বুধবার, ৪ অক্টোবর, ২০২৩

অণুগল্প * দেবাশীষ মুখোপাধ্যায়







অণুগল্প সাহিত্যের একটি বিস্ময়কর শাখা। ' বিন্দুতে সিন্ধু দর্শন ?' ঠিক তাও নয় যেন, বিন্দুতে সপ্তসিন্ধু দশ দিগন্ত চকিতে উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে সার্থক অণুগল্পে। তেমনই একটি অসাধারণ অণুগল্প এবার আমরা পড়ছি ---


হবে জয়

দেবাশীষ মুখোপাধ্যায়


বেশ ভালো লাগছে তাপসের। অনেকদিন পর স্বরচিত কবিতা পাঠের আসর থেকে একরাশ তৃপ্তি নিয়ে ফিরছে। আজকের অনুষ্ঠান সত্যিই ছিল অন্যরকম।হল ভর্তি শ্রোতা। কবিতা পাঠ চলাকালীন শ্রোতাদের মধ্যে কথা চালাচালি নেই। হলে স্থায়ী নীরবতার মাঝে শব্দরা ভেসে বেড়াচ্ছে শুধু কান থেকে কানে।যেন প্রজাপতি ফুলে ফুলে মধু সংগ্রহে। প্রথম কবিতার পর করতালির আওয়াজ বুঝিয়ে দিল, এখনো অনেক কিছু আছে যা আজও হারায় নি ! দ্বিতীয় কবিতার অনুরোধে চমকে গেল তাপস। যেখানে কবিতা পাঠের শুরুতেই ঘোষকের কন্ঠে থাকে ছোট্ট কবিতা পাঠের অনুরোধ অনেকটা দাপুটে গলায়, সেখানে চালু পদ্ধতির বাইরে দ্বিতীয় কবিতার আবদার! একটু ইতস্তত করতেই ঘোষকের অনুরোধ আবার কানে এলো।তাপস চোখ বন্ধ করে একটা জোরে শ্বাস নিয়ে শুরু করলো দ্বিতীয় কবিতা।ওর সেরা কবিতাগুলোর একটা।যেন এখানে কোন ফাঁক না থাকে। শ্রোতারাই তো ঈশ্বর! তাই ঈশ্বরের চরণে সেরা নিবেদনই থাক।

অনেকদিন পর মঞ্চ থেকে নেমে অনেকের সেলফি তোলার আবেদন মুচকি হেসে মেনে নিল ও আজ। ভালোলাগা ডানা মেলে উড়ছে যেন অনেকদিন পর ওর মনের নন্দনে। কর্তৃপক্ষের আপ্যায়ন সত্যিই মনছোঁয়া ।অন্য অনুষ্ঠানের থেকে আজকের অনুষ্ঠানের পার্থক্যের কারণ ভাবতে ভাবতে ও ফেরার ট্রেনটা ধরলো।

জানলার ধারের সিট পেয়ে গেল। ট্রেন ছাড়তেই দস্যি বাতাস ওর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে সব এলোমেলো করে দিতে চাইলো যেন।হাওয়ার আদর মেখে ও জানলার বাইরে তাকালো।

হঠাৎ উল্টোদিকে বসে থাকা একটা ছোট ছেলের কান্নার শব্দ কানে এলো।ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাতেই দেখলো, সাত আট বছরের এক ছেলে কেঁদে চলেছে।তার মা তাকে সান্ত্বনা দেওয়ার চেষ্টা করে চলেছে। কিন্তু ছেলেটার কোন দিকে খেয়াল নেই। ওর চোখের দিকে তাকিয়ে দেখলো,জেদী চোখ যেন মানতে পারছে না বিষয়টা। কৌতুহলী তাপস ওর মাকে জিজ্ঞাসা করলো ছেলেটির এহেন কান্নার কারণ। উত্তর শুনে তাপস যেন এক আগুন জ্বলতে দেখলো ছেলেটার মনে।

   ছেলেটির নাম অর্ক। ষষ্ঠ শ্রেণীর ছাত্র। ওদের বিদ্যালয়ের বার্ষিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতায় একশো মিটার দৌড়ে ও প্রথম তিনজনের মধ্যে দৌড় শেষ করতে পারে নি।অথচ খুব ভালো দৌড়য় অর্ক।হিটেও প্রথম হয়েছিল।এই দৌড়ের জন্য ও বাড়িতে অনেক প্রস্তুতি নিয়েছিল।আজ কি যে হলো ওর! পঞ্চম হয়ে দৌড় শেষ করলো।তারপর থেকেই কান্না ওর গলায়।এ ফলাফল ও মন থেকে মানতে পারছে না। বাড়িতে মজা করে একটা গেলাস হাতে নিয়ে বারবার চেয়ারে উঠে দাঁড়িয়ে দৌড়ে প্রথম হয়ে বিজয়ীর ট্রফি নেবার ভঙ্গি করেছে। বাবা মাকে হাততালি দিতেও বাধ্য করেছে বারবার।সেই ট্রফি জিততে না পারার কষ্ট অর্ককে যেন কুড়ে কুড়ে খাচ্ছে। তাপস একদৃষ্টে ছেলেটার মুখের দিকে তাকিয়ে রইল। একটা জেদ ওর চোখের তারায়।হার মানতে না পারার যন্ত্রণা ওর চোখে মুখে !

 হঠাৎ তাপস ব্যাগ থেকে কবিতা পাঠের পর পাওয়া মেমেন্টোটা বার করে ছেলেটার হাতে তুলে দিলো। ছেলেটি ও ওর মা থতমত। তাপস বলে উঠলো  : " আজ মাঠে দৌড়ে ট্রফি জিততে না পারলেও তোমার লড়াই সত্যিই বিজয়ীর মতো ছিল। তাই এই মেমেন্টো তোমার প্রাপ্য।পরের দৌড়ে তুমি বিজয়ী হবেই, নিশ্চিত। তোমার কান্না, তোমার চোখের আগুন সেটাই আজ বলে দিচ্ছে। " অর্ককে দাঁড় করিয়ে     মেমেন্টোটা ওর হাতে তুলে দিয়ে হাততালি দিয়ে উঠলো তাপস।কামরার বাকি সকলে প্রাথমিক ইতস্ততা কাটিয়ে যোগ দিলো হাততালিতে। অর্কর সারা মুখে তখন চ্যাম্পিয়নের হাসি !









************************************************************************************************



দেবাশীষ মুখোপাধ্যায় 

 রয়েল কমপ্লেক্স ,কাঠালবাগান ,উত্তর পাড়া, হুগলী থেকে লিখছেন পেশা: শিক্ষকতা ,নেশা : কলম চারিতা ,সাপলুডো খেলা শব্দ নিয়ে ,অণুগল্প ,ছোট গল্প ,কবিতা, প্রবন্ধে  সুখ-দুঃখ ,হর্ষ-বিষাদ, আড়ি ভাবের অনুভবে থাকা ,জীবনের দুই স্তম্ভ রবীন্দ্রনাথ বিবেকানন্দের আদর্শ মনন, যাপন ও শীলনে.. স্বপ্ন: পৃথিবীকে ভালবাসার যৌথ খামার বানানো..দিক চক্রবালে হিরণ্যগর্ভ আলোর খোঁজ ..পাখি ,গাছ আকাশের সাথে মন কি বাত.. সূর্যের নরম আলোয় সুখের আবিরে মানুষের সাথে হোলি খেলা..

                        


কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন