নন-ফিলজফিকাল আত্মহত্যা ও ক্রোমোজোমাল সিম্ফনি
দেবার্ঘ সেন
অখিলেশ সুর সম্পাদিত 'ঋকবেদ' পত্রিকার বিশেষ 'সাক্ষাৎকার সংখ্যা'য় বাংলা কবিতার মহাজাগতিক কবি শম্ভু রক্ষিত-এর এক সাক্ষাৎকার প্রকাশিত হয়েছিল, যেখানে তিনি বলেছিলেন—" কবি চান বা না চান, যে কোনো কবিতাকর্মের প্রধান লক্ষ্য পাঠকের সঙ্গে সংযোগ স্থাপন। প্রাথমিকভাবে হয়তো কবির কিছু আসে যায় না। বিশ্বসংসারে তাঁর কীর্তি কতজনের হৃদয়ে কী বার্তা পৌঁছে দিল সে নিয়ে তিনি বিন্দুমাত্র ভাবেন না। কিন্তু মজার কথা এই, তার অজ্ঞাতসারে কাজটি ঘটে যায়। সংযোগ স্থাপিত হয়— এটাই অনিবার্য এবং তা দু'ভাবে। প্রথমত— কবিতা যেহেতু বিশ্বজনীন পতনশীলতা এবং অসঙ্গতির মধ্যে নিয়ে আসে এক পরম সাযুজ্য ও সংহতি অতএব এইভাবে নিজের যথার্থতা নিরূপণ করাই হয়ে ওঠে কবিতার বার্তা। কিন্তু এছাড়াও আছে আরেকটি দিক। তুমুল জাগতিক সমাচারের মধ্যে কবিতার এবং কবিতারই ক্ষমতা আছে হৃদয়কে পরিশুদ্ধ করার। কোনো মহৎ স্তরে হৃদয়কে উত্তরিত করতে একমাত্র কবিতাই সক্ষম।" এখন কথা হলো যে, কবি শম্ভু রক্ষিতের এই অভিমতটি কেন হঠাৎ মনে এলো, তরুণ কবি শুভ্রনীলের কবিতার বই 'নক্ষত্র রঙের আত্মহত্যা' পড়তে পড়তে শম্ভুদার এই কথাগুলিতেই আচ্ছন্ন হতে হয়। শুভ্রনীলের কবিতার যে মহাজাগতিক নিরীক্ষণ আছে তা যেন বিশ্বাস ভেঙে নতুন বিশ্বাসের জন্ম দেয়। যে বিশ্বাসকে স্নায়ুজনিত দিক থেকে বিভেদ করা যেতে পারে। বর্তমানে যে সমস্ত তরুণ কবি কবিতা নিয়ে বিভিন্ন নিরীক্ষা ও অন্বেষণ করে চলেছেন সেখানে শুভ্রনীলের স্বর ও ভঙ্গি বেশ ব্যতিক্রমী, 'মহাজাগতিক মৈথুন' শীর্ষক একটি কবিতায় শুভ্রনীল লেখেন—
' আমার শিরা-উপশিরার অন্ধকার কেটে
পথ খুঁজে নিচ্ছে
সদ্য জন্মানো অ্যামিবার অলিন্দে
ঊরু থেকে হাড় কেটে
আদম বানাচ্ছে
ইভের গুটি হাতে রেখে,
বিশ্বাস
ভয়
কাম
সহস্র বিষ ঢেলে দিল
স্থাবর অবয়ব রক্ষার্থে
ঈশ্বর আমার গা বেয়ে উঠে আসছে
ঘুঙুরের ফাঁকে সমুদ্র
সমান্তরাল মহাবিশ্বের সময়-শেল
পলাশের লাল ভেদ করে
প্রকৃতির সাথে সহবাস'
'মহাজাগতিক মৈথুন' কবিতার উপরিউক্ত অংশটিকে নিয়েই এক দীর্ঘ আলোচনা সম্ভব বলে মনে করি। 'আমার শিরা-উপশিরার অন্ধকার কেটে পথ খুঁজে নিচ্ছে ' এটি যেন কবিমননের নিরীক্ষার এক বিশেষ দিক। এখান থেকে যে স্পন্দ চিহ্নিত হয় সেখানে কবি যেন নিশ্চেষ্ট, অপ্রতিরোধী।
' সদ্য জন্মানো অ্যামিবার অলিন্দে
ঊরু থেকে হাড় কেটে
আদম বানাচ্ছে
ইভের গুটি হাতে রেখে
বিশ্বাস
ভয়
কাম'
এখন এখানে পূর্বপঙক্তির সাথে কবিতার বিবর্তন বেশ লক্ষ্যণীয় ; লক্ষ্যণীয় কবিমনে অ্যামিবার আগমন। এই আগমন কোথাও যেন এক কোশী থেকে আদিমের চরে নিয়ে যেতে চাইছে অথচ তার নির্দেশ ভারাক্রান্ত করছে না। তাই বোধহয় শুভ্রনীল লিখছেন, স্থাবর অবয়ব রক্ষার্থে সহস্র বিষ ঢেলে দেওয়ার কথা—
অনুভূতির দাহ্য-পরীক্ষা কতদূর পৌঁছোলে নির্দ্বিধার মতো উঠে আসে নিঃশর্ত এই স্বীকার যে,
'ঈশ্বর আমার গা বেয়ে উঠে আসছে
ঘুঙুরের ফাঁকে সমুদ্র
সমান্তরাল মহাবিশ্বের সময়-শেল
পলাশের লাল ভেদ করে
প্রকৃতির সাথে সহবাস।'
ভারি অদ্ভূত এই উচ্চারণে কবি যেন আচ্ছন্ন হয়ে পড়েছেন অনাবিল এক ভূতগ্রস্ততায়। সমান্তরালে অকাতরে আচ্ছন্ন করে দিচ্ছেন আমাদেরকেও। অথচ কোথাও কিন্তু ঈশ্বর এতোটুকুও অতিকায় হচ্ছে না। এ যেন বিমূর্ত কথনের অবিচ্ছেদ্য এক ভাঙাগড়ার প্রলয়।
বইটি পড়তে গিয়ে শুভ্রনীলের কবিতার যে অন্যতম বৈশিষ্ট্য পাওয়া যায়, তা হ'ল তার প্রেক্ষণ অন্বেষা। যেমন 'বিভীষিকা গহ্বর' কবিতায় তিনি লিখছেন—' একটা বিভীষিকা গহ্বর/ পারস্পরিক ভাব বিনিময় করছে/ উদ্বেল মেরুদোষ/ প্রবাহ সৃষ্টির অন্তিমে।' লক্ষ্য করুন, এ লেখার মধ্যে তাঁর পর্যবেক্ষণ, যা আমাদেরকে সিক্ত করছে অবক্ষয়ের বিভীষিকায়, যেখানে পরিবেশনের ক্ষেত্রে মাথা ধুয়ে দিয়ে যাচ্ছে উত্তর আধুনিকতার জল।
মনে করাই, এ লেখার শুরুতেই উল্লেখ করেছিলাম কবি শম্ভু রক্ষিতের সাক্ষাৎকারের আংশিক কিছু কথা, যেখানে তিনি বলছেন— 'কবিতা যেহেতু বিশ্বজনীন পতনশীলতা এবং অসঙ্গতির মধ্যে নিয়ে আসে এক পরম সাযুজ্য ও সংহতি অতএব এইভাবে নিজের যথার্থতা নিরূপণ করাই হয়ে ওঠে কবিতার বার্তা'। আর প্রকৃতই অজ্ঞাতসারে শুভ্রনীলের কলমও যেন 'সভ্যতার পোড়া রেক্সিন' কবিতায় সেই দিকটাই স্বতঃস্ফূর্তভাবে ছুঁয়ে যাচ্ছে। এই কবিতার নিম্নে উল্লিখিত কয়েকটি পঙক্তিতেই তা যেন নিবিড় হয়ে আসে।
'সভ্যতার স্ট্যাটাস আপডেট—/ ঢিনচ্যাক ধরনা ও ফর্টিনাইন আদার্স / —ফেসবুক/ টুইটার / ওয়াটস আপ / কান্না হাসি কৌতুক কথা, খরস্রোতা দেয়াল/ কিন্তু / দেনার দায়ে ডুবন্ত চাষা / হঠাৎ কোনো সকালে লক-আউট হওয়া শ্রমিক / সীমান্তে শহিদ জঠরের ফুল/ গণতন্ত্র চুপ! / সভ্যতা বধির। '
ব্যক্তিগতভাবে আমি মনে করি, যে কোনও কবিরই রাজনৈতিক সচেতনতা থাকা ভীষণরকম জরুরি। যা আজ একপ্রকার নেই বললেই চলে, সে কথা থাক বরং শুভ্রনীলের রাজনৈতিক সচেতনতা স্বরূপ একটি কবিতার কথা বলি। '৮/৪ গণতন্ত্র' শীর্ষক উক্ত কবিতায় এই ফ্যাসিস্টিক সময়ে দাঁড়িয়ে তিনি গণতন্ত্রকে কীভাবে দেখছেন এ কবিতার প্রেক্ষিত ও ভাষা তারই প্রকাশ ঘটায়। আপনাদেরকে পড়াতে চেয়ে সম্পূর্ণ কবিতাটিই তুলে দিলাম —
' ৮/৪ গণতন্ত্র
৮/৪ এর একটা কাঠের বাক্স
ওপরে কিছু উল্কি কাটা, হায়ারোগ্লিফিক ডিজাইন
২০০০ বছর ধরে এভাবেই শুয়ে আছি
সঙ্গী কিছু আতর,পুরনো কাঠ-গয়না
না আমি জীবনানন্দের বনলতা নই,
তারও উপক্রম ছিল প্রেমের
আমার মত কাঠ পুতুল নয় সে,
আমাকে লোকে দেখতে আসছে রোজ
কিন্তু আমি কাউকে দেখতে পাইনা, চেষ্টা করেও পারিনা
মৃত্যুর পরও শান্তি দেয়নি ওরা আমায়—
কাঠ পুতুল বানিয়ে রেখেছে হাজার হাজার বছর ধরে ,
ভুল ভাবছো আমি মমি না ,
তোমাদের রোজকার গণতন্ত্র '
এরপর চলে আসি তার 'অ্যান্টি কসমিক' কবিতায়। যেখানে তিনি লেখেন—
' আকাশ থেকে নেমে আসছে—
অতিভুজের সিঁড়ি বেয়ে
শক্তি—
বিপরীত শক্তি—
তরঙ্গ—
অভিকর্ষ—
অ্যান্টি অভিকর্ষ—
সরাসরি যুদ্ধ ঘোষণা X শূন্যের প্লাজমা '
বিস্মিত হতে হয় তাঁর এই বোধে, যেখানে বৈজ্ঞানিক অলংকারকে তিনি ব্যবহার করে স্থাপন করতে চাইছেন তাঁর নিজস্ব দর্শনকে। আর এভাবেই তিনি তাঁর কবিতায় হয়তো অজান্তেই ছুঁয়ে যাচ্ছেন বিনির্মাণের প্রগতি।
কবিতা যেভাবেই লেখা হোক না কেন বা যে ফর্মেই লেখা হোক না কেন আসলে তা দর্শন ব্যতীত কিছু নয় অর্থাৎ তার একটা ফিলোজফিকাল সেন্টিমেন্ট থাকবেই। এখন, এই ফিলোজফির পাশাপাশি উঠে আসে যে টার্ম তা হ'ল 'নন-ফিলজফি' আবার যদি বলি পোয়েট্রি তাহলে উঠে আসে 'অ্যান্টি-পোয়েট্রি'। এ প্রসঙ্গে জানিয়ে রাখা দরকার নন-ফিলজফি যেমন কোনও অ্যান্টি-ফিলজফি নয় তেমনই অ্যান্টি-পোয়েট্রিও আসলে এক ধরণের পোয়েট্রিই। বুঝতে হবে এখানে 'নন' অর্থে কোনও নেগেশনের কথা বলা হচ্ছে না। ঠিক সেভাবেই শুভ্রনীলের 'স্বপ্নের সিঁড়ি ভাঙায়' কবিতায় অদ্ভুত এক বাস্তব বেষ্টিত মিউটেটেড ফিলজফির দিকই যেন উঠে আসতে চায়, উঠে আসতে চায় ক্রোমোজোমাল সিম্ফনি অথবা ডেস্ট্রাকশনের যেন কোনও এক মডেল।
'নক্ষত্র রঙের আত্নহত্যা'য় বেশ কিছু কবিতার পঙক্তি আমাদেরকে ভাবিয়ে তোলার অনিমিখ দাবি রাখে। যেমন—
'একেকটা বিন্দু জীবন
সান্নিধ্যের সঙ্গমে যেভাবে বেড়ে ওঠে আতশ মুক্ত করে—
জীবনের নীচে দাঁড়িয়ে থাকা একেকটা বিন্দু সত্য, আরও আলো করে দেয়
অন্ধকারের গতিপথ' অথবা
'সন্তান প্রথমবার স্তনে ঠোঁট দিলেই প্রতিটি অবৈধ মা ঈশ্বরী হয়ে ওঠে'।
বইটির প্রধান বৈশিষ্ট্য হচ্ছে বইটির নামকরণ কোনও কবিতার নামকরণ থেকে উঠে আসেনি এবং কোনও কবিতাতেই শব্দবন্ধ রূপে 'নক্ষত্র রঙের আত্মহত্যা'রও কোনও প্রয়োগ নেই। জীবনের জীবিত এই আত্মহত্যার সাথে অনুভবের পরিচিতি ঘটাতে হলে আপনাকে গ্রন্থটির পাতা ওল্টাতে হবে। আর একটা একটা করে পাতা ওল্টালে ভীষণ স্বচ্ছভাবেই আপ্যায়ন করতে ইচ্ছে করবে এই মহাশূন্যে সকল চর্বি-বিসর্জনের সমূহ প্রক্রিয়াকে। আর কবি শুভ্রনীল চক্রবর্তী তখনও হয়তো তাঁর কবিতাতেই বলে যাবেন—
' ভেবেছিলে সব প্রতিবাদ একদিন ক্লোরোফর্ম হয়ে যাবে
শ্মশানের সালোকসংশ্লেষে—'
কাব্যগ্রন্থঃ নক্ষত্র রঙের আত্মহত্যা
প্রকাশনঃ ধানসিড়ি
প্রকাশকালঃ জানুয়ারি, ২০২৩
প্রচ্ছদঃ রাজদীপ পুরী
গ্রন্থঋণঃ সাক্ষাৎকারসংগ্রহ শম্ভু রক্ষিত
****************************************************************************************************
এ সময়ের অন্যতম শক্তিশালী তরুণ কবি। বিষয় ভাবনার নানাবিধ বৈচিত্র ছুঁয়ে থাকে তাঁর কবিতা। স্বকাল ও স্বদেশ ভাবনা তার মধ্যে অন্যতম । দেবার্ঘ সেন-এরকবিতার বই---) সমান্তরাল, দিগন্ত প্রকাশন ২) এক্সকিউজ মি, বার্তা প্রকাশন ৩) কাজল বাঁশী, বার্তা প্রকাশন ৪) নির্বীর্যতার জতুগৃহ, বার্তা প্রকাশন ৫) স্পর্শ নামক জেলখানা, একটি গীর্বাণ প্রকাশনা ৬) ভাতের জন্ম, সাপ্তাহিক ব্ল্যাকহোল প্রকাশনা । গত বইমেলায় প্রকাশিত ----




কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন