিখের আগে আমার মাইনে দেয় না। অতএব আশঙ্কা জাগল, অন্য কিছু ঘটতে চলেছে। কিন্তু পক্ষপাতী মন বলছিল আশঙ্কা ভুল। খানিক পরেই সংশয়ের অবসান। রতনদা আমার ফিস এগিয়ে দিয়ে বললেন, “সোমনাথ, আমি একজন ইংরেজির টিচার পেয়েছি। কিন্তু লোকটা একটু খ্যাপাটে, সে আবার অল সাবজেক্ট ছাড়া পড়াবে না।”  

বললাম, “হ্যাঁ-হ্যাঁ, কোনও ব্যাপার না। আপনি ওনাকে দিয়েই পড়ান।” এছাড়া অন্য কিছু বললে নিজের দৈন্যই প্রকাশ পেত। মুখে যত সহজে কথাগুলো বললাম, বুকের মধ্যে তত সহজ অনুভব হচ্ছিল না। পাপাইকে আমি অঙ্ক ও বিজ্ঞান পড়াতাম। অঙ্ক বিজ্ঞান দুটোতেই ও আশি শতাংশের বেশি নম্বর পেয়েছে। তাও যদি আমার টিউশনি না থাকে কিছু বলার নেই। রতনদা আরও বললেন, “লোকটা খ্যাপাটে হলেও পড়ায় ভাল।” 

বুঝলাম রতনদা আমার থেকে ওই লোকটির উপরেই বেশি ভরসা করছেন। রতনদার বাড়িতে সপ্তাহে দু’দিন এসে মাস গেলে সাড়ে তিনশো টাকা পাওয়া আমার আর হচ্ছে না। শুধু টাকাটাই ফ্যাক্টর নয়, পাপাই বুদ্ধিমান। ওকে আমি পছন্দ করতাম। পড়ার বই ছাড়াও গল্পের বই পড়ার দিকে ওর ঝোঁক। যারা সাহিত্য পড়ে, তাদের প্রতি আমার দুর্বলতা সহজাত। ভাবতে চেষ্টা করলাম, আমার আর কি কোনও দোষ ছিল? রতনদা আমাকে ছেলের জন্য একজন ইংরেজির টিচার ঠিক করে দিতে বলেছিলেন। আমি চেষ্টা করেছিলাম। পারিনি। সেটা কি দোষের মধ্যে পড়ে? রতনদা আমাকে আরও বললেন, “ভাই তুমি কিন্তু কিছু মনে কোরো না। আবার ক্লাস সেভেনে যদি তোমাকে দরকার পড়ে পাব তো?” 

শেষের কথাটা রসিকতা, না আমাকেও হাতে রাখা— ঠিক বোঝা গেল না। বললাম, “যদি কোনও কাজ না থাকে নিশ্চয়ই পাবেন।”

ফিরে আসার সময় মনটা খচখচ করছিল। কত ইচ্ছা ছিল যে আমার রোজগার মাসে দু’হাজার হলে বাড়িতে টেলিফোন নেব। আর সেশনের শুরুতেই একটা টিউশনি চলে গেল। নকুলের দোকান থেকে বাপিদাকে ফোন করলাম। বাপিদা খবরটা শুনেই বলল, “অত ভেঙে পড়ার কিছু হয়নি। ডিজহার্টেনড্ হোস না। এক্ষুনি একটা খবর শুনলে তোর ভেঙে পড়া ভাব কেটে যাবে।” 

কান খাঁড়া করে জিজ্ঞেস করলাম, “কী খবর?” 

ওপাশ থেকে জবাব এল, “একজন ফোন করেছিল। তাঁর দুই মেয়ে পড়বে। একজন এইট, একজন নাইন। নবভারতীতে পড়ে।”

নবভারতী এ-অঞ্চলের নাম-করা স্কুল। সুর্যপুর বা নিবেদিতা আশ্রমের যে সব মেয়েরা   দ্বিতীয় বারের চেষ্টাতেও নতুন ক্লাসে উঠতে পারে না, তারা টিসি পেয়ে নবভারতীতে ভর্তি হয়। স্কুল কর্তৃপক্ষ অপরাধ নেবেন না, একটি কথা খুব প্রচলিত— যার নেই কোনও গতি, সে-ই যায় নবভারতী। তা হোক গিয়ে, রোগীদের জন্যই তো ডাক্তার প্রয়োজন। সুস্থ মানুষ সারিয়ে তোলার কৃতিত্ব কোথায়?

বাপিদা বলল, “ওই ভদ্রমহিলা তাঁর দুই মেয়েকে নিয়ে সকালে এসেছিলেন। ছোটটা ব্যাপক দেখতে। ঝুলে যেতে পারি।”

“দেখবে মাথা মোটা।” আমি বললাম।

  

আমরা সাইকেলে যাচ্ছি কিংশুকদার বাড়ি। কিংশুকদার আমাদের প্রচারযজ্ঞে অংশ নিতে না পারার কারণ মায়ের অসুস্থতা ও অকালমৃত্যু। 

প্রায় প্রত্যেকদিনই আমার তখন দেখা হয় বাপিদার সঙ্গে। লিফলেটের জন্য প্রেসে কী ম্যাটার যাবে—দু’জনে ঠিক করি। কখনও আলোচনার বিষয়  আমাদের কোচিং কোন নিয়ম মেনে চলবে। আর পাঁচটা প্রজাপতি সেন্টারের মতো আমাদের কোচিং চালাব না এমন মৌখিক প্রতিজ্ঞাও করি।

একদিন সকালে বাপিদার বাড়ি গিয়ে দেখলাম, বাপিদার মুখ ভার। পাশে কাকিমা দাঁড়ানো। বললাম, “কী হয়েছে?”

“আরে কিংশুকের মা কাল মারা গেছে।”

কিংশুকদা বাপিদার খুব ভাল বন্ধু। আমার সঙ্গেও আলাপ হয়েছিল। বাপিদার মুখে কিংশুকদার কথা অনেক শুনেছি। 

কিংশুকদার মা অসুস্থ জানতাম। দীর্ঘ একমাস পিজিতে ভর্তি থাকার পর বাইপাশ সার্জারি হয় দিন পনেরো আগে। গত পরশু হাসপাতাল থেকে ছুটি দেওয়া হয়। আশ্বস্ত হয়েছিলাম যে, যাক এত দিনে কিংশুকদার ঝুট ঝামেলা কাটল। আর ভেবেছিলাম একদিন কিংশুকদার মাকে দেখতে যাব। আর আজ একী শুনলাম!

কিংশুকদার বাড়ি বাঘাযতীনে। আমরা তিনজনই সেসময় সাইকেল চালাতাম। কিংশুকদার মা মারা যাওয়ার পরে সমবেদনা জানাতে ওদের বাড়ি আমি আর বাপিদা একদিন গেলাম। বেশ খানিকক্ষণ থাকলাম।

মে মাসের শেষে আমাদের কোচিঙের ছাত্রছাত্রীর সংখ্যা আট-দশ জনে গিয়ে দাঁড়াল। কিংশুকদাও মায়ের কাজ করে আমাদের কোচিঙে যোগ দিল। আমাদের প্রচারযজ্ঞ এবং চেনা পরিচিত মানুষজনের সুপারিশে আমাদের সেন্টারে ছাত্রছাত্রী এসেছে, যা আমাদের স্বপ্নের প্রদীপে তেলের যোগান দিল। আমরা ভাবতাম আমাদের কোচিঙের একদিন ব্র্যান্ড ভ্যালু হবে। স্টুডেন্ড একদিন উপচে পড়বে। আমরা সবাইকে নিতে পারব না।

কিন্তু বাস্তব সব সময় মানুষের ভাবনার পথে এগোয় না। স্বপ্নের দেয়ালে একদিন মনখারাপের ফাটল দেখা গেল, যা উত্তরোত্তর বাড়তে থাকল। বাপিদার সঙ্গে সম্পর্ক বেশ জমে উঠেছিল। ঘনঘন বাপিদার বাড়ি যাই। কখনও পড়াতে বা কোচিঙের প্রচার সংক্রান্ত কাজে, আবার কখনও স্রেফ আড্ডা মারতে। বাপিদার মাকে কাকিমা বলি, বাবাকে কাকু, তারা আমাকেও বেশ পছন্দ করতে লাগলেন। গেলে পরে চা, এটা-ওটা খেতে দিতেন। বাপিদাও মাঝেমধ্যে আমাদের বাড়ি আসত। এমনিতে আমাদের বাড়ি কেউ এলে অপ্রস্তুত হওয়ারই আশঙ্কা, কারণ সচ্ছলতার ছাপওয়ালা সাজানো-গোছানো বাড়ি তো আমাদের ছিল না, বরং উল্টোটা। কিন্তু তা সত্ত্বেও বাপিদার ক্ষেত্রে কোনও সঙ্কোচ ছিল না, যেন ঘরের লোক। দরিদ্র হলেও  দারিদ্রের প্রকাশে আমার আপত্তি ছিল। একবার স্কুলে, তখন ক্লাস টেনে পড়ি। শ্রীগুরু আশ্রম থেকে দুঃস্থ ছাত্রদের খাতা, পেন দেবে বলে ক্লাসে এসে তড়িৎ স্যার ছাত্রদের মধ্যে থেকে নাম চাইলেন। সুজিত বলে একটি ছেলে আমার নাম প্রস্তাব করল। আমি তখন দুঃস্থের মধ্যেই পড়ি। আমাকে দেখেও তা মনে হওয়াই স্বাভাবিক। স্কুলব্যাগ কেনার সামর্থ ছিল না বলে প্লাস্টিকে করে বই নিয়ে যাই। একটিমাত্র স্কুলের প্যান্ট। কিছুদিন আগেও হাওয়াই চটি পড়ে স্কুলে যেতাম। কিন্তু ক্লাস নাইনে ওঠার পর সুবিমল স্যার হেড স্যার হয়ে কেডস পরে যাওয়া বাধ্যতামূলক করলেন। ফলে আমার হাওয়াই চটি পরে যাওয়া বন্ধ হল। কিন্তু তড়িৎ স্যারের কাছে সুজিতের প্রস্তাবের বিরোধিতা করলাম। 

স্যার বললেন, “তোর তাহলে খাতা-পেনের দরকার নেই?”

বললাম, “না স্যার দরকার আছে, কিন্তু আমার মনে হয় আমার চেয়েও দুঃস্থ ছাত্র আছে।” 

স্যার আর কোনও কথা বাড়াননি।

তো, যাইহোক অল্পদিনেই যেন বাপিদার পরিবারের একজন হয়ে গেলাম। বাপিদার মাসির বাড়ি বর্ধমানের সমুদ্রগড়ে। কালীপুজো উপলক্ষ্যে সেখানেও আমি, বাপিদা ও কিংশুকদা গেলাম। কাছেই গঙ্গার কাছে নবদ্বীপে গিয়ে পোড়া মা-তলা ও সোনার গৌরাঙ্গ দেখলাম। খুব আনন্দ হয়েছিল সেবার।

কিন্তু একটা জিনিস লক্ষ্য করে মনে অশান্তি বাড়ছিল। যে উদ্দেশ্যে বাপিদার সঙ্গে সম্পর্কের সেতুর সূচনা, তাতে যেন বাপিদার উৎসাহে ভাটা। যাকে দেখে আমি নিজেই উদ্বুদ্ধ হব ভেবেছি দেখি তারই মোটিভেশনের অভাব।  

একটি নামী সংস্থা থেকে বাপিদা কম্পিউটার শিখেছে। হার্ডওয়ার ও সফটওয়ার দুটোই।  ফলে সুচেতনা স্টাডি সেন্টার ছাড়াও বাপিদার নিজস্ব কিছু কম্পিউটারের ছাত্রছাত্রী ছিল। আর ছিল বাপিদার কম্পিউটার সংক্রান্ত কাস্টমার। বাপিদা কম্পিউটারের বিভিন্ন সরঞ্জাম এসেম্বল করে বিক্রি করত। ক্রেতাদের আবার পরবর্তী সার্ভিস দিতে বা কারও কম্পিউটার বিকল হলে সারাতে যেত। সেই সময় যদি আমি কাছে থাকতাম তবে আমাকেও বাপিদার সঙ্গে যেতে হত। আমি বাড়ি যেতে চাইলে বলত, “চল না, বেশি ক্ষণের তো কাজ না, বাড়ি গিয়ে কী করবি?”

বাপিদাকে বেশ পজিটিভ মনে হয়েছিল। ফলে সাহচর্য ভাল লাগত এবং মনে কষ্ট দিতে চাইতাম না বলে দৃঢ়ভাবে ‘না’ করতে বাধত। বাপিদার প্রয়োজনে এখানে ওখানে সঙ্গে যেতাম। কিন্তু উপলব্ধি করলাম যে লক্ষ্য থেকে সরে আসছি যেন, আমার সময় নষ্ট হচ্ছে। লক্ষ্যটা ছিল একসঙ্গে সরকারি চাকরির পরীক্ষার প্রস্তুতি। কিন্তু বাপিদার যেন সে ব্যাপারে উৎসাহে ভাটা।

ছোটনদার বাড়ি যেদিন গিয়েছিলাম ছোটনদার বাবা মানে জ্যাঠামশাই আমাকে এক উপদেশ দিয়েছিলেন। বলেছিলেন, “দেখিস বাঁশের চেয়ে কঞ্চি যেন বড় না হয়ে যায়।” অর্থাৎ লক্ষ্যের চেয়ে উপলক্ষ্য যেন বড় না হয়। আমার সেই উপদেশ মনে ছিল। 

তবে বাপিদার কাছে আমার কৃতজ্ঞতার শেষ নেই। সরকারি চাকরির প্রিলিমিনারি পরীক্ষার উত্তর করার ব্যাপারে বাপিদা আমাকে মূল্যবান পরামর্শ দিয়েছিল। প্রিলির প্রশ্ন হত এম.সি.কিউ. ধাঁচের। প্রতি প্রশ্নের সঙ্গে প্রদত্ত চারটি সম্ভাব্য উত্তর এবিসিডি-র মধ্যে থেকে  সঠিকটা বেছে নিয়ে উত্তরপত্র বা ও.এম.আর. শীটের ডিম্বাকৃতি অংশ ভরাট করতে হবে। ভুল  উত্তরের জন্য নেগেটিভ মার্কিং আছে। আমি বাপিদার সঙ্গে মেশার আগে প্রশ্নপত্রের একেকটি উত্তর বেছে ও.এম.আর. শীটে একটা করে ওভাল কালি করতাম। ফলে সময় বেশি লাগত। বাপিদা বলল, “ও.এম.আর. শীটে ব্ল্যাকেন করার জন্য হাতে কুড়ি-পঁচিশ মিনিট রাখ। এবার প্রশ্নপত্র ভাল করে পড়ে কোন উত্তর হবে সেটা খুঁজে রাখ, পেন্সিল দিয়ে প্রশ্নপত্রে দাগা। অঙ্কের ক্ষেত্রে রাফওয়ার্ক করে উত্তরটা বার করে রাখ। শেষ কুড়ি-পঁচিশ মিনিটে প্রশ্নপত্র দেখে ও.এম.আর.-এ সঠিক উত্তরটা ব্ল্যাকেন করতে হবে। সময় বাঁচাতে চার-পাঁচটা প্রশ্নের উত্তর একেক বারে দেখেও কাজটা করা যায়।” 

বাপিদার পরামর্শ ম্যাজিকের মতো কাজ দিল। 

কিন্তু বাপিদার লক্ষ্যচ্যূতি আমার মনখারাপের প্রধান কারণ ছিল না। ক্লাস নাইনের তিন-চার জনের একটা ব্যাচ গড়ে উঠেছিল। তারা শুধু সায়েন্স পড়ত। খেয়াল করে দেখলাম  এই ব্যাচটা আমাকে পড়াতে দেওয়া হচ্ছে না। শিক্ষাগত যোগ্যতায় আমি ওদের থেকে বেশি সে কথা না হয় বাদই দিলাম, কিন্তু আমার অন্যতম প্রিয় বিষয় অঙ্কের অন্তত একটি বিভাগ যেমন বীজগণিত, পাটিগণিত বা জ্যামিতি কিছুই পড়ানোর অধিকার নেই আমারই গঠিত কোচিঙের একটি গুরুত্বপূর্ণ ব্যাচে— এটা ভুলে থাকা আমার পক্ষে সম্ভব হল না।  

 যেকোনও কাজেই একজন টিমলিডার থাকলে কাজটা সফলভাবে এগোয়। আমাদের কোচিঙেও বাপিদা অলিখিত লিডার। ফলে বাপিদার সম্মতি ছাড়া আমার পক্ষে কোনও ব্যাচের  বিশেষ কোনও বিষয় পড়ানো সম্ভব ছিল না। অথচ বহু ছাত্রছাত্রীকে আমি সায়েন্স পড়াতাম। স্পেশালিস্ট হিসাবে মাধ্যমিকে শুধুমাত্র অঙ্ক করানোর টিউশনিও আমার ছিল। ফলে এই মনখারাপের ফাটলে যেন ডিনামাইটের বিস্ফোরণ ঘটল। শুধুমাত্র টাকার কারণে অপমান হজম করে টিকে থাকা আমার ধাতে ছিল না। ফলে একদিন বাপিদাকে সরাসরি অনুরোধ জানালাম যে মাধ্যমিকের ব্যাচটাকে আমাকে অন্তত একটা বিষয় পড়াতে দেওয়া হোক। অঙ্কের কোনও একটা  বিভাগ বা ভৌত বিজ্ঞান কিছু একটা দিলেই আমি খুশি। কিন্তু বাপিদা তাতে রাজি হল না। আমি কারণ জানতে চাওয়ায় বাপিদা যে উত্তর দিল তাতে আমার চোখ ফেটে জল এল। আমি বিজ্ঞান পড়ালে নাকি ছাত্রছাত্রীদের ক্ষতি হবে। অভিভাবকদের তরফ থেকে নাকি এই কথা বলা হয়েছে। 

এই অপমান সহ্য করা আমার পক্ষে সম্ভব ছিল না। ফলে সুচেতনা স্টাডি সেন্টার ছেড়ে দিলাম। স্বাভাবিক ভাবেই বাপিদা, কিংশুকদা, বাপিদার পরিবারের সকলের  সঙ্গই আমাকে ছাড়তে হল। প্রেমে বিচ্ছেদের মতনই অসম্ভব যন্ত্রণায় ক’টা দিন কাটল। ঠিক করলাম গ্রুপ স্টাডি ছাড়া আর কোনও যৌথ প্রয়াসে মাথা গলাব না। নিজে টিউশনি করব আর যে করেই হোক আমাকে একটা সরকারি চাকরি পেতেই হবে। 

(আগামী সংখ্যায়)









********************************************************************************************************


উপন্যাস * দীপংকর রায়





['স্বরবর্ণে'র চতুর্থ সংখ্যা থেকে শুরু হয়েছে কবি দীপংকর রায়ের আত্মজৈবনিক উপন্যাস ' কথা দিয়েছিলাম হেমন্তের নিয়রে '। এই উপন্যাস লেখকের ষোল-সতের বছর বয়সের কালপর্ব থেকে শুরু। যদিও লেখকের জন্ম এপার বাংলায়, কিন্তু শিকড় ছড়িয়ে থেকেছে ওপার বাংলায়। কাজেই যাতায়াত থেমে থাকেনি। ইতিমধ্যে ১৯৭১ সালে রক্তক্ষয়ী লড়াইয়ের পর বাংলাদেশ স্বাধীন হয়। সদ্য স্বাধীনতা পাওয়া একটি দেশ ছেড়ে চলে আসা আর তারই নাছোড় এক টানাটানির মধ্যে যে জীবনের ক্রমাগত আসা আর যাওয়া ,এই উপন্যাস মূলত তারই এক নির্মম নিষ্ঠুর ভাঙা-গড়ার আশ্চর্য কথোপকথন। ধারাবাহিকভাবে যা আমরা পড়ছি, কবি দীপংকর রায়ের মায়াময় কলমে।]



কথা দিয়েছিলাম হেমন্তের নিয়রে 

পর্ব * ১১   

দীপংকর রায়


এদেশের অনেক অভ্যাসের সঙ্গেই অভ্যস্থ হয়ে উঠছি । লুঙ্গি পরার অভ্যাসটাও পাল্টে গ্যাছে — পাজামা পাঞ্জাবী পরছি ।

         ক্লাস নাইনে উঠেই বায়না ধরে হাফপ্যান্ট ছেড়ে লুঙ্গি পরেছিলাম দিদিমার ইচ্ছার বিরুদ্ধে যেয়েই খানিকটা । তার আগে সে অর্থে হাফ প্যান্ট আর কোথায় ? সে তো চুয়াত্তরের মন্বন্তরে  ইউনিসেফের ছাতুর বস্তার কাপড়ের প্যান্ট জামা পরেই রোজ ধুয়ে সেই দিনই শুকিয়ে পরের‌ দিন আবার সেইটাই পরে স্কুলে যাওয়া ।

           এ ছাড়া স্বাভাবিক ভাবে বাইরের জামাকাপড়ের ভেতরে ভালো জামা প্যান্ট বলতে জাপানি টেরিকটনের কাপড়ের তৈরি জামা প্যান্ট একটা করে সেট পেতাম পুজোর সময় । সেটাই চলত বাইরে কোথাও বেড়াতে বা ঘুরতে গেলে । গ্যাবাডিন উঠেছিল তারও পরে । সেও পরেছিলাম কবে যে তা মনে নেই ।তবে, সেবারে চুয়াডাঙ্গায় মাসি বাড়ি গেলে এক সেট গ্যাবাডিনের সাফারি সুট তৈরি হয়েছিল । এবং সেটার মায়া আছে এখনো । ওদেশে গেলে  নিয়ে আসবো ইচ্ছা আছে । 

        যাই হোক , সেই ধারাবাহিকতাই চলে আসছিল ওদেশ

ছাড়বার আগের মুহূর্ত পর্যন্তও । আর সব ফেলে আসলেও লুঙ্গির অভ্যাসটা ফেলে দিতে পারি নি । তবে এই কয়েকদিন হোল নানাজনের টিপ্পুনি ঠাট্টার দৌলতে এবারে লুঙ্গি ছেড়ে ঢোলা পাজামা পাঞ্জাবীতে পুরোনো অভ্যাসটা পাল্টে ফেললাম একদিন । 

            মা ওদেশে যাবার আগে‌ যদিও দু সেট বানিয়ে দিয়েছিল । সেটাই পাল্টাপাল্টি করে পরি এখন । সব শুদ্ধু ঘরে বাইরে মিলে , তিন চার সেট তো এর মধ্যেই ;  দিদি , মা মিলে এই সামান্য কদিনের মধ্যে‌ আর কতোই বা লাগে ?

           মাঝে মাঝে মনে হয় না যে তা নয় , ভীষণ মনে হয় , মনে মনে ভাবতে থাকি কত কিছু ; এই সামান্য কয়েক মাসের মধ্যে জীবন যাপনের সমস্ত ধারাবাহিকতা এত তাড়াতাড়ি কীভাবে যে পাল্টে ফেললাম ! কীরকম ভাবে যেন এখানকার সব অভ্যাসের সঙ্গেই নিজেকে ধাতস্থ করে তুলেছি একটু একটু করে ।

            আর এ সব কথাবার্তা ,ভাব বিনিময় , মনে করাকরি সবই —--সেই আমাদের রাতের বারান্দা জানে । আর জানে সেই সব রাতের নিস্তব্ধতা ; ওদিকে ওই ঝাউগাছের সরিরাও ;  খোলা আকাশ জানে আমার অনেক কথাই  হয়তো ! 

           এই যে মোড়া পেতে চুপটি করে বসে থাকা , মাথার উপর একটি একশো পাওয়ারের বাল্ব জ্বলছে । কাজের দিদি ওদিকে ঘরের ভেতরে ঘুমিয়ে আছে । আর আমি এই মোড়া খানির উপরে বসে বসে ভেবে চলেছি কত কিছুই না ! আমার এই সব পরিবর্তন , তার সঙ্গে আর একটি কথাও যেন অত্যন্ত গোপনে ভেবে চলেছি । আচ্ছা সেই গোপন কথাটি কী ? কে সে ? কার কথা ভাবছি ? 

        আচ্ছা , সে কি নবগঙ্গা নদীর পাড়গুলি ?

         নাকি ঠাকুরনালার মাঠ ?

         বাবুদের কলুপে আমতলার দুপুর বেলার নিস্তব্ধতাও কি ?

        হয়তো এ সবের সব কিছুর সঙ্গে ওখানকার সমস্ত প্রকৃতি জুড়ে যেয়ে যে সব নানা বুনো গন্ধ পাঠায় আমাকে ;  আমি এমন এক বর্ণে গন্ধে তাকে মানুষ রূপেতেই যেন অনুভব করি শেষে । আর একথাও বুঝতে পারি , তাকে যদি  না ছেড়ে আসতাম তাহলে মনে হয় এমন ভাবে তাকে আমি অনুভব করতে পারতাম না হয়তো । 

        

       এই সব কিছুর আড়ালে কি আরো কিছু সহজ সরল সম্বন্ধের চোরা টান রয়েছে — এমন কোনো মুখকে ঘিরে , যাকে  এমন কোনো রূপ ও মাধুরীতে সাজিয়ে ফেলেছি অজানায়,অবচেতনে , তাকে এমন কোনো বিশেষ রূপ দিয়ে ফেলেছি , যাতে তার সঙ্গে ভাব বিনিময় করতে বা কথা বলাবলি করতেই তাকে আমি চাই বুঝি এই রাতে —--- এই বারান্দায় , এই হিমেল হাওয়ার ভেতর তাকেই ফিরে চাইছি ? তাকে  এমন এক কল্পবিশ্বে  চালান করে , আবার তাকেই চাইছি নিতান্ত কাছের মানুষের মতন করে !

        এই সুখানুভুতি , এই অনুভব করা সেই মানবীকে দেখতে কেমন ?

         সে কি নতুন মামিমার মতন ? ছদ্মবেশে আমার কাছে ভেসে আসছে ! 

            নাকি সেই চুল ছেড়ে ঘুরে বেড়ানো মেয়েটি —--- যে আমায় বর্ষামুড়ি ছাতা মাথায় দিয়ে খুনসুটি করে নিত্য সঙ্গ  দিত যে ? 

             মামাদের নৌকাখানির উপরে বসা সে তো আর কেউ না সে তো সেই কল্যানী ! 

            আবার ভাবতাম , ধুস ! সে হবে কেন ? সে তো এদের কারোর মতনই না ! 

             তাহলে , তার পরিষ্কার চেহারাটি কি দেখতে পাচ্ছি আমি আরো পরিষ্কার ভাবে ?

               কই , তাও তো না !

               সে যে ঝাপসা ,ভাসা ভাসা , একটি অস্পষ্ট রূপ শুধুই— যাকে আজকাল   প্রায়শই নিজের অজান্তে নিজেই বানিয়ে তুলি , এই রাতের বারান্দায় একা একা !

                বুঝতে পারি না সবটা ।

তখন আপন মনে বলি , তাহলে মনে হয় আমার মন ভেতরে ভেতরে এমন কাউকে চাইছে কাছে , যে এসে সামনে দাঁড়ালেই অফুরন্ত আনন্দ ।

                ঠিকই তো , সে এসেই তো আজকাল মাঝে মাঝেই আমার ভাবনার জগতে ডানা মেলে ভেসে বেড়াচ্ছে ! খুব বুঝতে পারছি সেটা । অথচ , এ কথা তো কাউকে বলা যাবে না ! আজকাল তো সে এসে ঘুমের ভেতরেও নানা রূপে  ধরা দেয় । অনেকক্ষণ আমার পাশে এসে মাথার কাছে বসে থাকে । সে এমন করে তার দুটি হাত প্রসারিত করে আমার বুকের ভেতর যেন ডুবিয়ে দেয় ; তখন আমার মনে হয় , এই তাকে যদি আমার ঘুমের বাইরে টেনে এনে পাশটিতে বসাতে পারতাম , আর একটু কাছাকাছি , তাহলে যে কি আনন্দই না হতো আমার ! 


            রাত বেড়ে যেত এমন সব বিচিত্র ভাবনা ভাবতে । এমন সব জগতে ঘোরাঘুরি করতে করতে । মাঝে মাঝে মুরগির ঘরের নিচের থেকে গোরু গুলির শুয়ে পড়ার নিঃশ্বাসের শব্দে আমার যেন সম্বিৎ ফিরে আসত । সেই সব ঘোর ভেঙে প্রকৃতস্থ হতাম । 

                উঠোনের ঘাস-জঙ্গলের মাথায় শিশির পড়ে লাইটের আলোয় ,অন্ধকার মিলেমিশে সে এক এমনই গন্ধ ভেসে আসতো নাকে ,তার বর্ণনা করা সম্ভব না কোনো কিছু দিয়ে‌ । তার ভাষা আমি আয়ত্ব করতে পারি নি এখনো । 

                    ওপাশের গর্তটায় কচুরিপানাগুলি ইদানিং বেশ জমাট বেঁধে উঠেছে এরই মধ্যে কবে যেন । তাতে রাস্তার লাইট পোষ্টের আলো পড়ে বেশ এক অদ্ভুত আবহ তৈরি হয়ে উঠেছে । আমাকে আমার মনোনিবেশে টেনে নিত নিজের মনে নিজেই যেন —--  আমার এই সব নানা কথা কওয়াকয়ির ভেতর অদ্ভুত সব বীজ বুনে দিত । অথচ তাদের সব জাত গোত্রের সঠিক ঠিকানা আমার নিজের কাছেও নেই । 

            ওপাশে এই বাড়ির বর্তমান সীমানা ঘেরা রাংচিতের গাছগুলিও মুলি বাঁশের বেড়ার গায়ে গা লাগিয়ে উঠে এসে বেশ মাথা ছাড়িয়ে গ্যাছে কত তাড়াতাড়ি ! তারাও একাকী একার মতো হাওয়া বাতাসে কেঁপে কেঁপে ওঠে যে, তা দেখতে পাই। 

            এর আগে এসব চোখে পড়েনি কি ! পড়েছে । তবে আজ যেন একটু অন্যরকম ভাবে চোখে পড়ল । 

               এসব তো এই রাতের বেলাতেই ধরা পড়ে বেশি করে ! 


          কদিন রাণিয়ার মাঠে যাওয়া ছাড়া বিকেল ও সকাল বেলার আড্ডাতে একটু ভাটা পড়েছে । ওই সময় গুলিতে ওরাও যেমন আসছে না রোজ , তেমন আমিও যেন তেমন একটা মন থেকে চাইছি না এতটা সময় নষ্ট করতে । তাই সকাল বেলাতেই হাঁটতে বেরিয়ে একটু ঘুরিয়ে বলে দিচ্ছি যেন, আমার ইদানীংকার ইচ্ছা অনিচ্ছার কথাগুলি । বলে দিচ্ছি একটু কায়দা করে , আমার নিজের কোনো কাজ হচ্ছে না ভাই , অনেক কাজ করতে হবে , কদিন একটু সে সবের মধ্যেই থাকতে হবে ভাবছি । একা কাজের দিদির উপরে সব দায় ছেড়ে দিয়ে নিশ্চিন্তে বসে থাকতে চাই না আর ।তাছাড়া পড়াশোনাও কিছুই তো হচ্ছে না । শুধু গেঁজিয়েই সময় কাটিয়ে দিচ্ছি । 

           এই সবটাই মিলিয়ে মিশিয়ে যেমন করে বলি আর কি , এখানের এবং ওখানের ভাষায় মিলিয়ে মিশিয়ে , তেমন করেই বললাম যদিও তবে একটু কায়দা করে ঘুরিয়েই যেন —-।

           এই যে ঘুরিয়ে কথা বলার কায়দাটি আয়ত্ব করেছি ইদানীং, তাও তো এখানে এসেই ! 

            মনে হচ্ছে প্রতিদিন অনেক সময় অপচয় করে ফেলেছি ইতিমধ্যেই ।

সকাল বিকেল আড্ডা দিয়ে সময় অপচয় করে ফেলেছি অনেক । সে সব এখন আর ভালো লাগছে না তেমন । কে যেন আমার ভেতরে আপন মনে আপনাআপনিই যেন বলে দিচ্ছে নিতান্ত স্বার্থপরের মতোন এসব বাদ বিবাদ করে তোমার কী হবে ? তুমি তো এমনিতেই অনেক পিছিয়ে রয়ে গেছো । তাই যা করতে চাইছো এখন সেটাই একটু মন দিয়ে করো না কেন! 

               কিন্তু কীভাবে করলে সে কাজ হচ্ছে বলে মনে হবে ? আর সেই কথাটি আমাকে কেই বা বলে দেবে ,'এই ভাবে এগিয়ে যাও , তাহলেই ঠিক হবে সবটা । ' 

                কেমন হলে আমি বুঝতে পারবো , হ্যাঁ , এবারে এগোচ্ছি বলেই মনে হলো তো ! 

             যদিও সে কথা বলে দেবার মতোন কেউ নেই । সত্যি কথা বলতে গেলে তো বলতে হয় , এরা কেউই তো আমার মত অকাজের কাজ নিয়ে পথে নামে নি ! এমন ব্রত কি কেউ নিয়েছে এদের মধ্যে একজনও ?

               এরা তো সকলেই সেই নিয়মের পথেই চলেছে —-  যেভাবে চললে জীবন একটা নিশ্চয়তা পায় । সত্যি সত্যিই পায় কি ? 

               আমার জীবনের পথে‌ কীভাবে সেই নিশ্চয়তা আসবে ? আমি কি এই গো পালন করেই  জীবনের কর্মের পথটি তৈরি করে নেবো ! লেখালিখি করে তো আর বেঁচে থাকা যায় না । লিখে কি অর্থ পাওয়া যাবে ? তা ছাড়া সে কথা তো মনেও আসে না কখনও ।


                 এই প্রথম জীবনটাকে নিয়ে ভাবতে বসলাম যেন।আর যখনই এই সব ভাবনা মাথায় আসে ,  তখন বিশেষ কোনো সমাধানের পথ ধরে এমন কোনোখানেই পৌঁছতে পারি না যেমন , তেমন , সে সব নিয়ে যে খুব একটা ছটফট করি তাও তো না ! কেমন করে যেন নিজের মধ্যে নিজেই গুটিয়ে যাই । কারো সঙ্গই ভালো লাগে না তখন । এমন কি কাজের দিদির সঙ্গেও কথা বলি না সে কদিন তেমন একটা । অন্য আর সকলের সঙ্গেও তেমনই করি । এরা কেউ এলেও একই । ধরা দিতে চাই না । এমন একটা ভাব করি যেন , আমি এখন ব্যস্ত আছি আমার মতো । ভীষণ কাজকর্ম নিয়ে ব্যস্ত আছি , লেখা পড়া নিয়েও , একদম কথা বলার মতন নেই ।

                 এই সব এমনভাবেই বুঝতে চাইছি । মনে হচ্ছে জীবনের নিশ্চয়তার কথা । সত্যিই কি নিশ্চয়তা আছে কোথাও ? তাও কেন যেন মনে হচ্ছে এসবের কোনো পথেই নেই কিছু । কারণ এদের‌ মতোন আমি তো না ! তাহলে কেনই বা শুধু শুধু আড্ডা মেরে সময়গুলি এভাবে নষ্ট করবো ? আর এই ভাবনাটা যত তীব্রতা পাচ্ছে ততোই আমি আরো বেশি করে একা হচ্ছি । আজকাল থেকে থেকে কেবলই মনে হয় , কিছুই তো হোল না আজ ? খালি খালিই দিনটা চলে গেল ! 

        সময় এভাবেই আমাকে বুঝিয়ে দেয় আজকাল । যেন লক্ষ্য করতে শেখায় , ভীষণ এক অস্থিরতা তৈরি করে ভেতরে ভেতরে । আর আমি তাকে যতোই লক্ষ্য করতে লাগলাম ততোই আরো বেশি করে অস্থির হোতে লাগলাম । এই অস্থিরতা এমন এক পর্যায়ে পৌঁছালো— যে , এবার আমি একা একা উদভ্রান্তের মত পথে পথে ঘুরতে লাগলাম ।

         এরা কিছু মনে না করে , কদিন এসেওছে আমার খোঁজে। পায় নি । 

           ও বাড়ির ফোচনের ঠাকুমা দুবেলা এসে বলে যেতে লাগলো , শোনো ভাই , কইতাসি কি তুমি এরকম সারাডা দিন কমনে কমনে হাইটে বেড়াবা , ক্যান , সেইডা কও দেহি ? তোমার মায় এহানে নাই , এই বেচারির কথাডা একবার ভাইবা দ্যাহো দেহিনি , সে যে ভাইব্বা  ভাইব্বা সারা হয় , শ্যাষে আমারে জিগায় , ভাই আমার কুথায় কুথায় ঘোরে , ঘুরে ঘুরে সন্ধ্যেবেলায় বাড়ি ঢোকে, আচ্ছা কন দেহি দিদি , না নাইয়া না খাইয়া এইডা কি আরম্ভ করছে ?  আমিও কই হেইডাই — কি করতাছ কি তাই কও দেহি নি আমারে একবার ! 

       উত্তর দিই না চুপ করে ঘরের ভেতরে চলে যাই মাথা নিচু করে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে তার কথাগুলি বলা হলে । খানিকক্ষণ চেয়েও থাকি তার দিকে । তবে কিছুই বলতে পারি না ।

         ফোচনের ঠাকুমা তার পরেও অনেকটা সময় বসে থেকে কাজের দিদিকে বলে , অরে খাইতে দেন তো দিদি । আমি সামনে বসে এইডারে খাওয়াইয়া হ্যার পরে যামু ক্ষণ  যেহানে যাবার থায়ে —- 

         পথে চলতে চলতে এমন ঠাকুমা দিদিমা খুড়িমাদের কত যে দেখা পেয়েছি তা বলতে গেলে শেষ হবে না যেন একটুখানি সময়ে । তাঁদের আন্তরিকতা ভালোবাসার কত বিচিত্র প্রকাশ দেখে ,  এক একসময় আশ্চর্য হয়ে তাকিয়ে থেকেছি কতোই না বিস্ময়ে — মনে হয়েছে সত্যিই তো , এর চাইতে আপনার জিনিস  কি আর আছে ! তখন আমার ভেতরের সব অস্থিরতা মুহূর্তের ভেতর একেবারে যেন শীতল হয়ে গেছে । আমি আবার ছন্দে ফিরে গেছি । যে ছন্দ সংসার চায় ? খানিকটা নীরবে দাবি করে হয়ত । ফোচন কাবেরীর ঠাকুমা তখন আমার আপন ঠাকুমা হয়ে সামনে দাঁড়িয়ে যায় । তাঁদের সকলের নির্দেশ তখন আর উপেক্ষা করে থাকতে পারিনি — অধিক স্নেহে ভালোবাসায় গ্রহণ করেছি মাথা পেতে ।

       এরপর থেকে ও বাড়ির ঠাকুমা দুবেলা এসে অনেকটা সময় কাটিয়ে রোজকার খোঁজখবর নিতে লাগলো যেমন, তেমন কাজের দিদির সঙ্গে আবারও লুডুর কোট বসিয়ে দিল । তাতে যোগ হোল পাশের বাড়ির কাল্টুর ঠাকুমাও । কাবেরী সরবরীও। শিবানী মলিও । তাছাড়া এমনিতেও বিকেল বেলার দিকটায় ইদানীং বেশ কিছু মানুষজনের সমাগম হচ্ছে যেন একটু বেশিই । কারণ নতুন গোরুর দুধের খরিদ্দার অনেক হয়েছে । এর আগে যেরকম ঘরে অনেকটা দুধ প্রয়োজনের থেকেও বেশি থেকে যেত , এখন আর সেটা সেরকম অধিক কিছু থাকছে না । ঘরে ব্যবহারের দুধটাও পারলে নিয়ে যেতে চায় সকলে । আর সেইসব নিয়ে কাজের দিদির সঙ্গেও বেশ কিছু গাহাকের কথা কাটাকাটিও শুরু হয়ে যেতে দেখছি । অর্থাৎ আরো একটা গোরু হলেও যেন ভালো হয় । কালো গোরুটি দিন দিন দুধ দেওয়া কমিয়ে দিচ্ছে । যদিও সে জায়গাটা লালটি পূরণ করলেও চাহিদার কাছে তা  কম পড়ে যেতে চায় ।

         রমনীদার দোকান থেকে গোরু বাছুরের খাবার দানাভুসি নিয়ে আসি রিক্সা করে । কিছুদিন হোল এই মানুষটি ও তার বৃদ্ধ বাবা বেশ খানিকটা  আপনজন হয়ে গেছে — কাছে টেনে ধরে বসায় । তার বাবা তো গেলেই তার মুদিখানার দিকটায় কাছে বসতে ডাকাডাকি করে । গল্প জুড়ে দেয় । তাঁদের দেশের গল্প বলে খুব আবেগবিহ্বল কন্ঠে । তাঁরা কীরকম ভাবে কুমিল্লার মেহের কালীবাড়ির কাছে বড়ো হয়েছে । কী সব সুখের দিন ছিল তাঁদের ! কোন কিছুরই কমতি ছিল না  । গোলাভর্তি ধান ,পুকুরভর্তি মাছ , খানিকটা এগিয়ে গেলেই নদী — নদীতেও মাছের যোগান অফুরন্ত । শাকপাতা কি কিনে খেয়েছে নাকি মানুষজন ? সে সব তো আদাড়েবাদাড়ে আতোজালাই গজিয়ে উঠত । এই যে লাউডাই 

কও , আর চালকুমড়াডাই কও , মিষ্টি কুমড়াডা , কাঁকরোল, ডাটা শাকডা , কলমি , ওল কচু ,আম কাঁঠাল, তরমুজডা, বাঙি, এ সব  তো সামান্য একটু বীজ পুইত্তা দিলিই গজায়ে উঠত ! সারের দরকার ছিল না এহেনের মতো । কও , ছিল দরকার ? 

     বলতে বলতে কখন আবার আমাকেই জিজ্ঞাসা করতো । 

     আমিও কখন তাঁর সেই সব জীবনের অংশীদার হয়ে উঠতাম! ফিরে যেতে শুরু করতাম এই সব কথাবার্তার ভেতর দিয়ে সেই দেশটায়, যেখান থেকে একদিন এঁরা নানা আতঙ্কে ভয়ে পালিয়ে চলে এসেছিলেন । সাতচল্লিশে না পঁয়ষট্টিতে ,  তা ঠিক শোনা হয়নি কখনো । আচ্ছা আমি তো কোনো ভয়ে বা আতঙ্কে ওই দেশটা ছেড়ে আসিনি ! তাহলে কেন চলে এলাম ? 

       একদিন যেমন খুব একটা গভীর কারণ ছাড়াই যেতে হয়েছিল , এখন আবার তেমনই বিশেষ কোনো কারণ ছাড়াই চলে এলাম । খানিকটা তো অলিখিত ভাবে বর্ডার পালিয়ে রোমাঞ্চিত হবো বলেই কাইলে মামার সঙ্গ নিয়েছিলাম ! আর সেই জন্যেই হয়তো এঁদের দেশ ছাড়ার সেই বেদনাবোধটা আমাকে খুব একটা ছুঁতে পারে না এঁদের মতোন । আমার চোখে একটা মাটি ছেঁড়াছিড়ির যন্ত্রণাবোধ যা — তাতো এই সেদিনের, একাত্তরের কথা খানিকটা । তাও তো আবার ফিরে পাওয়া সেই দেশটাই । তবুও তো সেই দুঃসহ দিনগুলিকে কি ভুলতে পেরেছি আজও ? 

      তারপরেও যেন মনে হয় একাত্তর দিয়েই সবটা হয়তো অনুমান করা যাবে না । তাও সেই দিনগুলির কথা কি ভুলতে পেরেছি আমি ! সে সময় তো শুধু হিন্দুধর্মাবলম্বীরাই চলে আসেনি শুধু এদেশে , অনেক মুসলমানও তো পরিবার পরিজন সহ চলে এসেছিল!


*********************************************************************************************

আগামী পর্বে

**********************************************************************************************