ব্যাঘ্রতটে সুন্দর বনের আতঙ্ক
শ্যামল চক্রবর্ত্তী সবুজ
সুখেন -- মণ্টা--আ, সোমবার সুন্দর বনে বাঘ দেখতে যাবো। যাবি ?
যাবো ---
সুন্দরবন মানেই শিহরণ। সুন্দরী গড়ার হেতাল গাছের গভীর অরণ্য সঙ্গে বাঘ কুমির গোসাপের আনাগোনা।
সোমবার সকালে যথারীতি, গাড়িতে করে আমরা চারজন রওনা দিলাম সুন্দরবনের উদ্দেশ্যে। মেট্রোপলিটন বাইপাস ধরে গাড়ি এগিয়ে চললো । বারইপুর কুলপি রোড ধরে পাশেই ছিল কৃষ্ণমোহন হল্ট স্টেশন, লাইন ক্রস করেই বারইপুর-কুলপি রোড-গড়িয়া । আবার পেলাম জয়নগর রোড, আবার পাশে নিমপীঠ রামকৃষ্ণ মিশন, বকুলতলা, কানকাটার মোড় ,নতুন বাজার ,জামতলা হয়ে কৈখালী। কুলতলী রোড হয়ে পেটকুল চাঁদ ব্রিজ পেলাম। কিছুটা পৌছে মৈপীঠ রাস্তা ধরলাম। মৈপীঠ কোস্টাল পুলিশের সহায়তায় অম্বিকা নগর হয়ে, সোমবারের বাজার পৌঁছানোর সৌভাগ্য জুটলো। সত্যিই সৌভাগ্য কারণ বর্ষাকাল, সরু রাস্তা, ঘন অরণ্য সঙ্গে বৃষ্টি।
ওখান থেকেই লঞ্চে যাত্রা শুরু।
--- বর্ষাকালে মাতলা নদীর পার হয়ে যেতে হলো। তবে লঞ্চ থাকায়, মাতাল করা নদীতে যাওয়ার কোন আভাস ই পেলাম না।
কি মনোরম পরিবেশ কি মনোরম আবহাওয়া, বলে বোঝানো যাবে না। আর মনের মধ্যে শিহরণ জাগছে, আশেপাশ থেকে গল্প করছে যে, সামনের দ্বীপ গুলো থেকে বাঘ নাকি সাঁতার দিয়ে চলে আসার সম্ভাবনা আছে। ভয় লাগছিল , বাঘ মামা এসে পড়বে না তো।
লঞ্চের সহায়ক বলে উঠলো---হ্যাঁ সামনের দিক দেখছেন দ্বীপ-- , ওখান থেকে অনায়সে সাঁতার দিয়ে চলে আসার সম্ভাবনা আছে বাঘ মামার।
কিন্তু হলে কি হবে। ওরা কিন্তু পিছন পায়ে ভর দিয়ে উঠার সম্ভাবনা নেই।
Newton's third law,তখন বুঝলাম আচ্ছা আচ্ছা, অর্থাৎ পিছন পায়ে ভর দেওয়ার মতন কোন তো সাপোর্ট নেই।আমাদের খেয়ে ফেলার ও সম্ভাবনা একেবারে নেই বললেই চলে।
সুখেন, ওই তো এটাই বনী ক্যাম্প ঐতো সামনে লেখা। পৌঁছে গেলাম।
আমরা তো চিড়িয়াখানা অনেকেই গেছি। ওখানে পশুদের খাঁচায় বন্দি করে রাখা হয়, যাতে করে বাঘ বেরিয়ে আসতে না পারে। কিন্তু এই বনী ক্যাম্পে মানুষকে খাঁচায় বন্দি করে রাখা হয়, বাঘ ভেতরে ঢুকতে না পারে। এই বনী ক্যাম্পের ভেতর একটু ৫০ ফটের ওয়াচ টাওয়ার আছে, দূরে একটি মিষ্টি জলের পুকুর আছে, ওইখানে বাঘেরা জল খেতে আসে, হরিণ ও জল খেতে আসে । সত্যিই হরিণের সামনে থেকে দেখতে পেলাম।
এই ক্যাম্পের আসল নাম সুন্দরীকাটি ইকো কনজারভেশন ক্যম্প (আজমলমারী)। এটা সূর্যদ্বীপে অবস্থিত।
২০০৩ সালে ১৫ই জুলাই বিখ্যাত সাহিত্যিক মাননীয় শ্রীযুক্ত বুদ্ধদেব গুহ এর নামকরণ করেন বনী ক্যাম্প। ক্যাম্পের অভ্যন্তরে চারিদিকে সুন্দরী গাছের ছড়াছড়ি। হ্যাঁ এই সুন্দরী গাছ থেকেই সুন্দরবনের নামকরণ হয়েছে।কিছুর অপেক্ষা না রেখে , অবকাশ নষ্ট না করে, ক্যামেরা নিয়ে উঠে পড়লাম ওয়াচ টাওয়ারে। তার আগে সামান্য চা জল খাবার খেয়ে নিয়েছি। হাতের নাগালে ছিল বাইনোকুল, দূরের সবুজ জঙ্গল গভীর অরণ্যে চোখ যেতেই দেখি একপাল হরিণ দৌড়াচ্ছে! সে কি অপূর্ব দৃশ্য। পাসেই পুকুর মিষ্টি জল খেতে চার-পাঁচটা কুমির ছানা এসে হাজির।
মুঠোফোনে কিছু ছবি ধরে রাখার চেষ্টা করলাম। চলমান ছবি তুললাম একপাল হরিণ দৌড়ে যাচ্ছে।
পাখির আওয়াজ এপাশ-ওপাশ যেন মাতাল করে দিল।মহীরুহ গাছ তেমন চোখে পড়ছে না ।আমাকে
সুখেন -প্রস্তুত হতে বলল ছোট ডিঙি নৌকায় আশেপাশের যাবার জন্য।
একজন রেঞ্জার অফিসার, আমরা চার বন্ধু, বনী ক্যাম্পের গেটের সামনে এসে দেখি জলের স্তর নিচে নেমে গেছে। দূরের ওপারে দেখলাম যেন মৃত কুমির শুয়ে আছে। আমার সঙ্গী লেন্স দিয়ে সেই জীবন্ত কুমিরের ছবি তুলল। আবার বলল দেখুন ওই যে, ওইগুলো হেতাল গাছ। ওখানে বাঘ লুকিয়ে থাকলে বোঝা যাবে না।
সত্যি তো হেতাল গাছটা ঠিক দেখতে যেন খেজুর গাছের মতো লম্বা লম্বা পাতা। কিছুটা হলুদ হলুদ সবুজ।
এবার আমারা লঞ্চে উঠলাম। চায়ের বন্দোবস্ত সঙ্গে টিফিন খেয়ে নিলাম। লঞ্চ এগিয়ে চললো টলটল করছে জল । সুন্দরবনের পরিবেশ আবহাওয়ার দ্বীপ ঘুরে দেখলাম। একটা মস্ত বড় টাওয়ার। যেখানে দূষণ পরিমাপ স্বয়ংক্রিয় ভাবেকরা হয়।
আবার কয়েক ঘন্টা লঞ্চে যাত্রা করে পৌঁছলাম কলস দ্বীপে। চারিদিকে ইতস্তত অনেক ছোট ছোট ভটভটি নৌকা। কিছু মানুষজন আসেছে কাঁকড়া ধরতে।
ওই দিনেই, কিছুক্ষণ আগে ঘটে যাওয়া ভয়ংকর দুর্ঘটনা, স্বামী-স্ত্রী ধরতে এসেছিল কাঁকড়া, মনোসংযোগ ছিল কাঁকড়া ধরার দিকে। অতর্কিতে জঙ্গল থেকে ঝাঁপ দিয়ে লোকটার ঘাড়ে আঘাত করে। যা শেষ পরিণতি তাই হলো। লোকটা ফিরতে পারল না বাড়িতে। ধড়টা পড়ে থাকলো।
যাই হোক এইভাবে ফিরে এলাম বনী ক্যাম্পে। এবার , বিকেল হতেই ছোট যন্ত্র চালিত নৌকা
যাওয়ার জন্য প্রস্তুত হলাম। সময়টা ঠিক সন্ধে সাড়ে ছটা। ভুটভুটি নৌকার ,সহায়ক এর হাতে বন্দুক, সার্চলাইট আমার কয়েক বন্ধুর, হ্যাঁ, বাঘ দেখার নেশায়। এক ভয়ঙ্কর নেশা।
সঙ্গে সুখেন, দুখেন ,রঞ্জু ,ও বনি তারা বাঘ দেখবে। ছোট্ট ডিঙি নৌকা চলতে শুরু করলো, আকাশটা আধখানা গোল ঘন অন্ধকার। নক্ষত্র খচিত । রাতের আকাশে নক্ষত্র গোনা যাচ্ছে। আর জল টলটল করছে। চাঁদনী রাত। প্রায় এক ঘন্টা চলার ঘন জঙ্গলের দেখা মিলল। ৫০০ ফিট দূরে, এবার ডানদিকে বাঁদিকে খারি সরু। সার্চলাইট যেটা বড় টর্চ বলা যেতে পারে, দুজন ধরে আছে। একজন ডানদিকে আর একজন বামদিকের বালুচরে। কোন সময় বাঁদিকে দেখি কোন সময় ডানদিকে দেখছি, সার্চলাইট টা এত জোর দূরের ঘন জঙ্গলের কিনারা দেখা যাচ্ছে। হেতাল-সুন্দরী গাছের কিছু কিছু অংশ বোঝা যাচ্ছে। খালি মনে হচ্ছে এই বোধহয় বাঘ দেখা যাচ্ছে। দূরের দিকে দেখি ,চোখ জ্বলজ্বল করছে জলের মধ্যে। ওরে, এ তো কুমির হ্যাঁ। কাছে গিয়ে ভটভটি শব্দে দেখি ডুবে গেল নিচে। ঘন অন্ধকার আবার সুখেন-দুখেন সবাই বলে আরেকটু ভেতরে যেতে। খাড়িতে জল কম রয়েছে বালুচর, খানিকটা নিচে নেমে এসেছে। যেন ভাটা মনে হচ্ছে। অন্ধকারের টর্চের ফোকাসে দেখা যাচ্ছে অনেক কিছু কাঁকড়া, পার্সে মাছের ঝাঁক।
দুখেন বলে উঠলো-আরে ভটভটির মেশিনটা বন্ধ করে দিন ।শব্দ করলে বাঘ আসবে না। সত্যি সত্যিই বন্ধ করে দিল।
আবার সুখেন --বলে উঠলো সাজলাইট গুলো বন্ধ করে দিন। সত্যি সত্যি সাজলাইট দু ,তিন মিনিটের জন্য বন্ধ রেখে দিল। এক ভয়ঙ্কর অবস্থা।ভটভটির শব্দটা মনের মধ্যে খানিকটা সাহস যুগিয়ে ছিল। এমনিতেই ছোট ডিঙ্গি নৌকা। আবার ঘন ঘুটঘুটে অন্ধকার। আবার জলের মধ্যে একটা শব্দ হচ্ছে। ভাবলাম কি? মাছের লাফিয়ে ওঠা শব্দ! নাকি কিসের শব্দ? কিংকর্তব্যবিমূঢ় অবস্থা।মনের মধ্যে ভয়ের সঞ্চার হচ্ছে। ভাবছি না এলেই ভালো হতো। কারো চোখের সামনে ঘটে যাওয়া সেই কলস দ্বীপের বাঘের দুর্ঘটনা না ঘটনা যাই হোক, খালি খালি মনে পড়ছে। এদিকে ছোট ভটভটি টা, জল কম থাকায় বালুচরে আটকে গেল।
তখন মনে হতে লাগলো , এখানে প্রাণ যাবে না তো! মরতে কেন যে এসেছিলাম। সুখেন আস্তে আস্তে বলছিল, মন্টা ও রঞ্জুর ভাগ্য যদি ভালো থাকে তাহলে বাঘ দেখতে পারবো। এটা কি ভাগ্য ভালো হওয়ার লক্ষণ?
আবার মাঝে মাঝে সার্চ লাইট অন করে, ক্যামেরা তাক করে রইল, বাঘের ছবি তুলবে।
শব্দ নেই-- । এই ঘন অন্ধকার। আমি বলে উঠলাম না না লাইট জ্বালিয়ে দিন। ভটভটির শব্দটা মনের মধ্যে খানিকটা সাহস যুগিয়ে ছিল। খাড়ির মধ্যে ছোট নৌকাটা আটকে গেছে, জল কম। চালক, বাঁশটা দিয়ে বালুচরে ক্রমশ শক্তি প্রয়োগ করে আপ্রাণ চেষ্টায় জলের মধ্যে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করল। ভয়ে আঁতকে উঠলাম । হাত পা ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছিল । আমি বলে উঠলাম নানা আর বাঘ দেখার দরকার নেই । ভটভটি মেশিন অন করে দিন। তাড়াতাড়ি নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা করুন। গুরু গম্ভীর সংকট মুহূর্ত যেন। হাসাহাসি করুক না কেন, মনের মধ্যে কয়েকজনের ভয়ের উদ্রেক হলো। পৃথিবীতে এসেছি অনেক কিছুই বাকি রয়েছে।শেষ হয়ে যাবে নাকি ? যাইহোক সঙ্গে সঙ্গেই ঘুরিয়ে ফেলল ছোট্ট নৌকা। এবার মনটা আনন্দে ভরে উঠলো। বাঘ মামা খেলতে পারবে না। এবার তো বেঁচে গেলাম। এইতো চলতে শুরু করলে একটু দূরেই, একটা হালুম হালুম শব্দ যেন কানে আসছে। কি বীভৎস গর্জন। ভাবুন ! ভাবলাম , সুখেন যদি বলে সুন্দরবন আসার কথা। আর কোনদিন আসবো কিনা ভেবে দেখবো। আবার ঘন্টাখানেক ওই অন্ধকারের মধ্যে দিয়ে ভটভটি ফিরে এল বনী ক্যাম্পে। পরের দিন, দিনের বেলা আবার দশটা নাগাদ বেরোলাম বৃষ্টির মধ্যে। ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি। চারিদিকে মেঘাচ্ছন্ন যেহেতু বর্ষাকাল। স্বয়ংক্রিয় স্থির চিত্রে স্মৃতি ধরে রাখার চেষ্টা করলাম। এই ঘটনা আমার মনে সারা জীবন ভয়ের স্মৃতি হয়ে থেকে যাবে।
**********************************************************************************************


কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন