সোমবার, ২ অক্টোবর, ২০২৩

গুচ্ছ কবিতা * অমিত চক্রবর্তী






কবিতাগুচ্ছ * অমিত চক্রবর্তী

 

১. 

আলতো ব্যথা


এ সবই ভুলে থাকার সরঞ্জাম, হালকা হাওয়ায়

মৃদুবর্ষণ, আলতো ব্যথা, সে বলেছিল। জানোই তো

ব্যথা বেড়ে গেলে খুব গান পড়ে থাকে শুধু, 

ভাওয়াইয়া বা ভাটিয়ালি মন্থন, অতিশয়

মোচড় যাদের, টালমাটাল বা মগ্ন উন্মন,

বেধনী সুচ তুরপুন।

হাতছানি দিলে ফিকে হয়ে যায় সেই

আলতাধোয়া ব্যথা, আলতো ব্যথা এখন

স্পাইরোগ্রাফের লিসাজু ফিগার

ঘোর লাগিয়ে দেবে চোখে, সহসা সম্মোহনের

আঁচড় কাটবে দেহে মনে বেজোড় শরীরে,

ওই দ্যাখো

নীলকান্ত, নীলকান্ত বলে ডেকে উঠলো সেই

পাগলা বুড়ো আবার, ইশারায় ইথার যার, তুলিতে রেনফরেস্ট

সেই শব্দ এখন কামরাঙা রঙে মউ, মেঘহওয়া মাছরাঙা

রঙে গাঙ,

ধুলিধূসর শব্দ এখন সরমপুঁটির শরম। 


 

২.

অলস অপরাহ্ন কাকে বলে নীলকন্ঠ জানে না আর


সে আমার কবিতা পাল্টাতে চেয়েছিল, বলেছিল

তুমি সমুদ্র সফেন হলে না কেন, আমি তো তাহলে

নিশ্চয়ই… এই বলে থেমে যায় সেই আনকোরা মন,

অলস অপরাহ্ন কাকে বলে নীলকন্ঠ জানে না আর।  

আজ সকালে আমি সমুদ্র আঁকতে গিয়ে

অনামিকার নখ বেগুনি করে ফেলেছি, দ্যাখো তো কত

ছোট সংকুলান আমার। মাথা দিয়ে জল ঝরছে

অবিরাম, চিবুক, দাড়ির অরণ্য বেয়ে টুপটাপ

নোনা জল, ভিজতে ভিজতে আমি জেগে উঠি ছাদে,

ছবি এঁকে দাও কাত্যায়নী, চামর বোলানো চুমু,

পিঠময় আলতামিরার তন্বী বাইসন আঁকো,

আমি ভুল আন্দাজ করব, বলব,

এটা নিশ্চয় দোয়েল পাখি, বলব

তুমি নিশ্চয় অন্তরতর।



 ৩. 

প্রায় ভালোবেসে ফেলেছিল সে আমাকে


শহুরে মেয়ে, প্রাতরাশের উপ্মার সঙ্গে

আমার কথা মনে পড়লো কি? আমি এঁদো গ্রামের

মুড়িমাখা দুর্বৃত্ত, আমার ফিতে লম্বা, দূরত্ব মাপার কাজ,

তোমার জন্যে প্রায় উপড়ে এনেছি একটি

পাড় ভিজে যাওয়া রূপক, কাদার ছিটে । প্রায় কথাটা

তার ইদানিং খুব পছন্দ দেখি, এক ন্যাড়ান্যাড়া

দুপুর বেলায় সে আমাকে প্রায় ভালোবেসে ফেলেছিল,

একটু এদিক ওদিক হলেই মাস্ক উড়ে যেত তার

বেনামী হাওয়ায়। এখন দেখি সে

“ঘর বাঁধতে চাই” বলাতে আলো নিজে এসে দাঁড়িয়েছে

দুয়ারে, চকচকে রজনীমুখের প্রায় সন্ধ্যায় তুলিহাতে

বাড়ি রঙ করছে তারা, একা বা অজস্র সাঙ্গোপাঙ্গ নিয়ে,

সাধারণ মানুষ ক’জন জুটেছে দলে, বাকি সব অলৌকিক জীবজন্তু,

গ্রীক পুরাণের নরাশ্ব কিন্নর।





৪. 

চিলতে আলো হলেই আমাদের চলবে


কপর্দকহীন গাছটার তো কোনো

মাথাব্যথা আছে বলে মনে হয় না,

ইতিহাসে উপেক্ষিতার মতন ঝিম ধরা

আলো এসে পড়ে তার রুগ্ন দেহে …

সে অবশ্য বরাবরই রুগ্ন ভেলা, সরু পায়ে হেঁটেছিল

একবার উঠোনে, দূর থেকে ভালোলাগা জানিয়েছিল

সেবার, শব্দ খুঁজে পায়নি,

কলাপসিবল গেটে তার সাজানো কথামালা

ভাঁজ খেয়ে খেয়ে আঙুল চিমটে একশেষ।

সে বৃষ্টির জন্যেও একবার

অপেক্ষা করেছিল, ভিজবে একটু সোঁদা গন্ধের

চলতি আতরে, দুষ্টু মেয়েটা এদিকে

সব মুছে দিয়ে গেছে ব্ল্যাকবোর্ডে, হৃদয়ে,

হাঁ করে যে তুই কী দেখিস আমাকে কালা ছেলে,

এলোমেলো বাউল,

আঁচল যে সামলে রাখতে হয় সবসময়

আমরা সামান্য স্তাবক,

চিলতে আলো হলেই আমাদের চলবে,

গাছটা বলেছিল উত্তরে।



৫.  

বসন্ত রজনীর গডেস


বাতাবি ফুলের গন্ধ ভালো লাগে আপনার? এ গন্ধ আমি

আগেও মেখেছি যে, অগ্রাহ্য করেছি তার আসক্তি, এ কি আমার

পক্ষপাতদুষ্ট ভাব না আমরা হাজির আবার সেই ক্রসরোডে,

জড়িয়ে জড়িয়ে হাঁটা আমাদের …

                     নীরস্ত্র, তুমি চোখ দিয়ে 

         পান কর

শরীর, অসংলগ্ন হও, বাসনাকে টুকরো টুকরো করে, চুরচুর করে

ছড়িয়ে দাও ঊষর জমিতে, কোনোদিন, কোনো একদিন

উঠে দাঁড়াবে তারা , সেই কালো বরবটি দানা,

তাদের জঙ্গলপ্রীতি, তাদের থমকে যাওয়া চরিত্রবল, বুকের পাটায়

আজ জোড়া লাগুক যেখানে শতছিন্ন কাঁথা যত, চাদর, লেপ,

মনচলি হো মনচলি, সে নাচতে নাচতে এগোয় এবার

এক মুহূর্ত আগেও হয়তো ভালোবেসেছিল আমাকে,

বেসেছিল কি ভালো সেই বসন্ত রজনীর গডেস,

আমি সন্তর্পনে এগোই, পা নীল হয়ে গেছে আমার

জবাবদিহির পাথরে ঠোক্কর খেতে খেতে।   



৬. 

যদি খেয়ালে লিখি অপেক্ষা সনেট


অক্টোবরে সস্তা ছিল ঝরাপাতার দল, সে অবশ্য সাবধানী পথিক

শুধু একটি কুড়িয়ে নেয়, নকশাকাটা হাতব্যাগে রাখে।

অপূর্ব সে কৌশল, আগেই আক্রান্ত হয়েছিল ঝোপটা লালরঙে

এখন আগুনফুলের তোড়া দিয়ে দেখি সাজিয়েছে নিজেকে।

দিগন্তও তাতে আহামরি উল্লাসে, মোহিনী ব্যাধির

সংক্রমণ বোধহয়, কী যে আনন্দ পায় এরা কারণে অকারণ,

দুটি পাখি উড়ে আসে উত্তরীয়ে ঝাপটা দিয়ে।

এইসব অনভিজ্ঞ দিনে, হট্টগোলের

ফাঁকে ফাঁকে সে দেখি গান ধরেছে, থিরথিরে দোলা সাঁঝ,

অন্যমনস্ক, চলে যাওয়ার গান।

আমারও আর কোনো কাজ বাকি নেই, সামর্থ্যও নেই

ফিরে পিছুডাকার, কিছু ইশারা নিশান

এবার ধার দাও ভবিষ্যৎ, ধার দিয়ে দিয়ে

পেন্সিলে শিষ বাড়াই, দূরত্ব বাড়লেই যদি

বন্ধু হয়ে যাই আমরা?  যদি খেয়ালে লিখি অপেক্ষা সনেট?


**************************************************************************************************



অমিত চক্রবর্তী


অমিত চক্রবর্তীর জন্ম সোনারপুর অঞ্চলের কোদালিয়া গ্রামে। ছাত্রাবস্থায় অনেক লেখা এবং ছাপানো কলকাতার নানান পত্রপত্রিকায়। পড়াশোনার সূত্রে আমেরিকা আসা ১৯৮২। এখন ক্যানসাস স্টেট ইউনিভারসিটিতে পদার্থবিদ্যার অধ্যাপক ও প্রাক্তন কলেজ অফ আর্টস অ্যান্ড সায়েন্সের ডিন (২০১৬-২০২২) । প্রকাশিত কবিতার বই তিনটি - "অতসীর সংসারে এক সন্ধ্যাবেলা" (২০২১), "জলকে ছুঁয়ো না এখানে" (২০২২), এবং "ভালো আছি স্তোত্র" (২০২৩)। দু'টি পত্রিকার সম্পাদক - উত্তর আমেরিকার নিউ জার্সি অঞ্চলের পত্রিকা "অভিব্যক্তি" (সহ-সম্পাদক) এবং "উজ্জ্বল এক ঝাঁক পায়রা" কবিতা পত্রিকা।






কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন