মঙ্গলবার, ৩ অক্টোবর, ২০২৩

গল্প * জয়শ্রী গাঙ্গুলি

 



" বৃষ্টি "

জয়শ্রী গাঙ্গুলি 


বোবা,কালা কোকি‌ আমগাছটার তলায় নোংরাগুলো‌ ঝাঁট দিয়ে পরিষ্কার করতে থাকে। কালবৈশাখীর ঝড়ে কাল রাতে বেশ কয়েকটা আম উঠোনের পাশের এই আমগাছটা থেকে পড়েছে। কেমন শীত শীত করছে। খুব একটা বড়ো হয়নি আমগুলো, গুটি হয়ে আছে। খুব টক। ঝাঁট দিতে দিতেই কয়েকটা আম কোঁচড়ে‌ ভরে নেয় কোকি। খুকির কাছ থেকে লুকিয়ে রান্নাঘরের থেকে সর্ষের‌ তেল চেয়ে এনে নুন দিয়ে মাখাবে‌ এই টোকো‌ আমগুলো। খুকিটা‌ আবার ভাগ বসায়‌ । তা বসাক‌ । কোকি খুব ভালোবাসে খুকিকে‌ ।

 সকালবেলায় গিন্নীমা' বোধহয় পুজোর ঘরে। পুজো সেরে বেরোলেই শুরু হয়ে যাবে মুখ। তাড়াতাড়ি ঝাঁটাটা‌ চালায় কোকি‌। কিসের যেন খসখস আওয়াজ হচ্ছে। চমকে পেছন ফেরে কোকি। খুকি কখন যে পেছনে এসে দাঁড়িয়েছে। দৌড়ে এসে কোকির হাত থেকে ঝাঁটাটা‌ কেড়ে নিয়ে দৌড় লাগায়। কোকি পেছনে পেছনে ছুটতে থাকে। দুই বন্ধুর দাপাদাপিতে মাটিতে পড়ে থাকা গাছের পাতায় মচমচ‌ শব্দ হয়। সকালের রোদটাও‌ যেন দুই সমবয়সি কিশোরীর খুনসুটিতে যোগ‌ দেয়। কোকি ভয়ে ভয়ে দোতলার বারান্দার দিকে তাকায়-- গিন্নীমা যদি দেখতে পায় খুকু সাতসকালে তার সাথে খেলতে লেগে গেছে কোকির‌ সঙ্গে খুকির পিঠেও দু এক ঘা পড়বে তাহলে। দু'জনের‌ হুড়োহুড়িতে‌ পা'য়ের কাছের কয়েকটা আম থেঁতলে যায়। কোকির সযত্নে‌ গুছিয়ে রাখা আমের পুঁটলিটা‌ চারিদিকে ছড়িয়ে দিয়ে খিলখিল করে হাসতে হাসতে ছুটে পালায় খুকি‌ । কোকি নিশ্চিন্ত হয় , গিন্নীমা 'র অন্তত চোখে পড়েনি, নইলে এক বেলার খাওয়া বন্ধ থাকতো।

এতো বড় ডাক্তার বাড়িটার‌ একতলার কোণায় ছোট ঘরটায় কোকির‌ জায়গা।বাপটা আর মা'টা মরে গেলে ডাক্তার জ্যেঠু তাকে ফেলে দেয়নি। বাবুদের উঠোনের পাশের এই আম,জাম,পেয়ারা, নারকেল গাছের ছোট বাগানটার‌ একপাশে ঝুপড়ি বেঁধে মংলু‌ আর তার বৌ থাকতো। মংলু বাগান পরিষ্কার করা, মাটি কোপানো, গাছে সার দেয়া এসব করতো আর মংলুর‌ বৌ উঠোন ঝাড়ু দেয়া, গাছে জল দেয়া এসব কাজ করতো। ছ' বছরের কোকি মায়ের পেছন পেছন ঘুরে বেড়াতো। খুকুর পুরোনো জামাকাপড় পরেই বড়ো হয়েছে কোকি। তারপর,ম্যালেরিয়ার‌ জ্বরে মংলু আর ওর বৌ দুজনেই মরে গেলে,কোকির‌ জায়গা হয়েছে উঠোনের একপাশের ছোট ঘরটায়।গিন্নীমা বড়ো মুখ ঝামটা দ্যায়‌ আর খাটায়। মনের দুঃখে এই আমগাছটার তলায় এসে হাপুস নয়নে ও কাঁদে তখন। ঝাঁট দেয়া হয়ে গেলে দাওয়ার‌ কোণায় ঝাঁটাটা‌ রেখে খুকুর ঘরের দিকে দৌড়ায়‌ কোকি। খুকু এখন ইস্কুলে যাবে‌। দোতলার বারান্দার দিকে চোখ পড়তেই গিন্নীমা'র‌ রুদ্রমূর্তিটা‌ দেখতে পায়। পুজোর ঘর থেকে বেরিয়েই অসীমা‌ চিৎকার করতে থাকেন --- এ্যাই‌ কোকি -- হতচ্ছাড়ি‌ কতক্ষণ‌ ধরে ঝাঁট‌ দিবি‌ তুই! খুকুর স্কুলে যাবার সময় হয়ে এলো ওর টিফিনটা গোছাবি‌ না নাকি, স্কুলের জামাটা‌ রেখে আয় ওর ঘরে। কোকি কোনো কথা শুনতে পায়‌ না। শুধু গিন্নীমা'র‌ রুদ্রমূর্তিটা‌ দেখে‌ দৌড়ায়‌ খুকুর ঘরের দিকে। খুকু কোকিকে‌ দেখতে পেয়ে বেসিন থেকে জল নিয়ে ছিটোতে‌ থাকে কোকির‌ গায়ে। কাবার্ড‌ থেকে খুকুর স্কুল ড্রেস বার করে এগিয়ে দেয় কোকি‌ । গিন্নীমা খুকুর টিফিন বাক্সটা‌ হাতে নিয়ে চিৎকার করতে করতে ঘরে ঢোকেন‌ , তাড়াতাড় ব্যাগটা‌ নিয়ে আয় ওর, স্কুলবাস‌ চলে আসবে তো। খুকু আর কোকি‌ দুদ্দাড় করে সিঁড়ি দিয়ে নেমে গেট খুলে রাস্তায় এসে দাঁড়ায়। বাস চলে আসে,খুকু জানালা‌ দিয়ে কোকিকে‌ টা টা করে। কোকি অদ্ভুত একটা শব্দ করে মুখ দিয়ে। খুকু ইস্কুল চলে গেলে‌ একটু যেন শ্বাস‌ নিতে পারে। জ্যেঠুর‌ জন্যে চা‌ বসায়‌ । গিন্নীমা আর জ্যেঠুকে‌ চা দিয়ে দুটো বিস্কুট আর চা নিয়ে বারান্দায় বসে বসে খায় কোকি। রুখু‌ চুলে রোদ‌ এসে পড়ে। মনের মধ্যে ভেসে ওঠে খুকুর গোলাপী রঙের ইস্কুলের‌ ব্যাগটা‌। খুব চোখ‌ টানে ওর। আহ্, কনুইয়ের কাছটা‌ কেমন টনটন করছে। কাল বাসনের কোণায় এঁটো ছিল বলে গিন্নীমা খুব মেরেছে। দেয়ালে ধাক্কা লেগে পড়ে গেছিল, সেই জায়গাটায় খুব ব্যাথা‌ । এরকম চড় থাপ্পড় তো লেগেই‌ থাকে। গিন্নীমা খেতে টেতে‌ দ্যায়‌ ঠিকমতো। কিন্তু মাঝে মাঝে কী যে হয়, মারে তখন খুব। তখন মরে যাওয়া বাপ মা'টার কথা মনে পড়ে। কান্না পায়।

আনমনা হয়ে পড়ে কোকি, রান্নাঘর থেকে অসীমা চেঁচিয়ে ওঠেন,অ্যাই‌ কোকি‌ কতক্ষণ‌ লাগে তোর চা খেতে। শাকটা বেছে দে। কোকির কানে কোনো কথা যায় না।‌ চায়ের কাপটা ধুয়ে রান্নাঘরের বারান্দায় দাঁড়ায়। হাতের কাছটা আবার চিনচিন করছে। খুকু মা'য়ের‌ আড়ালে কোকির‌ হাতে মলম‌ লাগিয়ে দিয়েছে। কান্না কান্না‌ মুখ করে জিজ্ঞাসা করেছে  -- কোকি তোর খুব লেগেছে তাই না? -- লুকিয়ে বাবার কাছ থেকে মলম চেয়ে এনেছে।  কোকি কিচ্ছু বলেনি ওকে, কিন্তু খুকু ঠিক টের পেয়েছে কনুইয়ের ছড়ে যাওয়া‌  দাগ দেখে।বোবা কোকির দুচোখ বেয়ে জলের ফোঁটা গড়িয়ে পড়ে। এই বোবা ,কালা মেয়েটাকে কেন যে‌ খুকুর এতো ভালো লাগে! খুব মায়া হয় ওর জন্য। কেন যে মা এতো বকে ওকে। স্কুল বা টিউশন না থাকলে ও কোকির‌ কাছে বসে বসে হাত পা নেড়ে নেড়ে গল্প করতে থাকে, বকবক করে। কখনও দুই বন্ধু মিলে বাগানের পেছন দিকটায় পেয়ারা আর আমগাছগুলোর‌ তলায় ঘুরে বেড়ায়। কোকি মুখে এক অদ্ভুত শব্দ করে আনন্দের অভিব্যক্তি ছড়ায়। একই‌ বয়সের‌ দুই কিশোরীর মধ্যে আস্তে‌ আস্তে‌ যৌবনের ডাক আসছে। টুকটুকে ফর্সা‌ আর গোলাপী ঠোঁটে‌ রিনরিনে গলায় খুকু যখন‌ বাগানের পেছনটায়‌ কোকির পেছনে দৌড়োয়‌ , ঠিক মনে হয় ফুটন্ত গোলাপের একটা পাঁপড়ি বাতাসে উড়ে যাচ্ছে । মংলুর‌ বৌ ছিল নিকশ‌ কালো, সেই রঙ কোকি পেয়েছে। কিন্তু নাক চোখ তার কাটাকাটা‌ মংলুর‌ মতো। কোঁকড়া একমাথা কালো চুল আর ডাগর চোখের চাউনিতে কোকি যখন‌ ছুটে যায় খুকুর পেছনে পেছনে, মনে হয় দিনমানে অমাবস্যা আর পূর্ণিমার চাঁদ একসাথে নেমে এসেছে বাগানটায়‌। কালো মসৃণ রঙ যেন কোকির‌ গা থেকে ঠিকরে ঠিকরে পড়ে। আর এই দুই সমবয়সি কিশোরীর হুটোপুটিতে‌ পেয়ারাডালে‌ কাঠবিড়ালীগুলোও যেন উত্তেজিত হয়ে ছুটোছুটি লাগিয়ে দেয়।


 আজ সকাল থেকেই গা হাত পা ব্যাথা‌ আর মেজাজটাও‌ খিঁচড়ে আছে অসীমার‌।মনটা‌ একেবারেই ভালো লাগছে না। এখন মাঝে মাঝেই মুড‌ স্যুইং‌ করে। রাগটা কন্ট্রোল‌ করা যায় না। খুকুটাও‌ যতো‌ বড় হচ্ছে ততই যেন‌ চারাগাছের মতো অবাধ্য‌ আর অনমনীয় হয়ে উঠছে। একটু বেশি বয়সের আর একমাত্র সন্তান বলে খুকুর বাবাও‌ প্রশ্রয়‌ দেয় মেয়েটাকে। আর সারাক্ষণ‌ ও মাথায় উকুন ভর্তি মংলুর‌ ঐ কেলো‌ মেয়েটার‌ সঙ্গে সঙ্গে ঘুরে বেড়ায়। বারণ‌ করলেও কথা শোনে না। মাঝেমাঝে মনে হয় মেয়েটা‌ কোকিকে‌ যেন‌ তার চেয়েও বেশি ভালবাসে। এক ধরনের জ্বালা‌ অনুভূত‌ হয় মনের মধ্যে। রাগের মাথায় কোকিকে‌ চুলের মুঠি ধরে এতো যে‌ সে মারল‌ ,তারপর খুকুই ওষুধ এনে দিয়েছে বাবার কাছ থেকে চেয়ে এটাও ভালই বুঝতে পারেন অসীমা। রাতের বেলায় মায়ের কাছে শুয়ে কেমন যেন ভয়ে জড়ো হয়ে শুয়ে থাকে খুকু।

আগে মন খুলে কতো গল্প করত মা'য়ের সাথে। কিন্তু এখন বেশিরভাগ সময়টাই বাগানে কোকির‌ সাথে ঘুরে ঘুরে নয়ত ছবি এঁকে কাটায় । খুকুর সাথে পাল্লা দিয়ে এই হতচ্ছাড়া মেয়েটা যেন দেবদারু গাছের মতো ঝাড়াঝাড়া‌ হাতে পা'য়ে‌ বড়ো হয়ে উঠছে।কাটা কাটা নাক আর ডাগর‌ চোখে একটা ঋজু শালগাছের মতো মনে হয় ওকে। মাঝেমাঝে খুব রাগ ধরে এই মেয়েটাকে। এর জন্যে‌ নিজের মেয়েটা না পর হয়ে যায়। আজই তো এমন রাগ ধরেছে, বাসনের কোণায় এঁটো লেগে ছিল। ওই বাসনেই‌ খেতে হবে, মাথাটা‌ গরম হয়ে গেছিল। প্রচণ্ড মেরেছে কোকিকে । বাসনচৌকির‌ কোণায় লেগে কেটে গেছে ওর। কিন্তু অদ্ভুত জেদী‌ মেয়েটা। একফোঁটা চোখের জল ফেলেনি‌ । জেদী‌ ঘোড়ার মতো দাঁড়িয়ে ছিল,আর তাতেই রাগটা আরো বেড়ে গেছে‌ । খুকু সেসময় স্কুলে ছিল,টের পায়নি। ওর বাবাও চেম্বারে ব্যাস্ত‌ ছিল, নইলে একপ্রস্থ চেঁচামেচি করত। দুপুরে খায়নি ও, রাতে উঠোনের পাশের ঘরটাতে শুয়ে আছে সন্ধ্যে থেকেই। রাতে খাওয়া দাওয়া হয়ে গেলে তাড়াতাড়ি শুয়ে পড়েন অসীমা। মনটা কিরকম ঝিম মেরে আছে। ক্লান্ত শরীরে ঘুম নেমে আসে।

মাঝরাতে ঘুমটা ভেঙে যায় অসীমার‌ । আজকাল ভালো ঘুম হতেই চায় না। খুকুটা‌ কিরকম বেঁকে শুয়ে আছে,ডিমলাইটের‌ আলোয়‌ ওর মুখটা কিরকম করুণ দেখাচ্ছে। হঠাৎ যেন ফুঁপিয়ে উঠলো ও। ঘুমের ঘোরে বিড়বিড় করে কিছু বলল । কান পেতে শোনার চেষ্টা করলেন অসীমা। মনের মধ্যে কিসের দুঃখ এইটুকু মেয়েটার। বিড়বিড় করছে খুকু -- কোকি ,কোকি- যাস না। বিড়বিড় করতে করতেই‌ পাশ ফিরে শোয় ও। এক নিবিড় আশঙ্কায় অসীমার‌ মন কুঁকড়ে যায়। সারারাত ভালো করে আর ঘুম হয়না। খুব ভোরে ওঠা‌ অভ্যেস‌ ,খুকুর‌ গায়ে একটা হালকা চাদর‌ ‌ ঢাকা দিয়ে উঠে পড়েন। ভোরের দিকে বৃষ্টি হয়ে থাকবে বোধহয়। এই সময়টায় কখন যে রোদ ওঠে কখন যে বৃষ্টি হয় বোঝা মুশকিল। হাত মুখ ধুয়ে ঠাকুর ঘরে গিয়ে গোপালের শয়ন তোলেন তিনি। খুকুর বাবার উঠতে দেরি আছে। রান্নাঘরে নিজের জন্য এক কাপ লিকার চা বানিয়ে বসেন তিনি। শরীর কেমন ঝিমঝিম করছে। সানবাঁধানো‌ উঠোনের পাশের পেয়ারা গাছটার দিকে নজর যায় ।

 বৃষ্টি ভেজা পাতাগুলোয় রোদ পড়ে কেমন চকচক করছে। কালকের কথাগুলো মনে পড়ছে আবার। খুকু বিড়বিড় করে কোকির নাম করছিল কেন ! হঠাৎ অসীমার মনে হয়,আজ কোনো কারণে খুকুর কপালেও যদি এরকম হয়, ওর তো আর কেউ থাকবে না পৃথিবীতে নিজের বলতে। কোকির মতোই ---- মাগো, আর ভাবতে পারেন না । হঠাৎ খচমচ করে পাতায় শব্দ হয়, কোকি ঝাঁট দিতে দিতে ঈশারা করে কিছু একটা বলতে চাইছে। অসীমার মনটা কিরকম নরম হয়ে আসে,কোকিকে‌ হাত নেড়ে ডাকেন‌ চা খাওয়ার‌ জন্য। নিঃশ্বাসটা‌ কিরকম হালকা লাগে।

 পেয়ারা গাছের সবকটা‌ পাতা ধুয়ে চিকচিক করছে,কাল রাতে খুব বৃষ্টি হয়েছে বোধহয়।













***************************************************************************************************



জয়শ্রী গাঙ্গুলি 

জয়শ্রী গাঙ্গুলি ( কবি এবং গল্পকার)



কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন