বুধবার, ৪ অক্টোবর, ২০২৩

ভ্রমণ কাহিনি * কল্পোত্তম


 


ত্যাগ

কল্পোত্তম


পুজোর আগে কলকাতা যাবি?------নির্মলদা একথা বলতেই আমি জিজ্ঞেস করি-----কেন?

         তিনি বলেন,"তোর যদি কাজ না থাকে, একবার গিয়ে ফিরে আয়। আমার একটু উপকার হবে। কালীদা, স্বপনদা, ঝুপ্পিদি, দুর্গাদা এদের সঙ্গে দেখা করবি। বইপত্র, চিঠি যা দেবে নিয়ে আসবি। দুর্গার কাছে বেশ কিছু পুরনো জামা কাপড়ও রয়েছে। পারলে নিয়ে আসিস। পুজোর সময় গরিব মানুষদের দেওয়া যাবে। কত মানুষ তাকিয়ে থাকে। প্রতিবছর দিই। চেয়েও নিয়ে যায় অনেকে। না দিতে পারলে খারাপ লাগবে।

          গেলে তোরও উপকার হবে। আলোপৃথিবীর শুভদীপ সেনশর্মা, মৌমিতা এদের সঙ্গে দেখা করবি। তোর বইটা করছে যখন, দেখা করলে ভালো লাগবে ওদের। সময়টা জেনে নিবি দেখা করার। ফোন করে না গেলে পাবি না। নানা কাজে ব্যস্ত থাকে সবসময়।

       হেমন্তের(কবি হেমন্ত বন্দ্যোপাধ্যায়) সঙ্গেও দেখা করিস। সত্তরের কবি অরণি বসু হেমন্তকে তোর বিষয়ে বলার পর দেখা করতে চেয়েছে। আমার পান্ডুলিটা সেই করে দিচ্ছে। যেটা তুই জেরক্স করে দিলি। আমার ব্লগের লেখাগুলো।"

------বাড়ি কোথায় ওনার?

       আমি জিজ্ঞেস করতেই নির্মলদা জানান------দক্ষিণেশ্বর।

-------সে তো অনেক দূর। সম্পূর্ণ উল্টোদিকে। সেখান থেকে ফিরতেই বেলা হয়ে যাবে। 

-------তোকে একটা প্রোগ্রাম করে নিতে হবে। কার সঙ্গে কখন দেখা করবি সেটা ঠিক করে নিয়ে সেইভাবে এগোতে হবে। না হলে শেষ করতে পারবি না। সম্ভব হলে অনুবর্তনের অনির্বাণ ধরিত্রীপুত্রের সঙ্গেও দেখা করিস। ওরও তোকে নিয়ে উৎসাহ। দেখা করলে ভালো লাগবে। তবে যাওয়ার আগে ফোন। না হলে পাবি না । তোর হোয়াটসঅ্যাপ নাম্বারে ওর তিনটে নাম্বারই পাঠিয়ে দিয়েছি। একটাতে না ধরলে অন্যটাতে করবি। তিনটার কোনোটাতে ধরবেই।

-------ঠিক আছে।

        আমি উত্তর দিয়ে নির্মলদার বুক সেলফের দিকে তাকিয়ে থাকি। নির্মলদা মাথা নিচু করে কিছু একটা লিখতে লিখতে বলেন,"আমার কাছে ভাড়া নিয়ে নিস। আগেই রিজার্ভেশন করে নিলে অসুবিধা হবে না।

          পুজোর সময় তো। অনেক মানুষ যাতায়াত করেন। অনেক ভিড়। আগে থেকে রিজার্ভেশন না করলে পাবি না। আজকেই বাড়িতে গিয়ে রিজার্ভেশন করে নিস।"

          আমি নির্মলদার দিকে নজর ঘুরিয়ে বলি-----দেখা যাক। রিজার্ভেশন করে নেওয়ার চেষ্টা করবো। না পেলে বাসে গেলেও হবে।

          আমার উত্তর শুনে বলেন,"বাসে ঘুম হবে না। গিয়ে পরের দিন ঘুরতে পারবি না। উত্তর থেকে দক্ষিণ, অনেক জায়গায় ঘুরতে হবে।

         কবে যাবি, দিনটা ঠিক করে নে আগে। সেটা ঠিক হলে সেই ভাবে প্ল্যান করবো।"

         ২১ সেপ্টেম্বর রিজার্ভেশন হয়ে যায়। ২১ তারিখ রাত্রে গিয়ে ২৪ তারিখ ফেরা। সেটাও রাত্রে, সিকেপি ধরে। রাত দশটার মধ্যে হাওড়া স্টেশন। ১২টা ৫-এ ট্রেন।

         ট্রেনের টিকিট কাটা হয়, ট্রেনে চাপা হয় না। ২০ তারিখ সকাল থেকে শুরু হয় কুড়মিদের ট্রেন অবরোধ। পুরুলিয়ার ছররা, ঝাড়গ্ৰামের খেমাশুলিতে আটকে দেওয়া হয় ট্রেন। স্তব্ধ হয়ে যায় ট্রেন চলাচল। বন্ধ হয়ে যায় যাতায়াত। টানা ৫ দিন চলে অবরোধ। টিকিট ক্যানসেল করতে হয় আমাকে।

          অগত্যা বাসে যাওয়া। কিন্তু তারও কী কম হেপা? ট্রেন না চললে বাসের যা অবস্থা সে তো জানা কথা। পা রাখার জায়গা নেই বাসে! শেষমেশ নিজের রুট বলরামপুর, বাগমুন্ডি, সুইসার বাস ছেড়ে পুরুলিয়া থেকে ঝালদা রুটের বাস ধরি আমি। পেয়ে যায় সিট।

        তখন সাতটা ত্রিশ। আটটা বাজতে আধ ঘণ্টা বাকি। সামান্য কিছু খেয়ে নেওয়াই ভালো। রাস্তায় খাওয়া-দাওয়ার সেরকম কোনো উপায় নেই। খুব বেশি দাঁড়ায় না কোথাও। শোঁ শোঁ করে ছুটতে থাকে গাড়ি। বনলতা রিসর্টে দাঁড়ালেও পাওয়া যায় না ভাত রুটি। খেলে খেতে হবে তেলেভাজা, বাচ্চার বলের মতো সাইজের ইয়া বড় পঁয়ত্রিশ টাকা দামের মিষ্টি। জঙ্গলের মাঝে বলে অন্য কোনো দোকানও নেই সেভাবে। তাছাড়া ওই গভীর রাতে আমার পক্ষে খাওয়া সম্ভবও না। 

        পুরুলিয়ার গ্ৰামে থাকি আমরা। বড়জোর ন'টার মধ্যে ঘুমিয়ে পড়ি। খাওয়া দাওয়া সেরে ফেলি আটটাতেই। দশটা এগারোটা মানে গভীর রাত। তারও অনেক পরে মাঝরাতে বনলতায় থামে গাড়িটা। চিৎকার করে বলে দেয় খালাসি,"কারো কোনকিছু খাওয়ার থাকলে খেয়ে নিন। আর কোথাও দাঁড়াবে না গাড়ি।"

          সঙ্গে সঙ্গে নেমে পড়ে সবাই। কেউ কেউ খায় কেউ কেউ খায় না। জঙ্গলের ধারে গিয়ে কমিয়ে আসে জমে ওঠা পেচ্ছাবের চাপ। খানিকক্ষণ হাঁটাচলা করে। বসে বসে আড়ষ্ট হয়ে ওঠা পা গুলো আরাম পায়। তারপর আবার উঠে পড়া বাসে।

         আমি পুরুলিয়া বাস স্ট্যান্ডেই খেয়ে নিই রুটি-সবজি। রিলাক্সের উপর খেয়ে পায়চারি মারতে থাকি বাসের সামনে। সংবাদপত্র বিক্রি করা দোকানের সামনে তখনও দু-একজন খদ্দের। তাদেরকে সাপ্তাহিক কর্মসংস্থান দিয়ে দোকান বন্ধ করতে শুরু করে তারা। সেই দোকানের বগলেই একটা কুকুর। কুন্ডলী পাকিয়ে ঘুমোচ্ছে। মহিলা বিশ্রাম কক্ষের সামনে দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে আরো একটা কুকুর। তার ছায়া দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হচ্ছে ল্যাম্পপোস্টের আলোয়। দু' তিনজন মহিলা টিউবয়েল থেকে ভরে নিচ্ছে খাবার জল। তারপর স্টার্ট হয় গাড়ি। হুড়মুড় করে উঠে পড়ে সবাই।

         দেবাশিসদা, আমি আপনার বাড়ির সামনে পৌঁছে গেছি।-----ফোন করে এ কথা বললে উনি বলেন,"আচ্ছা আচ্ছা, আমি বেরোচ্ছি। কোনদিন তো আসোনি। খুঁজে পাবে না রাস্তা।

         গিয়ে উঠলাম শিল্পী দেবাশিস সাহার নাকতলার বাড়িতে। সেখানে মায়ের সঙ্গে একা থাকেন তিনি। বউ থাকেন উত্তরবঙ্গে। শিক্ষকতা করেন। আর দেবাশিসদা নাকতলার বাড়িতে থেকে বৃদ্ধা মাকে দেখাশোনা করার সাথে সাথে এঁকে যান বইয়ের প্রচ্ছদ। সেটাই নেশা সেটাই পেশা। রাতের বেলা খাওয়া-দাওয়ার পর কাজ করতে করতে কখন যে চারটা বেজে যায় খেয়াল থাকে না। কাজ শেষে ভোর বেলা শুয়ে পড়েন তিনি।

         শিল্পকলাকে নিয়ে এক সময় অনেক স্বপ্ন ছিল। এখানে সেখানে গিয়েওছেন নিজেকে নিপুন করে গড়ে তুলতে। কাজ করতে। কিন্তু এখন আর সেই সব স্বপ্ন নেই। অন্তত প্রকট ভাবে নেই। তাই বইয়ের বিষয়ের সঙ্গে সাযুজ্য রেখে যতটুকু শৈল্পিক কাজ করে তোলা যায় প্রচ্ছদে, সেই চেষ্টাটুকুর মধ্যেই সীমায়িত করে নিয়েছেন নিজেকে। সেই চেষ্টা টুকুর মধ্যেই কাটিয়ে দেন রাতের পর রাত। সেই শিল্পীর বাড়িতেই গিয়ে উঠলাম আমি। সেখান থেকেই ঘুরব কলকাতার এ প্রান্ত থেকে সে প্রান্ত। গড়িয়ার দুর্গা দত্ত, সুনৃতা রায়চৌধুরী। নেতাজী নগরের স্বপন চক্রবর্তী, বাঁশদ্রোনী প্লেসের দীপংর রায়। সল্টলেকের কালীকৃষ্ণ গুহ, হাতিবাগানের ঝুপ্পিদি ইত্যাদি ইত্যাদি।

          সময় কম অথচ অনেক জনের সঙ্গে সাক্ষাৎ করা। একবার বেরিয়েই টুকটুক করে চলে যাওয়া অনেক জায়গায়।

          সকাল আটটার দিকে বেরিয়ে কবি দীপংকর রায়ের বাড়ি। "এবং কথা"-র সম্পাদক। সেখানেই নাস্তা খাওয়া। তারপর বেরিয়ে যাওয়া দূর্গা দত্তের উদ্দেশ্যে। তখনই ফোন আসে কবি অনির্বাণ ধরিত্রী পুত্রের,"উত্তম, এ যাত্রায় আমার সঙ্গে দেখা হচ্ছে না ভাই। ক্ষমা করো। আমাকে বেরোতে হবে এক জায়গায়। নির্মলকে বলে দিও।"

-----আচ্ছা দাদা।

     তারপর বলে ওঠেন-----নির্মল সম্পর্কে আমার একটা লেখা বেরিয়েছিল অনেক দিন আগে। সেটা আমার কাছে নেই। কোথায় বেরিয়েছিল তাও মনে নেই এখন। অনেক জনকেই বলেছি। কেউ সন্ধান দিতে পারেনি। তুমি কী একটু খোঁজ নিয়ে জানাতে পারবে?

-----চেষ্টা করব দাদা।

-----হ্যাঁ হ্যাঁ চেষ্টা করো। লেখাটা পেলে আমার খুব ভালো লাগবে।

       তারপর খানিক শ্বাস নিয়ে বলেন-----তোমরা জানো না, নির্মল কত বড় কবি! তোমরা কাছে থাকো তো, তাই বুঝতে পারো না। কিন্তু আমি বুঝতে পারি। পাহাড়ের কাছে দাঁড়িয়ে যেমন পাহাড় কতটা উঁচু, তা বোঝা যায় না। এক্ষেত্রেও তাই। কিন্তু দূর থেকে আমরা বুঝতে পারি, সে কত বড়!

         আমি কিছু মন্তব্য করি না। কে বড় কে ছোট সেই বিষয় অনুধাবন করার বয়স বোধহয় হয়নি এখনো। তাই হুঁ হাঁ করেই শুনে যাই কথাগুলো। আর উনি ফোনের ও প্রান্ত থেকে আবেগি গলায় বলে গেলেন একটানা।

এর আগে সেইভাবে কথা হয়নি ওনার সঙ্গে। কয়েক বছর আগে অনুবর্তনে লেখা পাঠিয়েছিলাম কয়েকটা। বেরিয়েওছিল। তারপর দীর্ঘদিন পাঠানো হয়নি। কিন্তু অসম্ভব স্মৃতিশক্তি! সবকিছুই মনে আছে ওনার! নাম বলতে বলতেই বলে দিলেন, "তোমার কবিতা তো বেরিয়েছে আগেও।" 

         বারো পনেরো বছর আগের বিষয় নিখুঁতভাবে মনে রাখতে পারেন তিনি! এমন মানুষ ছাড়া কী সম্পাদক হওয়া মানায়?

         দূর্গা দত্তের বাড়ি থেকে বেশ কয়েকটা প্লাস্টিকের প্যাকেট নিয়ে বেরিয়ে পড়ি। আমার বউ, নির্মলদার ভাইপো রাজাদার বউয়ের জন্য উপহার কিনে রেখেছিলেন তিনি। পুজোয় পরার শাড়ি। আর গরিব মানুষকে দেওয়ার জন্য জড়ো করে রেখেছিলেন অনেক পুরনো কাপড়। কিন্তু সেই সব নিয়ে কীভাবে ফিরব পুরুলিয়ায়? আমার একার পক্ষে কি সম্ভব? লাগেজ তো নিজেরও আছে। তাই পুরনো কাপড়ের বস্তা থেকে কয়েকটা দিয়ে বাকিগুলো অন্যভাবে পাঠানোর কথা জানালেন তিনি। 

         সেখান থেকে বেরিয়ে কবি হেমন্ত বন্দ্যোপাধ্যায়কে ফোন,"আপনি বাড়িতে আছেন তো দাদা?"

      মিহি গলায় বলে উঠলেন তিনি-----হ্যাঁ বাড়িতেই আছি।

-----তাহলে আমি আসছি?

-----না উত্তম, এসো না। পরে কখনো দেখা হবে। আমি খুব অসুস্থ জানো? একটু পরেই ডাক্তার দেখানোর জন্য বেরোতে হবে। কিছু মনে করো না।

-----না না মনে করার কী আছে? আপনি দেখা করতে বলেছিলেন তাই...

-----সে বলেছিলাম। কিন্তু এবার আর হলো না। তুমি যখন পরে কলকাতায় আসবে। তখন এসো।

       ওদিকে আর না গিয়ে রওনা দিই সল্টলেকের উদ্দেশ্যে। সল্টলেকের এইচবি-৬। কবি কালীকৃষ্ণ গুহের বাড়ি। 

-----উত্তমদা তুমি কি আসছো আমাদের এখানে?

      আলোপৃথিবী প্রকাশনের মৌমিতা ফোন করে জানতে চাই আমার কাছে।

-----হ্যাঁ আসবো, তবে একটু দেরি হবে। আমি এখন সল্টলেকে। কালীদার বাড়ি যাচ্ছি।

-----কত দেরি হবে? এক ঘণ্টার মধ্যে আসতে পারবে তো?

-----হ্যাঁ হ্যাঁ, হয়ে যাবে।

-----আচ্ছা।

      বলেই ফোন কেটে দেয় মৌমিতা।

-----এই নাও, দুটো খাম দিলাম। একটা নির্মলের জন্য। আরেকটা তোমার। নির্মলের খামের ওপর ওর নাম লেখা আছে, দেখে নিও। কয়েকটা ম্যাগাজিন নিয়ে যাও। নির্মলকে দিয়ে দেবে। আর আমার ছেলের একটা কাব্যগ্রন্থ। বেশি কপি নেই আমার কাছে। না হলে তোমাকেও দিতাম। এটা তার প্রথম কাব্যগ্রন্থ।

       বইটার দিকে তাকাতেই চিনতে পারি আমি। কালীদাকে বলি-----এটা আমাকে আগেই দিয়েছেন আপনি। এর আগেরবার যখন এসেছিলাম, তখন। বইটা বেশ ভালো।

-----ও দিয়েছি। তাহলে ভালোই হল। এখন আমার অনেক কিছুই মনে থাকে না। বয়স হলো তো।

-----হ্যাঁ।

       ওনার কথাতে সায় দিই আমি। তারপর বলেন,"দুপুরে খেয়েছো?"

-----না খাইনি।

-----আজ আমার বাড়িতে কেউ নেই। তোমাকে কিছু খাওয়াতে পারবো না। রাস্তার পাশেই একটা হোটেল আছে। সুন্দর খাবার দেয়। সেখানে গিয়ে খেয়ে নিও।

        বলেই ১০০ টাকা ধরিয়ে দেন হাতে। আমি বেরিয়ে পড়ি।

        মৌমিতার ওখানে এর আগে যাইনি। যাওয়ার সময় অনেকবার জিজ্ঞেস করতে হয় রাস্তা। শহরের রাস্তাগুলো আমার কাছে কেমন যেন। সব সময় একই মনে হয়। একটার থেকে আরেকটাকে আলাদা করা কঠিন হয়ে ওঠে। গুলিয়ে যায়। গ্রামাঞ্চলে এত তো আর রাস্তা নেই। থাকলেও এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্ত দেখা যায় অনায়াসে। এ পাড়ার বাড়ি থেকে ও পাড়ার বাড়ি দেখিয়ে দেওয়া যায় আঙুল তুলে। সেই জিনিসটা হয়ে ওঠে না শহরে। তাই হারিয়ে যায়। জানা জায়গাকে যাওয়ার জন্যও বারবার জিজ্ঞেস করতে হয় পথচারীদের।

      স্বপন চক্রবর্তীর বাড়ির পথ নতুন কিছু নয়। শুন্য দশক থেকে যাতায়াত করছি সেখানে। ১৮-২০ বছর হয়ে গেল। তবুও ভুলে যাই। কাউকে জিজ্ঞাস না করলেও ঘুরতে হয় অনেকক্ষণ।

       মৌমিতা শুভদীপের সঙ্গে নিজের বই নিয়ে অনেকক্ষণ কথা হলো। কথা হলো আমার "অরন্ধন" ওয়েব ম্যাগাজিন সম্পর্কেও। সুন্দর একটা ছোট রুমের মধ্যে সাজানো গোছানো অফিস। থরে থরে বই, ম্যাগাজিন। কার বই নেই সেখানে? পুরনো থেকে শুরু করে নতুন, প্রায় সকলেরই বই হয়েছে ইতিমধ্যেই। চলছে কাজও। একটা রুদ্ধশ্বাস যাত্রা নিয়ে এগিয়ে চলা তাদের। অটুট প্রাণশক্তি!

        সেখান থেকে হাতিবাগান। কবি প্রসূন বন্দ্যোপাধ্যায়ের বোন ঝুপ্পিদির বাড়ি। তারপর বেরিয়ে পড়া নাকতলা। শিল্পী দেবাশিস সাহার আস্তানায়।

        তখন সন্ধ্যা। নাকতলার পূজা প্যান্ডেলে জাঁকিয়ে ভিড়। আমি আর দেবাশিসদা বেরিয়ে গেলাম মূল রাস্তায়। খানিকটা ফাঁকা এটিএম খুঁজছেন তিনি। টাকা তুলবেন। হাতে নগদ প্রায় শেষ।

        দেবাশিসদা দোতলায় একটা রুম বানিয়েছেন। ছোট্ট রুম। সেখানেই স্টুডিও করতে চান তিনি। নিরিবিলি ভাবে কাজ করতে চান একা একা। কোনো বন্ধু এলেও রাখতে চান সেখানেই। যাতে অসুবিধায় হয় পড়তে না হয় তাঁকে।

        আমাকে নিয়ে ঢুকে পড়েন শপিং মলে। "উত্তম, তুমি তোমার বর্তিকার জন্য একটা জামা পছন্দ কর। সুন্দর একটা জামা। আমি তো ওর মাপ জানি না। তুমিই বুঝতে পারবে, কোনটা হবে কোনটা হবে না।"

-----ওর জন্য কিনতে হবে না। আমি ভাবলাম আপনি নিজের কিছু কিনতে আসছেন। ছেড়ে দিন ছেড়ে দিন।

      বলেই শপিং মল থেকে বেরিয়ে যেতে উদ্যত হলে ধরে ঘোরান তিনি।

-----আরে নাও না। ও তো আমারও মেয়ের মতো। ওকে খুব ভালো লাগে আমার। তুমি যে ওর ছবির সঙ্গে একটু একটু করে লেখা দাও না ফেসবুকে, আমি পড়ি। আর অবাক হয়ে যায়। এত ভালো লাগে না, কি আর বলি। আমাদের শহুরে জীবন কেমন যেন। তোমাদের মুক্ত গ্রাম্য জীবনের ওইসব কথাগুলো পড়তে পড়তে ছোটবেলার কথাগুলো মনে পড়ে যায়। ছোটবেলায় আমরাও গ্রামেই থাকতাম। তারপর শহরে চলে এলাম। কতদিন হয়ে গেল। এখন বোরিং লাগে এইসব।

        আমি আর কথা না বাড়িয়ে বাছতে শুরু করি। একটা পছন্দও হয়ে যায়। শংকর মাছের আকার বিশিষ্ট। জামাটা পরার পর হাতগুলো দুপাশে মেললেই শংকর মাছের মতো দেখতে লাগবে মেয়েকে। সেটাই কিনে নিই আমরা। তারপর বেরিয়ে পড়ি।

        ট্রেন থেকে নেমে সোজা নির্মলদার বাসায়। তাঁর জিনিসপত্র দিয়ে ফিরতে হবে বাড়ি। তিন চার দিন হয়ে গেল। বউ বাচ্চার দায়িত্বে রেখে এসেছি সবিতাকে। আমার ছোট শ্যালিকা। সেও বিরক্ত হবে এতদিন।

-----অসুবিধা হয়েছিল কিছু?

       বাসায় পা রাখতে জিজ্ঞেস করেন নির্মলদা। আমি চটি খুলতে খুলতে উত্তর দিই-----না। কলকাতায় গেলে আমার কোনো অসুবিধা হয় না। তবে এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্ত যাওয়া আসা করতে করতে ক্লান্ত হয়ে যায়। কম কী দূরত্ব?

-----যতদিন বেঁচে আছি, করে দে ভাই। তুই ছাড়া কে আর করবে? দেখেছিস তো, আমাদের ছানাপোনাদের কান্ডকারখানা। নিজের ভালোর জন্য যেতে বললেও যেতে চায় না। নিজের স্বার্থেও তো যাওয়া দরকার বল? এদের যে কি হবে? স্বার্থ ত্যাগ না করলে সাহিত্য হয় না। এমনি এমনি আশীর্বাদ দেয় না মা সরস্বতী। ত্যাগ করতে শিখতে হবে। শুধু পাওয়ার আশা করব, দেব না কিছুই, এভাবে হয় না।


*******************************************************************************************************



 কল্পোত্তম

নিরলস সাহিত্যচর্চায় মগ্ন তরুণ কবি কল্পোতম । একটি উপন্যাস সহ ইতিমধ্যেই তিনি লিখে ফেলেছেন পাঁচটি গ্রন্থ । কাব্যগ্রন্থ  *  সাতরঙা পাড়  *  বত্রিশ নম্বর জাতীয় সড়ক* ঝুমুর সঙ্গীতের বই  * রিঝে রঙে  উপন্যাস  *  পেইন্টেড ট্রেন  গল্পগ্ৰন্থ  *  স্বপ্নসিঁড়ি* সম্প্রতি প্রকাশিত





২টি মন্তব্য:

  1. উত্তমের "ফায়দার তত্ত্ব"-এর পূর্ণঙ্গ v প্রতিফলন লেখটি | চাওয়া- পাওয়া আর প্রলুব্ধক ফুলঝুবির বলবলাইয়া..... বাবাজীর খুর খুরে দম্ভবৎ

    উত্তরমুছুন
  2. অসাধারণ বললেও কম হয়... খুব খুব ভালো লাগলো পড়ে দাদা

    উত্তরমুছুন