মানুষ
বিরথ চন্দ্র মন্ডল
ধারণাটা এমন ছিল যেন রমেশ কিছুই পারে না । রমেশের দ্বারা কিছুই সম্ভব নয় । আরো অনেক কিছু রটে ছিল ওর নামে ।
ও নাকি বড্ড আল-খাল্লা । ঠিকমতো গুছিয়ে কথা বলতে পারে না । একরকম পাগল পাগল যেন ।
অকারণে ভুলভাল রটে যাওয়া এই রমেশ ,আজ দীর্ঘ বছরের পর ভীষণ খুশি ।
এই খুশির আনন্দে চোখ থেকে ঠস ঠস করে জল গড়িয়ে পড়ছে গাল বেয়ে ।
কলা গাছের শরীরে ধারালো কিছু দিয়ে আঘাত করলে যেমন গল গল করে গাছ নিঃসৃত জল গড়িয়ে পড়ে , রমেশের চোখ থেকে অঝোরে জল গড়িয়ে পড়ছে সেই ভাবে ।
এ কান্না তার আনন্দের কান্না । তার জয়ের কান্না । আসলে ; উঠতি বয়সে আর পাঁচ জনের মত তার অনেক স্বপ্ন ছিল । এক সত্যিকারের মানুষ হবার স্বপ্ন । বড় হয়ে সমাজকে আমূল বদলে দেবার স্বপ্ন । যে দেখবে , সবাই তাকে অনুসরণ করবে ।
তার চলা - ফেরা , ওঠা - বসা এইসব দেখে- সবাই তারিফ করবে । কিন্তু ; জীবনের হাফ বয়সে এসেও কিছুই করতে পারেনি সে। শেষে কিনা অকর্মন্য হয়ে ঘরে বসে । এই বয়সে বিয়ে করে সন্তানের জন্ম দিল বটে । সত্যিকারের মানুষ গড়ার ক্ষেত্রে ,সেখানেও যেন ধোঁয়াশা ধোঁয়াশা।
আদর্শ স্বামী হবার কথা ভাবলে মনে মনে তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে দেয় সে ।
সানাই' তাকে ভালো বাসে, একথা ঠিক । কিন্তু সংসারে চরম দারিদ্রতা। নিরন্তর সাংসারিক অভাবে সানাই ও যেন যবু থবু । তারও বা কি করার আছে !
আজ বেশ কয়েক বছর রমেশের ছেলেকে কেউ দেখেনি । কোথায় আছে ? কি করছে ?
এসব নিয়ে জিজ্ঞেস করলে রমেশ চুপচাপ থাকে ।
রা - পর্যন্ত করে না।
রমেশের এই অস্বাভাবিক চুপচাপ গ্রামের লোককে ভাবিয়েছে বেশি।
এই কারণে গ্ৰামের মানুষ উল্টাপাল্টা যে যেমন পেরেছে , মনগড়া ভাবে রটিয়েছে চারধার ।
কেউ বলছে - রমেশ তার ছেলেকে খুন করে গায়েব করেছে । কেউ বলেছে - ছেলেটা কোন মেয়ে নিয়ে বাবার ভয়ে দেশান্তরী হয়েছে ।আবার কেউ বলেছে - বসন্তিয়ায় সরস্বতী ঠাকুরের ভাসানোর সময় মদ খেয়ে রাস্তায় পড়েছিল । সেখানেই হয়তো মারা গেছে।
আজ এক গাঁ লোকের সামনে পরান মণ্ডল চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে বলল কথাটা । বলল - হাঁ আপনারা যা যা শুনেছেন সব সত্যি । এত দিনের পর আসল সত্যিটাই প্রকাশ পেল । রমেশের ছেলে প্রমথেশ ঘরে ফিরছে ।
শুধু সুবর্ণ দিঘি গাঁ কেন - সারা তল্লাটের মুখ উজ্জ্বল করেছে প্রমথেশ ।
যারা বড় বড় কথা বলে মাতব্বরি দেখিয়েছিল , রমেশের নামে যা না তাই কুৎসা রটিয়েছিল ! শেষে কিছু লাভ করতে পারল কি ওরা ? অথচ অকারণে মানুষটা শুধু শুধু অপমানিত হয়েছে । লাঞ্ছনা গঞ্জনা চুপচাপ শ
শয়েছে । সেদিন থেকে দেখেছি , রমেশকে মনমরা হয়ে থাকতে । কি অপরাধ ছিল মানুষটার ?
রমেশ একদিন বেধড়ক পিছিয়ে ছিল প্রমথেশকে । চ্যাংড়া ছেলেদের সাথে মদ খেয়েছিল সেদিন । রমেশের চোখে পড়ে যায়। প্রথমে ভুলকে ভুল বলে স্বীকার করতে চায়নি ছেলে । অযথা তর্ক করে যাচ্ছিল । বলেছিল - সবাই মদ খায় । আমিও খেয়েছি । তাতে দোষ কিসের ? তাছাড়া ওরা খাওয়ালে আমি কি খাব না ...?
কথাটা শুনে মাথায় রাগ উঠে গেছিল রমেশের । পাশে বাবলা ছড়ি পড়েছিল । তা দিয়ে দমাদম উত্তম-মধ্যম দিয়েছিল।
এত বড় ছেলেকে শাসন করতে কোথায় যেন লেগেছিল তার । সেদিন সারারাত ঘুমাতে পারেনি। দূর্ভাবনায়। নিজের জীবনের এই পরিণতি । তারপর ছেলের এমন বাজে সঙ্গ দোষ ! এই ভুল অবস্থা থেকে ত্রাহি পাবার নানা পথ খুঁজে বেড়িয়েছিল সেদিন।
ভোর রাতে চুপিসাড়ে তার বিশ্বস্ত মাস্টার মশাইয়ের কাছে রেখে এসেছিল ছেলেকে । রেখে এসেও রাতে ঠিকমতো ঘুমোতে পারেননি। ছেলে কতটা মানুষ হল ! কিংবা আদৌ হল কিনা - এই ভাবনায় ।
নিজের স্ত্রী ছাড়া আর কাউকে জানতে দেয়নি - আজ পর্যন্ত ছেলে কোথায় আছে !
আজ, এই প্রমথেশ সরকারি চাকরি পেয়েছে । নিম্ন আদালতের ব্যারিস্টার ।
মাস্টারমশায়ের কথায় -- প্রমোথ নাকি দ্বিতীয় রমেশ । সৎ , বিনয়ী এবং.....
*********************************************************************************************



কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন