মঙ্গলবার, ৩ অক্টোবর, ২০২৩

গল্প * দিলীপ রায়





খাজনা

দিলীপ রায় 


উপজেলা ভূমি অফিস। সন্তোষ বাবু কাজলকে নিয়ে এসেছেন জমির খাজনা দিতে। কাজলের বাবার রেখে যাওয়া শেষ সম্বল এক কেয়ার জমি অভাবের তাড়নায় বিক্রি করেছেন সন্তোষ বাবুর কাছে। আজ রেজিস্ট্রি। রেজিস্ট্রির আগে খাজনা পরিশোধ করতে হয়। তাই এসেছেন ভূমি অফিসে। ছোটখাট অফিস। অফিসে তহসিলদার, ২জন কর্মচারী, আরও গোটা দুয়েক লোক রয়েছেন। সন্তোষ বাবু জমির কাগজটা এগিয়ে দিলেন একজন মহিলার হাতে। কত খাজনা পরিশোধ করতে হবে সেটা জানতে চাইলেন। মহিলার চোখে ভারি সোনালী ফ্রেমের চশমা। তিনি কপালটা কিঞ্চিত কুঁচকে ভ্রু আর চশমার ফাঁক দিয়ে সন্তোষ বাবু আর কাজলকে দেখে নিলেন একনজর। তারপর বললেন, 'এক হাজার টাকা লাগবে।' সন্তোষ বাবু একহাজার টাকা শোনে চোখ দুটি গর্তে যাওয়া ভাঙা চোয়ালের কাজলকে দেখিয়ে 

বিগলিত কণ্ঠে বললেন, 'ম্যাডাম, ও খুবই গরিব। একহাজার ট্যাকা দেওয়া ওর লাইগ্যা কঠিন অইয়া যাইব। একটু মায়াটায়া কইরা কইন কত দেওন লাগব।'

এই কথা শোনে তৃতীয় পক্ষের একজন যার চোখজোড়া ঈষৎ লাল, মাথাভর্তি কুঁকড়ি চুল, ভ্রুজোড়া নাচাইয়া কইল, 'আরে ভাই, অত কথা কইয়া লাভ কিতা? পাঁচশ ট্যাকা দিয়া দেইন। কাজটা করিয়া দেলাইবনে।' তার সাথের লোকগুলা কথাডারে সাথে সাথে লোপে নিয়ে জোর সমর্থন জানাল। সন্তোষ বাবু কথা না বাড়াইয়া  চুপচাপ পাঁচশ টাকা পাঞ্জাবির পকেট থেকে বের করে দিলেন। মহিলাটি মুচকি একটা হাসি দিয়ে; বৃদ্ধা আর তর্জনীর সমন্বয়ে চিপা দিয়ে, পাঁচশ টাকার নোটটা টেবিলের ড্রয়ারের ভেতর ফুরুৎ করে চালান করে দিলেন। মুখে রক্ষিত রসালো পানের পিকটা আয়েশ করে গিলে রশিদটা লিখলেন। তারপর একটা বিবর্ণ প্লাস্টিকের স্কেল দিয়ে আলতো করে ছিঁড়ে রশিদটা সন্তোষ বাবুর হাতে ধরিয়ে দিলেন। সন্তোষ বাবু রশিদটা একনজরে দেখে নিলেন। তারপর, এক্সট্রা লোকগুলো; যারা একটু আগে কাজটা করে নিতে ওকালতি করছিলেন, তাদের লক্ষ্য করে বললেন, 'ভাই, আমরা ত মুক্কশুক্ক মানুষ; লেখাপড়া জানি না, দেখইন ত রশিদে কত ট্যাকা লেইখা দিছে।' লোকগুলো রশিদটা দেখে একজন আরেকজনের মুখ চাওয়াচাওয়ি করে খয়ের দিয়ে পান খাওয়া খয়েরী ঠোঁট একজন বলেন, 'আরে ভাই, কত লেখছে ঐডা দিয়া তুমি কিতা করতায়? রশিদ পাইছ, কাজ শেষ। অখন কথা না বাড়াইয়া যাওগি।' সন্তোষ বাবু বাঁ কানটা চুলকাইতে চুলকাইতে কইল, 'তা ঠিক কইছইন ভাই, আমরা ত যাইতাম-ই গা, তা আপনারাও কিতা আমার মতন লেখাপড়া জানইন না, না কিতা?' কথাডা শুনে তারা বেশ অপমানিত হলো বলে মনে হলো। 

লালচোখঅলা মাথা ঝাঁকাইয়া কইল, 'আমরা লেখাপড়া জানতাম না কেরে বা। হক্কলই তোমরার মতন মুর্খ অইব ইগান কিলা ভাবলায়?'

'আপনারা কিতা আমার কথায় রাগ করলায় নি বা? এর লাইগ্যা কথাডা কইলাম যে, আপনারা নু কেউ কইতা পারতাছইন না, রশিদটায় কত ট্যাকা লেখা। ঠিক আছে, আপনেরা না কইলে তসিলদার সাব নিশ্চয়ই কইবা রশিদে কত ট্যাকা লেখা।'

পাশের টেবিলে বসা রাশভারি চেহারার টাকমাথার তহসিলদারের হাতে রশিদটা সন্তোষ বাবু ধরিয়ে দিয়ে বললেন, 'স্যার, কইন ত রশিদটায় কত ট্যাকা লেখা আছে।'

তহসিলদার একটুখানি ভ্যাবাচ্যাকা খেলেন। তাদের সাথে সুর মিলিয়ে গম্ভীর কণ্ঠে বললেন, 'কত লেখা আছে এইডা জাইনা কি করবেন? আপনার কাজটা হইলেই ত হইল না কি?'


সন্তোষ বাবু হাত বাড়িয়ে রশিদটা হাতে নিলেন, 'কপালে জমতে থাকা বিন্দু বিন্দু ঘামগুলো মুছতে মুছতে কাজলকে লক্ষ্য করে বললেন, 'কাজল, তুই এই জায়গায় খাড়া, আমি একটু টিএনও অফিস থাইকা আইতাছি। টিএনও সাবরে একটু দেখাইয়া আইগা রশিদটায় কত লেখা আছে।'

এই কথা শুনে ভূমি অফিসের সবাই হকচকিয়ে উঠলেন। কালবৈশাখী ঝড় আসার পুর্ব মুহূর্তে ঈশান আকাশের যে অবস্থা হয় সবার মুখের অবস্থা হলো ঠিক সেরকম। তহসিলদার চেয়ার ছেড়ে উঠে সন্তোষ বাবুকে লক্ষ্য করে বললেন, 'আপনি মুরুব্বি মানুষ। সামনের চেয়ারটায় বসুন। আমি বলছি রশিদটায় কত লেখা আছে।'

মহিলারে লক্ষ্য করে বললেন, 'এই উনারে তিনশ টাকা ফিরিয়ে দেন ত।'

'আরে আমারে ট্যাকা ফিরাইয়া দিতাইন কেরে? আমি ত খালি জানতে চাইতাছি রশিদটায় কত লেখা আছে। ইডা কইতে আপনাদের অত সময় লাগদাছে কেরে?' সন্তোষ বাবু হালকা মিহি সুরে শোধালেন।


লালচোখঅলা মহিলার কাছ থেকে তিনশ টাকা এনে সন্তোষ বাবুর পকেটে ঢুকিয়ে দিলেন। 

'তারপরও আপনারা কইতা নায় রশিদটায় কত লেখা আছে?' সন্তোষ বাবু কণ্ঠটা খানিকটা উপরে তুললেন। 


চোখ দুটি ইঁদুরের চোখের মতো পিটপিট করে ভারিক্কি চেহারার তহসিলদার বললেন, 'ভাই, রশিদে দুই টাকা লেখা আছে। বুঝেনই ত, অফিস মেইনটেইন করতে কিছু খরচাপাতি লাগে। ধরেন, আমরা আপনার কাছ থেকে দুইশ টাকা খেয়ে ফেলেছি। যান গা এইবার।'

এবার প্রচণ্ড জোর ফিরে এলো সন্তোষ বাবুর কণ্ঠে। তিনি মুচকি একটা হাসি দিয়ে বললেন, 

'এই কথাখান আরও আগে কইলেই ত পারতা। অত কথাও কওন লাগের না। ট্যাকা ফিরত দেওনও লাগের না। কেনে যে আপনারা একটা সহজ কামরে সবাই মিল্যা জটিল বানাইন, এইডা আমরার মতন মুক্কু মানুষের মাথায় ঢুকে না। আমরা গরিব মানুষ একটু সেবা পাওয়ার লাইগ্যা আই আপনাদের ওখানো। আর আপনারা খালি আমারার লগে তিননব্বরী ধান্ধা করুইন। কইনছাইন, ইতা কিতা ঠিক নি? এইসব কিন্তু ধম্মে সইব না। আয় রে কাজল, যাই।' বলেই তিনি দরজার বাইরে পা রাখলেন। তখন বোধকরি সুরমার তীরের ভূমি অফিসের সমতল ভূমি ভীষণ লজ্জা পাচ্ছিল কিন্তু মুখফোটে কিছুই বলতে পারছিল না।


*************************************************************************



দিলীপ রায় 


পিতা- বীরেন্দ্র চন্দ্র রায় , মাতা সুনতী রায়। জন্মতারিখ ও জন্মস্থান: ১৩.০৮.১৯৮০ খ্রি. ও সুনামগঞ্জ ।পেশা-সহকারী অধ্যাপক, গণিত, মুরারিচাঁদ(এমসি) সরকারি কলেজ, সিলেট। কাব্যগ্রন্থ: বানের জলের মতো প্রশ্নবোধক চোখ, জানুয়ারি, ২০২১  । বৈশাখী টিভি কর্তৃপক্ষ তাদের মিডিয়ায় প্রচারের জন্য দিলীপ রায়ের লেখা কিছু গান সিলেক্ট করেছেন। 'পরান' নামে সাহিত্য বিষয়ক একটি ছোট কাগজ সম্পাদনা করেন।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন