['স্বরবর্ণে'র চতুর্থ সংখ্যা থেকে শুরু হয়েছে কবি দীপংকর রায়ের আত্মজৈবনিক উপন্যাস ' কথা দিয়েছিলাম হেমন্তের নিয়রে '। এই উপন্যাস লেখকের ষোল-সতের বছর বয়সের কালপর্ব থেকে শুরু। যদিও লেখকের জন্ম এপার বাংলায়, কিন্তু শিকড় ছড়িয়ে থেকেছে ওপার বাংলায়। কাজেই যাতায়াত থেমে থাকেনি। ইতিমধ্যে ১৯৭১ সালে রক্তক্ষয়ী লড়াইয়ের পর বাংলাদেশ স্বাধীন হয়। সদ্য স্বাধীনতা পাওয়া একটি দেশ ছেড়ে চলে আসা আর তারই নাছোড় এক টানাটানির মধ্যে যে জীবনের ক্রমাগত আসা আর যাওয়া ,এই উপন্যাস মূলত তারই এক নির্মম নিষ্ঠুর ভাঙা-গড়ার আশ্চর্য কথোপকথন। ধারাবাহিকভাবে যা আমরা পড়ছি, কবি দীপংকর রায়ের মায়াময় কলমে।]
কথা দিয়েছিলাম হেমন্তের নিয়রে
পর্ব * ১১
দীপংকর রায়
এদেশের অনেক অভ্যাসের সঙ্গেই অভ্যস্থ হয়ে উঠছি । লুঙ্গি পরার অভ্যাসটাও পাল্টে গ্যাছে — পাজামা পাঞ্জাবী পরছি ।
ক্লাস নাইনে উঠেই বায়না ধরে হাফপ্যান্ট ছেড়ে লুঙ্গি পরেছিলাম দিদিমার ইচ্ছার বিরুদ্ধে যেয়েই খানিকটা । তার আগে সে অর্থে হাফ প্যান্ট আর কোথায় ? সে তো চুয়াত্তরের মন্বন্তরে ইউনিসেফের ছাতুর বস্তার কাপড়ের প্যান্ট জামা পরেই রোজ ধুয়ে সেই দিনই শুকিয়ে পরের দিন আবার সেইটাই পরে স্কুলে যাওয়া ।
এ ছাড়া স্বাভাবিক ভাবে বাইরের জামাকাপড়ের ভেতরে ভালো জামা প্যান্ট বলতে জাপানি টেরিকটনের কাপড়ের তৈরি জামা প্যান্ট একটা করে সেট পেতাম পুজোর সময় । সেটাই চলত বাইরে কোথাও বেড়াতে বা ঘুরতে গেলে । গ্যাবাডিন উঠেছিল তারও পরে । সেও পরেছিলাম কবে যে তা মনে নেই ।তবে, সেবারে চুয়াডাঙ্গায় মাসি বাড়ি গেলে এক সেট গ্যাবাডিনের সাফারি সুট তৈরি হয়েছিল । এবং সেটার মায়া আছে এখনো । ওদেশে গেলে নিয়ে আসবো ইচ্ছা আছে ।
যাই হোক , সেই ধারাবাহিকতাই চলে আসছিল ওদেশ
ছাড়বার আগের মুহূর্ত পর্যন্তও । আর সব ফেলে আসলেও লুঙ্গির অভ্যাসটা ফেলে দিতে পারি নি । তবে এই কয়েকদিন হোল নানাজনের টিপ্পুনি ঠাট্টার দৌলতে এবারে লুঙ্গি ছেড়ে ঢোলা পাজামা পাঞ্জাবীতে পুরোনো অভ্যাসটা পাল্টে ফেললাম একদিন ।
মা ওদেশে যাবার আগে যদিও দু সেট বানিয়ে দিয়েছিল । সেটাই পাল্টাপাল্টি করে পরি এখন । সব শুদ্ধু ঘরে বাইরে মিলে , তিন চার সেট তো এর মধ্যেই ; দিদি , মা মিলে এই সামান্য কদিনের মধ্যে আর কতোই বা লাগে ?
মাঝে মাঝে মনে হয় না যে তা নয় , ভীষণ মনে হয় , মনে মনে ভাবতে থাকি কত কিছু ; এই সামান্য কয়েক মাসের মধ্যে জীবন যাপনের সমস্ত ধারাবাহিকতা এত তাড়াতাড়ি কীভাবে যে পাল্টে ফেললাম ! কীরকম ভাবে যেন এখানকার সব অভ্যাসের সঙ্গেই নিজেকে ধাতস্থ করে তুলেছি একটু একটু করে ।
আর এ সব কথাবার্তা ,ভাব বিনিময় , মনে করাকরি সবই —--সেই আমাদের রাতের বারান্দা জানে । আর জানে সেই সব রাতের নিস্তব্ধতা ; ওদিকে ওই ঝাউগাছের সরিরাও ; খোলা আকাশ জানে আমার অনেক কথাই হয়তো !
এই যে মোড়া পেতে চুপটি করে বসে থাকা , মাথার উপর একটি একশো পাওয়ারের বাল্ব জ্বলছে । কাজের দিদি ওদিকে ঘরের ভেতরে ঘুমিয়ে আছে । আর আমি এই মোড়া খানির উপরে বসে বসে ভেবে চলেছি কত কিছুই না ! আমার এই সব পরিবর্তন , তার সঙ্গে আর একটি কথাও যেন অত্যন্ত গোপনে ভেবে চলেছি । আচ্ছা সেই গোপন কথাটি কী ? কে সে ? কার কথা ভাবছি ?
আচ্ছা , সে কি নবগঙ্গা নদীর পাড়গুলি ?
নাকি ঠাকুরনালার মাঠ ?
বাবুদের কলুপে আমতলার দুপুর বেলার নিস্তব্ধতাও কি ?
হয়তো এ সবের সব কিছুর সঙ্গে ওখানকার সমস্ত প্রকৃতি জুড়ে যেয়ে যে সব নানা বুনো গন্ধ পাঠায় আমাকে ; আমি এমন এক বর্ণে গন্ধে তাকে মানুষ রূপেতেই যেন অনুভব করি শেষে । আর একথাও বুঝতে পারি , তাকে যদি না ছেড়ে আসতাম তাহলে মনে হয় এমন ভাবে তাকে আমি অনুভব করতে পারতাম না হয়তো ।
এই সব কিছুর আড়ালে কি আরো কিছু সহজ সরল সম্বন্ধের চোরা টান রয়েছে — এমন কোনো মুখকে ঘিরে , যাকে এমন কোনো রূপ ও মাধুরীতে সাজিয়ে ফেলেছি অজানায়,অবচেতনে , তাকে এমন কোনো বিশেষ রূপ দিয়ে ফেলেছি , যাতে তার সঙ্গে ভাব বিনিময় করতে বা কথা বলাবলি করতেই তাকে আমি চাই বুঝি এই রাতে —--- এই বারান্দায় , এই হিমেল হাওয়ার ভেতর তাকেই ফিরে চাইছি ? তাকে এমন এক কল্পবিশ্বে চালান করে , আবার তাকেই চাইছি নিতান্ত কাছের মানুষের মতন করে !
এই সুখানুভুতি , এই অনুভব করা সেই মানবীকে দেখতে কেমন ?
সে কি নতুন মামিমার মতন ? ছদ্মবেশে আমার কাছে ভেসে আসছে !
নাকি সেই চুল ছেড়ে ঘুরে বেড়ানো মেয়েটি —--- যে আমায় বর্ষামুড়ি ছাতা মাথায় দিয়ে খুনসুটি করে নিত্য সঙ্গ দিত যে ?
মামাদের নৌকাখানির উপরে বসা সে তো আর কেউ না সে তো সেই কল্যানী !
আবার ভাবতাম , ধুস ! সে হবে কেন ? সে তো এদের কারোর মতনই না !
তাহলে , তার পরিষ্কার চেহারাটি কি দেখতে পাচ্ছি আমি আরো পরিষ্কার ভাবে ?
কই , তাও তো না !
সে যে ঝাপসা ,ভাসা ভাসা , একটি অস্পষ্ট রূপ শুধুই— যাকে আজকাল প্রায়শই নিজের অজান্তে নিজেই বানিয়ে তুলি , এই রাতের বারান্দায় একা একা !
বুঝতে পারি না সবটা ।
তখন আপন মনে বলি , তাহলে মনে হয় আমার মন ভেতরে ভেতরে এমন কাউকে চাইছে কাছে , যে এসে সামনে দাঁড়ালেই অফুরন্ত আনন্দ ।
ঠিকই তো , সে এসেই তো আজকাল মাঝে মাঝেই আমার ভাবনার জগতে ডানা মেলে ভেসে বেড়াচ্ছে ! খুব বুঝতে পারছি সেটা । অথচ , এ কথা তো কাউকে বলা যাবে না ! আজকাল তো সে এসে ঘুমের ভেতরেও নানা রূপে ধরা দেয় । অনেকক্ষণ আমার পাশে এসে মাথার কাছে বসে থাকে । সে এমন করে তার দুটি হাত প্রসারিত করে আমার বুকের ভেতর যেন ডুবিয়ে দেয় ; তখন আমার মনে হয় , এই তাকে যদি আমার ঘুমের বাইরে টেনে এনে পাশটিতে বসাতে পারতাম , আর একটু কাছাকাছি , তাহলে যে কি আনন্দই না হতো আমার !
রাত বেড়ে যেত এমন সব বিচিত্র ভাবনা ভাবতে । এমন সব জগতে ঘোরাঘুরি করতে করতে । মাঝে মাঝে মুরগির ঘরের নিচের থেকে গোরু গুলির শুয়ে পড়ার নিঃশ্বাসের শব্দে আমার যেন সম্বিৎ ফিরে আসত । সেই সব ঘোর ভেঙে প্রকৃতস্থ হতাম ।
উঠোনের ঘাস-জঙ্গলের মাথায় শিশির পড়ে লাইটের আলোয় ,অন্ধকার মিলেমিশে সে এক এমনই গন্ধ ভেসে আসতো নাকে ,তার বর্ণনা করা সম্ভব না কোনো কিছু দিয়ে । তার ভাষা আমি আয়ত্ব করতে পারি নি এখনো ।
ওপাশের গর্তটায় কচুরিপানাগুলি ইদানিং বেশ জমাট বেঁধে উঠেছে এরই মধ্যে কবে যেন । তাতে রাস্তার লাইট পোষ্টের আলো পড়ে বেশ এক অদ্ভুত আবহ তৈরি হয়ে উঠেছে । আমাকে আমার মনোনিবেশে টেনে নিত নিজের মনে নিজেই যেন —-- আমার এই সব নানা কথা কওয়াকয়ির ভেতর অদ্ভুত সব বীজ বুনে দিত । অথচ তাদের সব জাত গোত্রের সঠিক ঠিকানা আমার নিজের কাছেও নেই ।
ওপাশে এই বাড়ির বর্তমান সীমানা ঘেরা রাংচিতের গাছগুলিও মুলি বাঁশের বেড়ার গায়ে গা লাগিয়ে উঠে এসে বেশ মাথা ছাড়িয়ে গ্যাছে কত তাড়াতাড়ি ! তারাও একাকী একার মতো হাওয়া বাতাসে কেঁপে কেঁপে ওঠে যে, তা দেখতে পাই।
এর আগে এসব চোখে পড়েনি কি ! পড়েছে । তবে আজ যেন একটু অন্যরকম ভাবে চোখে পড়ল ।
এসব তো এই রাতের বেলাতেই ধরা পড়ে বেশি করে !
কদিন রাণিয়ার মাঠে যাওয়া ছাড়া বিকেল ও সকাল বেলার আড্ডাতে একটু ভাটা পড়েছে । ওই সময় গুলিতে ওরাও যেমন আসছে না রোজ , তেমন আমিও যেন তেমন একটা মন থেকে চাইছি না এতটা সময় নষ্ট করতে । তাই সকাল বেলাতেই হাঁটতে বেরিয়ে একটু ঘুরিয়ে বলে দিচ্ছি যেন, আমার ইদানীংকার ইচ্ছা অনিচ্ছার কথাগুলি । বলে দিচ্ছি একটু কায়দা করে , আমার নিজের কোনো কাজ হচ্ছে না ভাই , অনেক কাজ করতে হবে , কদিন একটু সে সবের মধ্যেই থাকতে হবে ভাবছি । একা কাজের দিদির উপরে সব দায় ছেড়ে দিয়ে নিশ্চিন্তে বসে থাকতে চাই না আর ।তাছাড়া পড়াশোনাও কিছুই তো হচ্ছে না । শুধু গেঁজিয়েই সময় কাটিয়ে দিচ্ছি ।
এই সবটাই মিলিয়ে মিশিয়ে যেমন করে বলি আর কি , এখানের এবং ওখানের ভাষায় মিলিয়ে মিশিয়ে , তেমন করেই বললাম যদিও তবে একটু কায়দা করে ঘুরিয়েই যেন —-।
এই যে ঘুরিয়ে কথা বলার কায়দাটি আয়ত্ব করেছি ইদানীং, তাও তো এখানে এসেই !
মনে হচ্ছে প্রতিদিন অনেক সময় অপচয় করে ফেলেছি ইতিমধ্যেই ।
সকাল বিকেল আড্ডা দিয়ে সময় অপচয় করে ফেলেছি অনেক । সে সব এখন আর ভালো লাগছে না তেমন । কে যেন আমার ভেতরে আপন মনে আপনাআপনিই যেন বলে দিচ্ছে নিতান্ত স্বার্থপরের মতোন এসব বাদ বিবাদ করে তোমার কী হবে ? তুমি তো এমনিতেই অনেক পিছিয়ে রয়ে গেছো । তাই যা করতে চাইছো এখন সেটাই একটু মন দিয়ে করো না কেন!
কিন্তু কীভাবে করলে সে কাজ হচ্ছে বলে মনে হবে ? আর সেই কথাটি আমাকে কেই বা বলে দেবে ,'এই ভাবে এগিয়ে যাও , তাহলেই ঠিক হবে সবটা । '
কেমন হলে আমি বুঝতে পারবো , হ্যাঁ , এবারে এগোচ্ছি বলেই মনে হলো তো !
যদিও সে কথা বলে দেবার মতোন কেউ নেই । সত্যি কথা বলতে গেলে তো বলতে হয় , এরা কেউই তো আমার মত অকাজের কাজ নিয়ে পথে নামে নি ! এমন ব্রত কি কেউ নিয়েছে এদের মধ্যে একজনও ?
এরা তো সকলেই সেই নিয়মের পথেই চলেছে —- যেভাবে চললে জীবন একটা নিশ্চয়তা পায় । সত্যি সত্যিই পায় কি ?
আমার জীবনের পথে কীভাবে সেই নিশ্চয়তা আসবে ? আমি কি এই গো পালন করেই জীবনের কর্মের পথটি তৈরি করে নেবো ! লেখালিখি করে তো আর বেঁচে থাকা যায় না । লিখে কি অর্থ পাওয়া যাবে ? তা ছাড়া সে কথা তো মনেও আসে না কখনও ।
এই প্রথম জীবনটাকে নিয়ে ভাবতে বসলাম যেন।আর যখনই এই সব ভাবনা মাথায় আসে , তখন বিশেষ কোনো সমাধানের পথ ধরে এমন কোনোখানেই পৌঁছতে পারি না যেমন , তেমন , সে সব নিয়ে যে খুব একটা ছটফট করি তাও তো না ! কেমন করে যেন নিজের মধ্যে নিজেই গুটিয়ে যাই । কারো সঙ্গই ভালো লাগে না তখন । এমন কি কাজের দিদির সঙ্গেও কথা বলি না সে কদিন তেমন একটা । অন্য আর সকলের সঙ্গেও তেমনই করি । এরা কেউ এলেও একই । ধরা দিতে চাই না । এমন একটা ভাব করি যেন , আমি এখন ব্যস্ত আছি আমার মতো । ভীষণ কাজকর্ম নিয়ে ব্যস্ত আছি , লেখা পড়া নিয়েও , একদম কথা বলার মতন নেই ।
এই সব এমনভাবেই বুঝতে চাইছি । মনে হচ্ছে জীবনের নিশ্চয়তার কথা । সত্যিই কি নিশ্চয়তা আছে কোথাও ? তাও কেন যেন মনে হচ্ছে এসবের কোনো পথেই নেই কিছু । কারণ এদের মতোন আমি তো না ! তাহলে কেনই বা শুধু শুধু আড্ডা মেরে সময়গুলি এভাবে নষ্ট করবো ? আর এই ভাবনাটা যত তীব্রতা পাচ্ছে ততোই আমি আরো বেশি করে একা হচ্ছি । আজকাল থেকে থেকে কেবলই মনে হয় , কিছুই তো হোল না আজ ? খালি খালিই দিনটা চলে গেল !
সময় এভাবেই আমাকে বুঝিয়ে দেয় আজকাল । যেন লক্ষ্য করতে শেখায় , ভীষণ এক অস্থিরতা তৈরি করে ভেতরে ভেতরে । আর আমি তাকে যতোই লক্ষ্য করতে লাগলাম ততোই আরো বেশি করে অস্থির হোতে লাগলাম । এই অস্থিরতা এমন এক পর্যায়ে পৌঁছালো— যে , এবার আমি একা একা উদভ্রান্তের মত পথে পথে ঘুরতে লাগলাম ।
এরা কিছু মনে না করে , কদিন এসেওছে আমার খোঁজে। পায় নি ।
ও বাড়ির ফোচনের ঠাকুমা দুবেলা এসে বলে যেতে লাগলো , শোনো ভাই , কইতাসি কি তুমি এরকম সারাডা দিন কমনে কমনে হাইটে বেড়াবা , ক্যান , সেইডা কও দেহি ? তোমার মায় এহানে নাই , এই বেচারির কথাডা একবার ভাইবা দ্যাহো দেহিনি , সে যে ভাইব্বা ভাইব্বা সারা হয় , শ্যাষে আমারে জিগায় , ভাই আমার কুথায় কুথায় ঘোরে , ঘুরে ঘুরে সন্ধ্যেবেলায় বাড়ি ঢোকে, আচ্ছা কন দেহি দিদি , না নাইয়া না খাইয়া এইডা কি আরম্ভ করছে ? আমিও কই হেইডাই — কি করতাছ কি তাই কও দেহি নি আমারে একবার !
উত্তর দিই না চুপ করে ঘরের ভেতরে চলে যাই মাথা নিচু করে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে তার কথাগুলি বলা হলে । খানিকক্ষণ চেয়েও থাকি তার দিকে । তবে কিছুই বলতে পারি না ।
ফোচনের ঠাকুমা তার পরেও অনেকটা সময় বসে থেকে কাজের দিদিকে বলে , অরে খাইতে দেন তো দিদি । আমি সামনে বসে এইডারে খাওয়াইয়া হ্যার পরে যামু ক্ষণ যেহানে যাবার থায়ে —-
পথে চলতে চলতে এমন ঠাকুমা দিদিমা খুড়িমাদের কত যে দেখা পেয়েছি তা বলতে গেলে শেষ হবে না যেন একটুখানি সময়ে । তাঁদের আন্তরিকতা ভালোবাসার কত বিচিত্র প্রকাশ দেখে , এক একসময় আশ্চর্য হয়ে তাকিয়ে থেকেছি কতোই না বিস্ময়ে — মনে হয়েছে সত্যিই তো , এর চাইতে আপনার জিনিস কি আর আছে ! তখন আমার ভেতরের সব অস্থিরতা মুহূর্তের ভেতর একেবারে যেন শীতল হয়ে গেছে । আমি আবার ছন্দে ফিরে গেছি । যে ছন্দ সংসার চায় ? খানিকটা নীরবে দাবি করে হয়ত । ফোচন কাবেরীর ঠাকুমা তখন আমার আপন ঠাকুমা হয়ে সামনে দাঁড়িয়ে যায় । তাঁদের সকলের নির্দেশ তখন আর উপেক্ষা করে থাকতে পারিনি — অধিক স্নেহে ভালোবাসায় গ্রহণ করেছি মাথা পেতে ।
এরপর থেকে ও বাড়ির ঠাকুমা দুবেলা এসে অনেকটা সময় কাটিয়ে রোজকার খোঁজখবর নিতে লাগলো যেমন, তেমন কাজের দিদির সঙ্গে আবারও লুডুর কোট বসিয়ে দিল । তাতে যোগ হোল পাশের বাড়ির কাল্টুর ঠাকুমাও । কাবেরী সরবরীও। শিবানী মলিও । তাছাড়া এমনিতেও বিকেল বেলার দিকটায় ইদানীং বেশ কিছু মানুষজনের সমাগম হচ্ছে যেন একটু বেশিই । কারণ নতুন গোরুর দুধের খরিদ্দার অনেক হয়েছে । এর আগে যেরকম ঘরে অনেকটা দুধ প্রয়োজনের থেকেও বেশি থেকে যেত , এখন আর সেটা সেরকম অধিক কিছু থাকছে না । ঘরে ব্যবহারের দুধটাও পারলে নিয়ে যেতে চায় সকলে । আর সেইসব নিয়ে কাজের দিদির সঙ্গেও বেশ কিছু গাহাকের কথা কাটাকাটিও শুরু হয়ে যেতে দেখছি । অর্থাৎ আরো একটা গোরু হলেও যেন ভালো হয় । কালো গোরুটি দিন দিন দুধ দেওয়া কমিয়ে দিচ্ছে । যদিও সে জায়গাটা লালটি পূরণ করলেও চাহিদার কাছে তা কম পড়ে যেতে চায় ।
রমনীদার দোকান থেকে গোরু বাছুরের খাবার দানাভুসি নিয়ে আসি রিক্সা করে । কিছুদিন হোল এই মানুষটি ও তার বৃদ্ধ বাবা বেশ খানিকটা আপনজন হয়ে গেছে — কাছে টেনে ধরে বসায় । তার বাবা তো গেলেই তার মুদিখানার দিকটায় কাছে বসতে ডাকাডাকি করে । গল্প জুড়ে দেয় । তাঁদের দেশের গল্প বলে খুব আবেগবিহ্বল কন্ঠে । তাঁরা কীরকম ভাবে কুমিল্লার মেহের কালীবাড়ির কাছে বড়ো হয়েছে । কী সব সুখের দিন ছিল তাঁদের ! কোন কিছুরই কমতি ছিল না । গোলাভর্তি ধান ,পুকুরভর্তি মাছ , খানিকটা এগিয়ে গেলেই নদী — নদীতেও মাছের যোগান অফুরন্ত । শাকপাতা কি কিনে খেয়েছে নাকি মানুষজন ? সে সব তো আদাড়েবাদাড়ে আতোজালাই গজিয়ে উঠত । এই যে লাউডাই
কও , আর চালকুমড়াডাই কও , মিষ্টি কুমড়াডা , কাঁকরোল, ডাটা শাকডা , কলমি , ওল কচু ,আম কাঁঠাল, তরমুজডা, বাঙি, এ সব তো সামান্য একটু বীজ পুইত্তা দিলিই গজায়ে উঠত ! সারের দরকার ছিল না এহেনের মতো । কও , ছিল দরকার ?
বলতে বলতে কখন আবার আমাকেই জিজ্ঞাসা করতো ।
আমিও কখন তাঁর সেই সব জীবনের অংশীদার হয়ে উঠতাম! ফিরে যেতে শুরু করতাম এই সব কথাবার্তার ভেতর দিয়ে সেই দেশটায়, যেখান থেকে একদিন এঁরা নানা আতঙ্কে ভয়ে পালিয়ে চলে এসেছিলেন । সাতচল্লিশে না পঁয়ষট্টিতে , তা ঠিক শোনা হয়নি কখনো । আচ্ছা আমি তো কোনো ভয়ে বা আতঙ্কে ওই দেশটা ছেড়ে আসিনি ! তাহলে কেন চলে এলাম ?
একদিন যেমন খুব একটা গভীর কারণ ছাড়াই যেতে হয়েছিল , এখন আবার তেমনই বিশেষ কোনো কারণ ছাড়াই চলে এলাম । খানিকটা তো অলিখিত ভাবে বর্ডার পালিয়ে রোমাঞ্চিত হবো বলেই কাইলে মামার সঙ্গ নিয়েছিলাম ! আর সেই জন্যেই হয়তো এঁদের দেশ ছাড়ার সেই বেদনাবোধটা আমাকে খুব একটা ছুঁতে পারে না এঁদের মতোন । আমার চোখে একটা মাটি ছেঁড়াছিড়ির যন্ত্রণাবোধ যা — তাতো এই সেদিনের, একাত্তরের কথা খানিকটা । তাও তো আবার ফিরে পাওয়া সেই দেশটাই । তবুও তো সেই দুঃসহ দিনগুলিকে কি ভুলতে পেরেছি আজও ?
তারপরেও যেন মনে হয় একাত্তর দিয়েই সবটা হয়তো অনুমান করা যাবে না । তাও সেই দিনগুলির কথা কি ভুলতে পেরেছি আমি ! সে সময় তো শুধু হিন্দুধর্মাবলম্বীরাই চলে আসেনি শুধু এদেশে , অনেক মুসলমানও তো পরিবার পরিজন সহ চলে এসেছিল!
*********************************************************************************************
আগামী পর্বে
**********************************************************************************************

কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন