বুধবার, ৪ অক্টোবর, ২০২৩

গল্প * দেবাশিস সাহা

 



হরিরলুট  

দেবাশিস সাহা 


" ইউক্রেনের বিরুদ্ধে রাশিয়ার যুদ্ধ ঘোষণার আজ সপ্তম দিন। এদিন রাশিয়ার আক্রমণ আরও ভয়ঙ্কর , আরও বিধ্বংসী আকার ধারণ করেছে। একদিকে ভ্যাকিউম বোমা, ক্লাস্টার বোমার মতো গণবিধ্বংসী অস্ত্রের ব্যবহার যেমন তাঁরা শুরু করেছে , তেমনই অন্য দিকে, রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন পরমাণু যুদ্ধের হুঁশিয়ারি দিয়েছেন। ইতিমধ্যে তিনদিক থেকে ইউক্রেনকে ঘিরে ফেলেছে রাশিয়া। জ্বলছে ইউক্রেনের দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর খারকিভ। ইউক্রেন থেকে সরাসরি এখন আমরা আপনাদের সেই দৃশ্য দেখাব... অনীক,অনীক শুনতে পাচ্ছ ...' হ্যাঁ, হ্যাঁ মালবিকা,শুনতে পাচ্ছি.'.. তুমি আমাদের দেখাও, ঠিক এই মুহূর্তে রাশিয়ার আক্রমণে বিধ্বস্ত ইউক্রেনের সামগ্রিক চেহারাটা কেমন আকার নিয়েছে। ওয়ার্ল্ড এক্সক্লুসিভ ... সরাসরি ইউক্রেন থেকে...অমনি টিভি স্ক্রিনে একে একে ভেসে উঠতে থাকল লাগাতার বিস্ফোরণের প্রতিক্রিয়া...কীভাবে দাউ দাউ জ্বলছে প্রাসাদোপম অট্টালিকা, ঘর-বাড়ি, স্কুল -কলেজ, হাসপাতাল, রেস্তোরাঁ... ' দ্যাখো, মালবিকা ' জানাচ্ছে অনীক... 'এই মুহূর্তে খারকিভ শহরের প্রাণকেন্দ্র ফ্রিডম স্কোয়ারে প্রশাসনিক দপ্তরগুলিতে মুহুর্মুহু আছড়ে পড়ছে ক্ষেপণাস্ত্র। ভয়ার্ত মানুষ আশ্রয় নিয়েছে বাঙ্কারে , নয়তো  মেট্রো স্টেশনে । কৃষ্ণসাগরের তীরে মারিয়ুপোল বন্দরে চলছে লাগাতার গোলাবর্ষণ । খেরসন এলাকার প্রায় দখল নিয়ে ফেলেছে রুশ বাহিনী। চারপাশে শুধু ধ্বংসস্তূপ… '  অনেক ধন্যবাদ অনীক, সঙ্গে থাকো, সাবধানে থাকো, আবারও তোমার কাছে আসব।''

           ‘ শিয়রে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ ‘--- শিরোনামে একটি জনপ্রিয় টিভি চ্যানেলে  রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের আপডেট দেখছিলেন অবসরপ্রাপ্ত ইতিহাস অধ্যাপক নিমাইকান্তি সেন । পাশের ঘরে নেট পরীক্ষার প্রিপারেশনে ব্যস্ত  রিমঝিম, নিমাইকান্তির একমাত্র মেয়ে। এদিকে,বছর বারোর নাতি অরিন, দাদুর কোলে মাথা রেখে মোবাইলে গেম খেলছে একমনে । সামনে খোলা অঙ্ক বই, হাওয়ায় উড়ছে হোমটাস্কের খাতা , চতুর্দিকে ছড়ানো ছেটানো স্কেল- কম্পাস, পেন -পেনসিল।সংবাদপাঠিকা মালবিকার  রোমহর্ষক সংবাদ পরিবেশনে আরও নড়েচড়ে বসেন নিমাইকান্তি।

             ''গতকাল আমেরিকান কংগ্রেসের সদস্যদের সঙ্গে বৈঠকের পরে সে দেশে ইউক্রেনের রাষ্ট্রদূত ওকসানা মারকারোভা বলেছেন-- ' রাশিয়া আজ ভ্যাকিউম বোমা ফেলেছে। ইউক্রেনে বড় ধরনের ধ্বংসলীলা চালাচ্ছে তারা। '  কী এই ভ্যাকিউম বোমা? আর ক্লাস্টার বোমাই বা কী ? ''  আগ্রহ সঞ্চারকারী স্বরক্ষেপ মালবিকার। টিভির আর একটু কাছে এগিয়ে বসেন নিমাইকান্তি।

           " আস্ত একটা মানুষকে মুহূর্তে বাষ্প করে দিতে পারে ভ্যাকিউম বোমা। বিস্ফোরণের সময়ে এই বোমা আশপাশ থেকে সমস্ত অক্সিজেন শুষে নিয়ে বিরাট আগুনের গোলা ছড়িয়ে দেয়। আর, একটি ক্ষেপণাস্ত্রের মধ্যে ঠাসা বহু ছোট ছোট বোমার সমষ্টি হল ক্লাস্টার বোমা। স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল ও হিউম্যান রাইটস ওয়াচের অভিযোগ, ইউক্রেনে এই বোমা অনিয়ন্ত্রিত ভাবে ব্যবহার করছে রাশিয়া…এখন একটা ছোট্ট বিজ্ঞাপন বিরতি,যুদ্ধের যাবতীয় খবর নিয়ে শীঘ্রই ফিরছি। সঙ্গে থাকুন।“

         এক কোটি ছ'টাকায়... কোটি টাকা ছ'টাকায় 

         মাত্র ছ'টাকায় এক কোটি?

           আজ্ঞে হ্যাঁ।

           মাত্র ছ'টাকায় এক কো-টি টা-কা!


            " দাদুভাই,ওই লোকটা কে বলোতো? '' গেম থেকে  এইবার অরিনের চোখ টিভির পর্দায়।

           ''কোন লোকটা?''

            ''ওইযে, যে-লোকটা মাছ কাটতে কাটতে অবাক হয়ে চোখটা ঘোলাটে করে জিজ্ঞেস করছে, মাত্র ছ'টাকায় এক কোটি?"

             ''আমি কী করে জানব ,দাদুভাই! ''

            ''কেন,জানবে না কেন, ওই লোকটাই তো 'ভূতের ভবিষ্যৎ' সিনেমায় বাঙাল ভাষায় কথা বলছিল, ক'দিন আগেই তো ইউ টিউবে সিনেমাটা দেখলে,  ভুলে গেছ ?''

            ''আমার অত …''

          কথাটা শেষ হওয়ার আগেই চায়ের ট্রে হাতে টিভির ঘরে ঢুকল , রূপকথা, অরিনের মা, '' বাবা, চা।''

            ''রাখো,বৌমা ।''

             ছেলের হাতে মোবাইল দেখে রাগ সপ্তমে চড়ল রূপকথার, “ তোকে যে বললাম দাদুর কাছে হোমটাস্কগুলো করে নে, আর তুই সক্কালবেলা…” বলতে বলতে অরিনের গালে ঠাস করে একটা চড় কষিয়ে দেয় রূপকথা ।

            “ বৌমা, কথায় কথায় ছেলে-মেয়েদের গায়ে অত হাত তুলো না। ওভাবে পড়াশোনা শেখানো যায় না। ভালবেসে বলো, নিশ্চয়ই করবে,অরিনদাদা আমার কত ভাল ছেলে!’’

          চড়টা তত জোরে পড়েনি, তবুও দাদুর প্রশ্রয় পেয়ে অরিন কাঁদতে শুরু করল, '' দাদুকে তো বললাম, দাদু খবর দেখছে, না করালে আমি কী করব!''

             অরিনের পক্ষ নিয়ে নিমাইকান্তি বলেন, '' ওই তো কটা অঙ্ক , এক্ষুনি হয়ে যাবে, চিন্তা কোরো না বৌমা।"

             শ্বশুরমশাইয়ের মুখের উপর কিছু বলতে না পারলেও রাগে গজগজ করতে থাকল রূপকথা , ''এদিকে এসো, সকালের টিফিনটা গিলে উদ্ধার করো, পিসিকেও ডেকে আনো। তাড়াতাড়ি। "

              পিসির হাত ধরে, চোখ মুছতে মুছতে অরিন ডাইনিংয়ে গেল। " কী টিফিন করলে, বৌদি? " রিমঝিমের কৌতূহল।

              "কী আবার ! ডাল,রুটি আর ডিম সেদ্ধ।''

              "সেই থোড়-বড়ি-খাড়া,খাড়া-বড়ি-থোড়... কাল রাতে যে বললে, লুচি তরকারি করবে?"

             " সময় পেলাম কোথায় বল, দু'দিন ধরে মালতী  আসছে না, ঘরদোর মোছা,, বাসি জামা কাপড় কাচা রাজ্যের কাজ, তার উপর তোর দাদা বলে রেখেছে আজ দশটায় বেরোবে, স্কুলে কী পরীক্ষার গার্ড আছে। "

             " আচ্ছা আচ্ছা, একটু দম নিয়ে বলো.."

             "রাগ করিস না ছোট, রোববার ঠিক খাওয়াব।"


               কী মনে পড়ায় রূপকথা দৌড়ল শ্বশুরমশাইয়ের ঘরে , " বাবা! ''

              ''হ্যাঁ,বলো।''

              ''একটু বাজার যেতে হবে বাবা। আপনার ছেলে তো স্কুলে বেরিয়ে যাবে।''

              ''কেন? কাল না, পরশুই তো বাজার করলাম যেন! '

             ''না,বাবা, রান্নার বাজার আছে, ঠাকুরের জন্য একটু ফুল আর মিষ্টি আনতে হবে,ফুলওলাটা আজ আসেনি।'’

            '' ঠিক আছে বৌমা, চা-টা খেয়ে যাচ্ছি।''

 

             রূপকথা যেতেই টিভির ভলিয়্যুমটা বাড়িয়ে দেন নিমাইকান্তি। কণ্ঠস্বরের ওঠানামায় নাটকীয় ভঙ্গিতে যুদ্ধের খবর পড়ে চলেছে মালবিকা ---" একদিন আগেই ইউরোপীয় ইউনিয়নে যোগ দেওয়ার আবেদন পত্রে সই করেছেন ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট জেলেনস্কি। এবার কি  তাহলে ইউরোপ যোগ দিচ্ছে ইউক্রেনের পক্ষে,বিশেষ করে নেটো ? আমরা জানি না, আগামীদিনই সে কথা বলবে, এদিকে, আমেরিকান  সংস্থার একটি উপগ্রহ চিত্রে ধরা পড়েছে, ইউক্রেনের রাজধানী কিভের দিকে এগোচ্ছে রুশ সেনার প্রায় চৌষট্টি  কিলোমিটার দীর্ঘ এক কনভয়। সাঁজোয়া গাড়ি থেকে কামান --- সব ধরনের অত্যাধুনিক সমরাস্ত্র মজুত রয়েছে তাতে। "

               " ও দাদুভাই,মা ডাকছে তো!"

               "যাচ্ছি, বৌমা। "

              রিমোট হাতে টিভির সুইচ বন্ধ করার আগে শেষবারের মতো শুনে নিচ্ছেন, উত্তুঙ্গ মালবিকার কণ্ঠস্বর  ----

                "রাশিয়ার প্রতিরক্ষা মন্ত্রক বলেছে, এবার কিভে আরও সুনির্দিষ্ট হামলা চালানো হবে।প্রতিরক্ষামন্ত্রী সের্গেই শোইগুর বক্তব্য, ' লক্ষ্যে পৌঁছনো না-পর্যন্ত অভিযান চলবে। পশ্চিমী দেশগুলির আগ্রাসন থেকে রাশিয়াকে বাঁচাতে ইউক্রেনের অস্ত্রসমর্পণ এবং সে দেশকে নাৎসিদের কবল থেকে মুক্ত করাটাই আমাদের লক্ষ্য।' " 

                ''একটা ব্যাগ দাও বৌমা।''

               '' ব্যাগ লাগবে বাবা,শুধু তো --''

              '' না,যাচ্ছি যখন কিছু টাটকা আনাজপাতি পেলে নিয়ে আসব।''

              দাদু বেরনোর আগে, পথ আগলে দাঁড়াল অরিন, '' দাদুভাই, তুমি কিন্তু আমাকে গল্পটা বললে না, খালি খবরই দেখে গেলে! তোমার সঙ্গে আড়ি।''

               "কোন গল্পটা দাদাভাই?"

               "দোল পূর্ণিমার দিন যে -গল্পটা বলছিলে। "

              "ও, চৈতন্য মহাপ্রভুর গল্প? "

             "হ্যাঁ, তুমিই তো বললে,আজ শ্রীচৈতন্যের জন্মদিন,আজ আর গোয়েন্দা বা ভূত-পেতনির  গল্প না, মহাপ্রভুর গল্প শোনো।" অরিনের গালটা টিপে আদর করে নিমাইকান্তি বলেন, '' ও আচ্ছা আচ্ছা, রাগ করে না দাদাভাই, এসেই বলব। ''

             স্নান সেরে বেরোতে বেরোতে দাদু-নাতির সমঝোতা কানে যেতেই, হুঙ্কার ছাড়ে অরিনের বাবা,অরিন্দম, '' তুমি অত লাই দিও না তো বাবা, আদরে আদরে বাঁদর তৈরি হচ্ছে ছেলেটা । এ প্লাস বি হোল স্কোয়ারের ক'টা অঙ্ক নিজে করতে পারে না, দাদুর সাহায্য লাগবে ! এই পড়াশুনোর ছিরি! ''

               "ওর মতো বয়সে তুইও কম বাঁদর ছিলি না খোকা! " হাসতে হাসতে কথাটা বলে, বাজারের পথে পা বাড়ান নিমাইকান্তি।

           দৌড়ে এসে হাঁক পাড়ে  রূপকথা,'' বাবা!''

           পিছন ফেরেন নিমাইকান্তি।

            '' মাস্কটা পরে নিন।''

           '' হ্যাঁ তাইতো, দাও।''


         মাস্ক! এই হয়েছে এক অঙ্গের ভূষণ। শুধুই কি মাস্ক! স্যানিটাইজ,সোশ্যাল ডিসট্যান্স,লকডাউন,নাইট কার্ফু,ভ্যাকসিনেশন,কোভিশিল্ড,কোভ্যাকসিন... যা গেল তিনটে বছর! কতদিন পর আজ সকালেই কাগজে দেখছিলেন, তিন বছরে এই প্রথম, করোনায়  আক্রান্ত হয়ে রাজ্যে মৃতের সংখ্যা নেমেছে শূন্যতে, আর দৈনিক সংক্রমণ নেমে এসেছে একশোর ঘরে। দীর্ঘ জীবনে, মানুষের জীবন-জীবিকা এমন প্রশ্নের মুখে পড়তে দেখেননি ষাটোর্ধ্ব নিমাইকান্তি। তাঁর  সংসারে অর্থনৈতিকভাবে অতিমারির কোপ ততটা পড়েনি অবশ্য। নিজে তিনি মোটা টাকা পেনশন পান। ছেলে স্কুল-টিচার হওয়ার সুবাদে, ঘরে বসেই মাইনেটা পেয়ে গেছে। মোটে তো পাঁচটা প্রাণীর সংসার। অর্থকষ্ট তাঁকে খুব একটা কাবু করতে পারেনি । কিন্তু যে-কষ্টটা অহরহ তাঁর বুকে শেলের মতো বিঁধছে , সেটা হল, চল্লিশ বছরের ছায়াসঙ্গিনী আশালতার প্রায় নিঃশব্দে চলে যাওয়া। করোনা পজিটিভ হওয়ার তিনদিনের মধ্যেই নিদারুণ শ্বাসকষ্টে চলে গেল আশালতা! আইসিইউ..ভেন্টিলেশন...লক্ষ লক্ষ টাকা...কোনওকিছুই কাজে এল না। করোনার প্রথম ঢেউ কোথায় ভাসিয়ে নিয়ে গেল তাঁর আশালতাকে, চল্লিশটা বছর যে আশা ও লতার মত জড়িয়ে ভালবাসার ছায়া দিয়ে ঘিরে রেখেছিল নিমাইকান্তির জীবন। আজ সেখানটা বড় ফাঁকা, ধু ধু মরুভূমি যেন!



                '' ভালো আছেন স্যর?''  বছর সাতাশ-আঠাশের একটি যুবক  প্রায় দৌড়ে এসে পথচলতি নিমাইবাবুর পা স্পর্শ করল। নিজেকে দ্রুত সামলে নেন  নিমাইকান্তি, '' থাক থাক , কে, অনিকেত না!''

              '' হ্যাঁ স্যর। ''

            ''কী পড়ছ এখন, অনিকেত ?''

            ''এবার পিএইচডি-র পেপার জমা দেব,স্যর।''

            '' কী যেন বিষয় ছিল তোমার? ''

             '' পৃথিবীর অর্থনীতিতে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের প্রভাব।'' একটু থেমে ফের যোগ করল অনিকেত , '' রাশিয়া-ইউক্রেনের যুদ্ধটা ভাল করে বোঝার জন্য ইংরেজি বাংলা চার-পাঁচটা কাগজ কিনে ফিরছি, স্যর। ''

            '' তা বেশ, তবে পেপার পড়ে এই  যুদ্ধের আর কতটুকু বুঝবে, এর শিকড় অনেক গভীরে।''

           '' তা তো বটেই স্যর,দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ব্যাপারটা পড়তে গিয়ে খানিকটা টের পেয়েছি ।''

           '' আরও পাবে,পড়ো, পড়ো। মানুষের আয়ু বড় কম, সারা জীবন কত কিছু না-পড়া থেকে যায়।''

          ''একদিন আপনার বাড়িতে যাব, স্যর। কিছু বিষয় জিজ্ঞাসার আছে।''

          '' নিশ্চয়ই, এসো। রাস্তায় দাঁড়িয়ে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কতটুকু বোঝা যাবে।’'

            '' আসছি স্যর। ''


           অনিকেতের দিকে কয়েক মুহূর্ত অপলক তাকিয়ে  থাকেন নিমাইকান্তি। ছেলেটার নম্র স্বভাব এবং উজ্জ্বল মেধা বরাবর আকর্ষণ করে এসেছে তাঁকে। তাঁরই কলেজের ছাত্র। খুব ছেলেবেলায় বাবাকে হারায়। মায়ের অশ্রুভেজা পথে হেঁটে ওর এত দূর আসা। জীবনের কঠিন কঠোর বাস্তব ওকে শিখিয়েছে সতর্ক পা ফেলা। মনে পড়ে, কলেজে প্রথম পরিচয়ের দিন তিনি যখন অনিকেতকে প্রশ্ন করেছিলেন--' সবাই ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ার হতে চায়,তুমি কেন ইতিহাস পড়তে চাইছ ?’ ওর সপ্রতিভ জবাব ছিল—‘ স্যর, কেন জানি না আমার কেবলই মনে হয়, ‘হাজার বছর ধরে আমি পথ হাঁটিতেছি পৃথিবীর পথে’… সেই পথের রেখা ধরেই আমি জীবনকে খুঁজতে চাই।‘ সেদিন নিমাইকান্তি শুধু মুগ্ধ হয়েছিলেন তাই নয়, কী এক আত্মিক টান অনুভব করেছিলেন। তাই কলেজ, নিজের বাড়ি এবং মনের দরজা সব সময় হাট করে খোলা রেখেছেন অনিকেতের জন্য। শিক্ষক-ছাত্রের সম্পর্ক কোন সময় যেন হয়ে উঠেছে পিতা-পুত্রের নিকট সম্পর্ক।


               বাজারের পথে এগোতে থাকেন নিমাইকান্তি। কী যেন নিতে বলেছিল বৌমা, মনে করার চেষ্টা করেন, হ্যাঁ হ্যাঁ ফুল আর ঠাকুরের জন্য মিষ্টি। ইদানীং কেমন যেন  বিস্মৃতির  একটা হালকা কুয়াশা ঘিরে ধরছে মনকে। মাঝে মাঝেই। একটা কথার পর আর একটা গুরুভার কথা এসে পড়লেই, আগের কথাটা আর মনে করতে পারছেন না। আগে এমন হত না। আশালতা চলে যাওয়ার পর থেকেই, জগৎ সংসারের প্রতি কেমন যেন একটা অনাসক্তি কাজ করছে। সেই অনাসক্তি থেকেই কি এই জাগতিক বিভ্রম…ভেবে পান না নিমাইকান্তি, তবে টের পান, যতটুকু আসক্তি এখনও কাজ করছে,তার সবটুকুই মেয়ে রিমঝিম আর  অরিনকে ঘিরে। মেয়েটা কিছুতেই বিয়ে করতে চাইছে না। নিজের পায়ে না দাঁড়িয়ে বিয়ে করবে না,পণ করে বসে আছে। দাদার মতো ও স্কুল টিচার হতে চায় না, প্রফেসর হবে। এমএ কমপ্লিট করে নেট-সেট দিয়ে যাচ্ছে নিয়মিত, শিকে ছেড়েনি যদিও। মৃত্যুর আগে আশালতা ওঁর দুটো হাত ধরে বলে গেছে, " আমার ডাক এসেছে...যাচ্ছি …মেয়েটাকে একটা যোগ্য পাত্রের হাতে তুলে দিয়ো। "

              যোগ্য পাত্র তো নিমাইকান্তির হাতের মুঠোতেই রয়েছে। ওঁর বন্ধু অবিনাশ চাটুজ্জে কবে থেকে বলে আসছে—‘তোর মেয়েটা রূপে লক্ষ্মী গুণে সরস্বতী, তুই সম্মতি দিলেই আমার ছেলের বউ করে আনব।‘ স্বপ্নদীপ, অবিনাশের ছেলে, কি কম যোগ্য! সদ্য ডাক্তারী পাশ করে সরকারি হাসপাতালে ঢুকেছে ,সেই সঙ্গে প্রাইভেট প্র্যাকটিসও করছে। কিন্তু মেয়েই তো রাজি হচ্ছে না। কী জানি, কী ইচ্ছে আছে ওর মনে।


             পঁয়ষট্টি পেরোল, বয়স আরও বাড়লে কী হবে, কে দেখাশোনা করবে, সেসব নিয়ে অবশ্য নিমাইকান্তির খুব একটা মাথাব্যথা নেই। আর থাকবেই বা কেন, আশালতা চলে গেছে ঠিকই, কিন্তু তারই ছায়াটা যেন পুরে রেখে গেছে বৌমার মধ্যে। পিছু পিছু ফিরছে সর্বক্ষণ। খুব ছেলেবেলায় রূপকথা হারিয়েছে নিজের বাবাকে। তাই নিমাইকান্তির মধ্যেই বাবার ছায়া খুঁজে বেড়ায় সারাক্ষণ। সকাল হতেই ব্রাশে পেস্ট লাগিয়ে হাতে ধরিয়ে কড়া নির্দেশ--- বাবা আগে দাঁত মাজুন, টিভি চালাবেন না । দাঁত মাজা শেষ না-হতেই, এক হাতে ওষুধ আর হাতে জলের গ্লাস নিয়ে হাজির--- প্রেশারের ওষুধটা খান আগে, তারপর চা আনছি। টিভি চালাবেন না কিন্তু, চালালেও বেশিক্ষণ দেখবেন না, চোখে চাপ পড়বে, ডাক্তার কিন্তু আগেরবারই বারণ করেছে। আর যুদ্ধের খবর একেবারেই দেখবেন না। ওতে টেনশন বাড়ে, টেনশন থেকে প্রেশার, আর প্রেশার থেকে....কিন্তু কে শোনে কার কথা! রক্তে যাঁর বইছে ইতিহাসের স্রোত, সে স্রোতকে তিনি  উল্টোপথে ঘোরাবেন কেমন করে! কাজেই,বৌমার বারণ সত্ত্বেও, সকালেই এক প্রস্ত  রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের খবর চাক্ষুষ করে এসেছেন, নাতিকে অঙ্ক না করিয়ে। তাতে হয়তো বৌমা একটু রাগ করেছে, তা করুক গিয়ে, ও রাগ আবার জল হয়ে যাবে, যখন তিনি একসঙ্গে অরিনকে তিরিশ-চল্লিশটা অঙ্ক করিয়ে দেবেন কিংবা দুপুরে খাওয়া- দাওয়ার পর বুকে জড়িয়ে, প্রাচীন ভারত বা মধ্যযুগের ভারত ইতিহাসের গল্প শোনাবেন। কাজেই ফুল-মিষ্টি নিয়ে তাড়াতাড়ি বাড়ি চলো। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের খবরটা দেখার জন্য উসখুস করছে মনটা....


             ইউক্রেনে ডাক্তারি পড়তে যাওয়া ছাত্রগুলো সবাই কি বাড়ি ফিরতে পারল? কতদূর সফল হচ্ছে ভারতের ' আকাশগঙ্গা অভিযান'? মারিয়ুপোল বন্দরে রুশ সেনারা কি এখনও নির্বিচারে ক্ষেপণাস্ত্র হানছে? কিভের দিকে কতদূর এগোল রুশ সাঁজোয়া বাহিনী? বাঙ্কারে, মেট্রো স্টেশনে যেসব ইউক্রেনীয়রা আশ্রয় নিয়েছে,তারা কী পোল্যান্ড, রোমানিয়া সীমান্ত পেরোতে পারল? অপেক্ষারত বাংলাদেশের জাহাজে যে ছেলেটি ক্ষেপণাস্ত্র হামলায় মারা গেল, বাজারে আসার আগে শুনে এলেন, তার দেহ কবে পৌঁছবে ছেলেটার বাবা-মায়ের কাছে?



                                       দুই


"তোর কোনটা ভাল লাগে--- পাহাড়, না সমুদ্র?"

            "কোনওটাই না।"

         “ সে কী রে, কেমন মানুষ তুই? তাহলে কী ভাল লাগে তোর? "

            "চব্বিশ ঘন্টা তোর ঠোঁটে ঠোঁট ডুবিয়ে রাখতে। "

          “ ভারী অসভ্য তুই! "

            "অমনি সভ্যতা নিয়ে টানাটানি করছিস? সত্যি কথাটা বললেও দোষ! "

            "ক'টা লোক মনের কথা খুলে কথা বলে বলতো? সবারই মুখে এক, মনে আর-এক, আমার মন মুখ এক, তাই যা বলি মন থেকেই বলি।"

           "জানি তো! সেই জন্যই তো তোকে এত --- "

           "থাক আর গুল দিস না। সক্কাল সক্কাল ফোনটা করেছিস কেন, বল।" অবিশ্বাস আর বিরক্তি মিশিয়ে বলে অনিকেত। ওঘরে অনলাইন ক্লাসের জন্য রেডি হচ্ছে অরিন। গেরস্থালীর কাজে ব্যস্ত রূপকথা। গলাটা একটু নামায় রিমঝিম , " গুল মারলে এত বছর আমাদের প্রেমটা টিকতো? কবে থেকে প্রেম করছিস বলতো? "

             "কেন, সেই ক্লাস ইলেভেন থেকে, যখন তোদের বাড়িতে প্রথম গেলাম, স্যরের কাছে ইতিহাস পড়ব বলে।" চটজলদি উত্তর অনিকেতের।

            "থাক বাবা ধন্য, তা-ও মনে আছে! দিনরাত তো থিসিস আর বইয়ে মুখ গুঁজে থাকিস।" অনুযোগের সুরে কথাটা বলে এবার একটা আবদার জুড়ে দেয় রিমঝিম, " শোন, তোর যে ইচ্ছেটার কথা একটু আগে বলছিলি, সেটা পূরণ করতে হলে তোকে তো একটু সাহসী হতে হবে। "

           "কী রকম? "

          "বাবাকে বলতে হবে তো! "

          "কী বলব, চব্বিশ ঘন্টা আপনার মেয়ের ঠোঁটে ঠোঁট চুবিয়ে রাখব?"

          "ধ্যাৎ, খালি ইয়ার্কি! বিয়ের কথাটা এবার বাবাকে বল।বাবা তো অস্থির হয়ে উঠেছে,বিয়ে দেওয়ার জন্য।ডাক্তার ছেলে অলরেডি ফিটিং করে রেখেছে।"

          "ভালতো করে ফেল, ডাক্তার বলে কথা! "

          " ডাক্তার-ফাক্তার আমার চাইনা। আমার তোকে চাই। " তারপর নির্দেশ দেওয়ার ভঙ্গিতে জুড়ে দেয়, " শোন, তুই আজই আসবি আমাদের বাড়িতে। আমাদের বিয়ের কথাটা বাবাকে বলবি। "

          " ক্ষেপেছিস? স্যরকে আমি বলব! ‘’

          “ না বললে, ইচ্ছেটা পূরণ করবি কী করে, ছাগল? "

          " কেন , কালীঘাটে বিয়ে করে নেব। "

         " তুই কি চোর, পালিয়ে বিয়ে করবি? "

         " নয়তো কী, তোর মনটা যখন চুরি করেছিলাম, তখন কি স্যরের  পারমিশন নিয়েছিলাম? "

          "তোর সঙ্গে কথায় আমি পারব না। আমি অতশত জানি না, তুই আজই আসবি। বাবাকে আগে তুই কথাটা বলবি। তার পর যা বলার আমি বলব। " বাজারের পথে নিমাইকান্তির সঙ্গে যে ইতিমধ্যেই তার দেখা হয়েছে, সে কথাটা বেমালুম চেপে যায় অনিকেত। হাসতে হাসতে বলে,"যে আজ্ঞে  ম্যাডাম, " একটু থেমে ফের রহস্য জড়ানো গলায় ডাকল , " তুমি ---- "

          " কী রে, হঠাৎ ' তুমি ' বলে থামলি কেন, বল ----"

          " বলব? "

          " বলতেই তো বলছি। "

          "তুমি তা জানো না কিছু, না জানিলে,-- / আমার সকল গান তবুও তোমারে লক্ষ্য করে!"

“ বিয়ের কথাটা বলতে ভয়ে মরছিস ,আবার জীবনানন্দ ঝাড়ছিস!’’ হাসতে হাসতে ফোনটা রেখে দেয় রিমঝিম ।



                                         তিন


একটু আগে বাজার থেকে ফিরেছেন নিমাইকান্তি । সঙ্গে সঙ্গে হাজির রূপকথা, '' বাবা, এটা খেয়ে নিন, ''  আপেল, মোসাম্বি, কলা বাটি ভর্তি ফল আগেই কেটে রেখেছিল, এগিয়ে দেয় নিমাইকান্তির দিকে । 

           ''খাচ্ছি। বৌমা ---- ''

          ''না বাবা,এখন টিভি চালানো হবে না। আগে খেয়ে নিন, ব্রেকফাস্টের পর, আর একটা ওষুধ আছে, ওটা খেয়ে তারপর …।’'

         বৌমাটা হয়েছে আশালতার চেয়েও এক ডিগ্রি ওপরে। আগে থেকেই কী করে যেন মনের কথাটা বুঝে যায়। নিজে না চালিয়ে, বৌমার ঘাড়েই বন্দুক রেখে টিভিটা চালিয়ে নেবেন,ভেবেছিলেন। তা হল না দেখে, বিরসবদনে ফলের বাটিটা টেনে নিলেন। ভাঙলেন, কিন্ত মচকালেন না। প্ল্যান আঁটতে  লাগলেন।

          ''বৌমা, একটু শোনো! ''

          ''আসছি বাবা, উনোনে মাছ বসানো , '’  কিচেন থেকে সাড়া দেয় রূপকথা।

         ''বেশ, কাজ সেরে একবার টিভিটা চালিয়ে দেখো তো, কেবল লাইন আছে কিনা। কে যেন বলছিল সকাল থেকে লাইন নেই। লরির ধাক্কায় তার ছিড়ে গেছে। ''

         এইবার কাজ হল। গ্যাস নিভিয়ে হন্তদন্ত হয়ে দৌড়ে এল রূপকথা। কাজবাজ সেরে দুপুরে দুটো সিরিয়াল ওর দেখা চাই-ই  । লাইন না থাকলে, এক্ষুনি কেবল-এর  ছেলেটাকে ফোন করে ডাকবে।

         টিভির সুইচ অন করতেই মালবিকার রুদ্ধশ্বাস কণ্ঠস্বর ---"এই মুহুর্তের সবচেয়ে বড় খবর, দিনের শুরুতেই আতঙ্ক ছড়িয়েছে, রুশ সেনারা ইউক্রেনের জাপোরিজিয়া পরমাণু বিদ্যুৎকেন্দ্রে হামলা চালিয়েছে।"

           " লাইন নেই! কই,দিব্যি তো টিভি চলছে বাবা, কে যে আপনাকে ভুলভাল খবর দেয়! " বলতে বলতে টিভির সুইচ অফ করতে উদ্যত হয় রূপকথা।

            "থাক বৌমা, বন্ধ কোরো না,তুমি মাছ রান্নাটা শেষ করো গিয়ে।" অনিচ্ছা সত্ত্বেও শ্বশুরমশাইয়ের হাতে রিমোট দিয়ে, কিচেনে দৌড়য় রূপকথা। খবরে মন দেন নিমাইকান্তি-- " এই হামলার ফলে চেরনোবিলের থেকে দশগুণ ভয়ানক পরমাণু বিপর্যয় ঘটতে পারে । নিশ্চিহ্ন হয়ে যেতে পারে গোটা ইউরোপ। “

            '' কী সাংঘাতিক! চেরনোবিলের থেকেও দশগুণ ভয়ানক! ফের হিরোশিমা-নাগাসাকির ভ্রূকুটি !'' আঁতকে ওঠেন নিমাইকান্তি ।

             ''বাবা, ওষুধটা খাওয়া হয়েছে?'' খুন্তি নাড়তে নাড়তে জিজ্ঞেস করে রূপকথা।

            ''খাচ্ছি বৌমা।'' কোনওরকমে কথাটা বলে ফের চিন্তার সমুদ্রে ডুব… 'চেরনোবিল! ' স্মৃতির পটে আবছা ভেসে ওঠে সেই মর্মান্তিক দুর্ঘটনার কথা । যতদূর মনে পড়ে, সে দিনটা ছিল ১৯৮৬ সালের ২৬ এপ্রিল। নিমাইকান্তি তখন সাতাশ- আঠাশ বছরের তরতাজা যুবক। সদ্য পিএইচডি কমপ্লিট করেছেন। প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই পেয়ে গেছেন অধ্যাপনার চাকরি । অনেক সাঁতরে পাণিগ্রহণ করেছেন আশালতার। চুটিয়ে সংসার করছেন। সেদিন কী একটা সেমিনারে যোগ দিতে বারাসাত যেতে হয়েছিল। তখন আজকের মত মিডিয়ার রমরমা ছিল না। ফোনও তত স্মার্ট হয়নি। দেশ-বিদেশের খবর জানার উপায় ছিল ডেলি পেপার। আর পাড়ার মোড়ে মোড়ে এসটিডি বুথ ছিল খবর আদান প্রদানের প্রধান মাধ্যম। সেরকমই একটা বুথ থেকে আশালতাকে ফোন করে অনেক প্রেমালাপের মধ্যেও চেরনোবিল দুর্ঘটনার কথাটাও জানতে পেরেছিলেন তিনি। বারাসাত থেকে ফেরার পথে তড়িঘড়ি দু'দুটো কাগজ কিনলেন। ট্রেনে বসে দুটো কাগজই প্রায় পড়া হয়ে গিয়েছিল। দুর্ঘটনার কারণও পুঙ্খানুপুঙ্খ জেনে নিয়েছিলেন। হরিনাথ দে'র চেয়ে নিজের স্মৃতিশক্তি খুব একটা কম নয় বলে চিরকালই  মনে মনে গর্ব অনুভব করে এসেছেন নিমাইকান্তি । ইদানীং সেই বিশ্বাসে একটু ফাটল ধরলেও, সেদিনের খবরের কাগজে পড়া দুর্ঘটনার কথাগুলো এখনও যেন জ্বলজ্বল করে চোখের সামনে !


           '' মা, একটু শোনো, ''  অনলাইন ক্লাস করতে করতে চ্যাঁচায় অরিন। দৌড়ে আসে রূপকথা।

           ''আন্টি তোমাকে কী বলবে বলছে।'' ফোনটা এগিয়ে দেয় অরিন।

           ''হ্যাঁ,শ্রুতি বলো। '' 

         '' কথাদি, বলছি আজ অরিকে একটু তাড়াতাড়ি ছেড়ে দিচ্ছি, আমার একটু জরুরি কাজ আছে, পরের দিন মেকআপ করে দেব। ’'

         '' ঠিক আছে, '' সংক্ষিপ্ত জবাব রূপকথার। একটু যেন অসন্তুষ্ট। ফোনটা কেটে দিয়ে আপন মনে বিড়বিড় করতে থাকে , কলেজ- ইউনিভার্সিটির মেয়েদের দিয়ে পড়ানোর এই এক হ্যাঁপা। মাঝে মাঝেই ওদের 'জরুরি কাজ' থাকে। 'জরুরি  কাজটা' যে বয় ফ্রেন্ড- এর সঙ্গে ভিক্টোরিয়া কিংবা জাদুঘর চষে ফেলা , অনুমান করে গজগজ করতে থাকে রূপকথা। আরে বাবা, জরুরি কাজ আছে আজ মাইনেটা দিতে পারব না, আমি তো কখনও বলি না এ কথা , ঠিক সময়েই টাকাটা অ্যাকাউন্টে ফেলে দিই। করোনার কারণে দেড়-দু'বছর এমনিতেই স্কুল-কলেজ বন্ধ, ছেলে-মেয়েদের পড়াশুনো লাটে ওঠার জোগাড় , নামমাত্র যাও-বা একটু আধটু অনলাইন ক্লাস হচ্ছে , তার মধ্যে আবার তোমাদের এত জরুরি কাজ! 


          ' ছু - ট্টি ' ততক্ষণে অরিন দু'হাত তুলে নাচতে নাচতে দাদুর কোলে, "এবার গল্প বলো। " দাদু তখন গল্প বলার মতো অবস্থায় নেই। তিনি তখনও ইউক্রেনে। রাশিয়ার ছোঁড়া গুলি-গোলা মুহুর্মুহু এসে বিঁধছে পাঁজরে-ফুসফুসে। ফলের বাটির পাশেই পড়ে আছে ওষুধ,  জলের গ্লাস।

            "গল্প বলবে না তো! " রিমোটটা হাতে নিয়ে ব্ল্যাকমেল করতে শুরু করে অরিন, "তাহলে এই টিভি বন্ধ করে ---"

            "দাদাভাই দাদাভাই, এক সেকেন্ড এক সেকেন্ড। "

           "না বাবা,আর এক সেকেন্ডও নয়, " দু'জনের মাঝখানে এসে দাঁড়ায় রূপকথা, "ওষুধটা খেয়ে বিচ্ছুটাকে একটু অঙ্ক করান , সব তো ভুলে বসে আছে, " বলতে বলতে টিভির সুইচটা অফ করে দেয়।

          "কবে যে শেষ হবে এই মারণযজ্ঞ!" দীর্ঘশ্বাস ফেলেন নিমাইকান্তি।



           " তা হলে দাদাভাই যাও, বইখাতা নিয়ে এসো, এবার আমরা একটু পড়াশোনা করি।"

         "না, এখন আমি আর পড়াশোনা করতে পারব না," হাত-পা ছুড়ে চটজলদি জবাব অরিনের।

         "কেন,পারবি না কেন,আন্টি তো জরুরি কাজ আছে বলে তাড়াতাড়ি ছেড়ে দিল। বাকিটা দাদুর কাছে কর।"

          "এখন না, রাতে  বাবার কাছে করব ,এখন আমি গল্প শুনব। "

          "শোনাচ্ছি গল্প, " লাঠি হাতে তেড়ে যায় রূপকথা," এক্ষুনি বসবি।"

         দাদুর দু'বাহুর নিরাপদ আশ্রয়ে গুটিসুটি মেরে পড়ে থাকে অরিন। নিমাইকান্তি নাতির পক্ষ নিয়ে বলেন, " থাক বৌমা, রাতে খোকার কাছেই করবে। সব সময় কি পড়াশোনার মুড থাকে!" চুপ করে যায় রূপকথা। 

         "এবার বলো। "

          "না বাবা, হবে না , অরি একা শুনবে কেন? আমিও শুনব, "  বইপত্র গোছাতে গোছাতে গলা উচিয়ে বলে রিমঝিম।

         " কে বারণ করেছে, শুনবি যদি তাড়াতাড়ি আয় । " দৌড়ে এসে বাবার পাশে বসে রিমঝিম।  

         " ইতিহাসের গল্প শুনতে চাইছ, আচ্ছা দাদাভাই, বলোতো ইতিহাস মানে কী? "

          " তুমিই বলো না! " রিমঝিমও গলা মেলায়, '' হাঁ বাবা ,তুমিই বল।“

         " বেশ বলছি , কিন্তু মনে রেখো,  ইতিহাস মানে শুধু সাল-তারিখ,রাজা-মহারাজাদের খুনোখুনিই নয়, ইতিহাস মানে এক অনাবিল আনন্দ,অতীতকে জানার, ছুঁয়ে দেখার। ইতিহাসকে যাঁরা শুধুই অতীতের হাড়গোড় ভাবে, তাঁদের আমি করুণা করি। ইতিহাস এক চিরপ্রবাহী নদীর ফল্গুধারা। যে নদীর ঢেউ আছড়ে পড়ছে বর্তমানের কূলে কূলে। সেই ঢেউয়ের গর্জন যিনি শুনতে পান, তিনিই  বড় ঐতিহাসিক। কালের কষ্টিপাথরে যাচাই করে বর্তমানের কলুষ-কালিমা, লোভ-রিরংসা ছেঁকে নিতে পারেন। "

           ইতিমধ্যে রান্না-বান্না শেষ করে গল্পের  আসরে এসে দাঁড়িয়েছে রূপকথা, " আমিও শুনব। " 

           হাততালি দিয়ে ওঠে অরিন, " মা বসো। " খুশি হন নিমাইকান্তিও, "বোসো, বৌমা।"

           " দাদাভাই, মহাপ্রভুর জীবনের কোন ঘটনাটা আজ বলব, বলেছিলাম ?"

              প্রায় সঙ্গে সঙ্গে চেঁচিয়ে ওঠে অরিন , "  চাঁদ কাজির গল্প । "

            " গুড। শোনো মন দিয়ে, " শুরু করেন নিমাইকান্তি, " চৈতন্য মহাপ্রভুর জীবন ভারত ইতিহাসের এক অনাবিল আনন্দ, ক্ষতের উপশম। শ্রীচৈতন্য সন্ন্যাস  নিয়েছিলেন চব্বিশ বছর বয়সে। চাঁদ কাজির সঙ্গে তাঁর সংঘর্ষের ঘটনাটি ঘটেছিল তার আগে। "

          " সংঘর্ষ? মানে ফাইট, ধুমধাড়াক্কা? "  উত্তেজিত অরিন।

          " কথার মাঝখানে কথা বোলো না দাদাভাই, তাহলে কিন্তু---"

          " আচ্ছা ঠিক আছে। " শুরু করেন নিমাইকান্তি ---

            তখন সুলতানি যুগ। বাংলার মসনদে রয়েছেন হোসেন শাহ। আর নবদ্বীপের স্থানীয় প্রশাসক চাঁদ কাজি। হোসেন শাহ'র দৌহিত্র। চাঁদ কাজি  একবার খোল কর্তাল নিয়ে নামসঙ্কীর্তন করার উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করলেন। তাঁর এই কাজের যে প্রতিরোধ হতে পারে,তা তিনি স্বপ্নেও ভাবেন নি। অবশ্য তাঁর একার কেন, সুলতানি শাসকমাত্রই ধারণা ছিল নবদ্বীপের হিন্দুরা মেরুদণ্ডহীন। জাত-পাত ছোঁয়াছুঁয়ির কাজিয়াতেই মত্ত। তা না হলে একসময় মাত্র আঠারো জন ঘোড়সওয়ার সৈন্য নিয়ে বক্তিয়ার খলজি গৌড় দখল করে নিতে পারে! আর তাঁর তাড়া খেয়ে  রাজ্যপাঠ ছেড়ে পালান লক্ষণ সেন! তাছাড়া, তখন শয়ে-শয়ে হাজারে-হাজারে ব্রাহ্মণ, জমিদার থেকে শূদ্র প্রজা মুসলিম ধর্মে ধর্মান্তরিত হচ্ছিল। নবদ্বীপের পাশে পীরল্যা গ্রামে সাতান্ন  ঘর বর্ধিষ্ণু ব্রাহ্মণ রাতারাতি ধর্ম পাল্টে ফেলতে বাধ্য হয়েছিল। অতএব চাপাও নিষেধাজ্ঞা কীর্তনীয়াদের ওপর। অবশ্য চাঁদ কাজি স্বত:প্রণোদিত হয়ে এ কাজ করেছিলেন, এমনটা বলা যায় না। তাঁর কান ভারী করেছিল তৎকালীন পাষণ্ডীরা ।"

          " পাষণ্ডী কারা, বাবা? " কৌতূহল রিমঝিমের।

          " কথার মাঝখানে কথা বলবি না পিসি, দাদুভাই বারণ করল না? "

          "যেটা বুঝবে না, সেটা তো জিজ্ঞেস করতেই পারে, " অরিনকে নিরস্ত করেন নিমাইকান্তি।

          " তৎকালীন স্মার্ত, নৈয়ায়িক ব্রাহ্মণ, যাঁরা নামসঙ্কীর্তনের বিরোধী, তাঁদেরকেই বৈষ্ণব ধর্মগ্রন্থগুলিতে পাষণ্ডী  বলা হয়েছে। বৈষ্ণব সম্প্রদায়ের উপর পাষণ্ডীদের ছিল জাত ক্রোধ। বৈষ্ণবদের সঙ্কীর্তন নিয়ে নানা নোংরা কথা তাঁরা বলে বেড়াত। শ্রীবাস,শ্রীচৈতন্যের অন্যতম পার্ষদ,তাঁর বাড়িতে নাকি সঙ্কীর্তনের নামে সারারাত মদ,মেয়েছেলে নিয়ে ফুর্তি চলে, এমন অপবাদও তাঁরা রটিয়েছিল। আর তাঁদের কূটকচালিতে ইন্ধন জুগিয়েছিলেন চাঁদ কাজি। যাই হোক, চৈতন্য অনুগামীরা কিন্তু চাঁদ কাজির নিষেধাজ্ঞা মানলেন না। তাঁরা  যেমন উচ্চস্বরে নাম সঙ্কীর্তন  করছিলেন, তেমনই করে যেতে লাগলেন। বিশেষ করে শ্রীবাস পন্ডিতের ঘরে অদ্বৈত আচার্য,গদাধর, মুরারি প্রমুখ একত্রিত হয়ে সারারাত ধরে নাম সঙ্কীর্তনে মাতোয়ারা হয়ে রইলেন।

            খবর গেল চাঁদ কাজির কাছে। চাঁদ কাজি একদিন দলবল নিয়ে এসে শ্রীবাসাদির খোল,কর্তাল ,ঘরবাড়ি ভেঙেচুরে তছনছ করে চলে গেল। নামসঙ্কীর্তনের উপর হামলা! অন্তরাত্মা কেঁদে উঠল শ্রীচৈতন্যের। তখনও অবশ্য তিনি শ্রীচৈতন্য হননি। তখন তিনি নিমাই বা গোরা। যাইহোক এই ঘটনায়, প্রতিজ্ঞায় কঠোর হল নিমাইয়ের চোয়াল । মাথা নোয়ানো নয়। এই অন্যায়ের একটা বিহিত চাই।

           জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে আপামর নবদ্বীপবাসীকে সংগঠিত করলেন তিনি। মহামিছিল করে যাবেন চাঁদ কাজির বাড়ির উদ্দেশে। জগাই মাধাই থেকে শুরু করে হরিদাস ঠাকুর, নিতাই, খোলা বেচা শ্রীধর, শ্রীবাস সকলে শামিল হলেন। শূদ্র, ম্লেচ্ছ বাদ রইল না কেউই। মিছিলে পা মেলাল হাজার হাজার সাধারণ নবদ্বীপবাসী। শুরু হলো মশাল মিছিল। লক্ষ্য শিমুলিয়া। চাঁদ কাজির বাসস্থান। খোল কর্তাল মন্দিরা পাখোয়াজ মাদলের বোল আর ঝঙ্কারে মুখরিত হল নবদ্বীপের আকাশ বাতাস। " শারঙ্গধর তুয়া চরণে মন লাগহুঁ রে " গাইতে গাইতে মিছিলের মধ্যভাগে তন্ময় হয়ে রইলেন শ্রীচৈতন্য। অবশেষে মিছিল পৌঁছল লক্ষ্যস্থলে। বিপুল জনসমাগম দেখে চাঁদ কাজি ভয়ে কুঁকড়ে রইলেন। হার মানলেন সংগঠিত গণশক্তির কাছে। বলা যায়, শ্রীচৈতন্যের নেতৃত্বে এটাই ছিল ভারতের প্রথম আইন অমান্য আন্দোলন। 



                                           চার


       " বৌমা, খোকা ফিরেছে? "

       " না বাবা, কেন কিছু বলবেন? "

       " খোকা এলে বোলোতো একটা ভাল সাইকায়াট্রিস্টের খোঁজ নিতে। "

       " কেন বাবা, আপনার তো শুগার প্রেশার ছাড়া আর কোনও  সমস্যা নেই। খামোখা সাইকায়াট্রিস্ট কেন? "

       " না বৌমা, কী হচ্ছে শরীরে, ঠিক বুঝতে পারছি না। ইদানীং চোখটা একটু বুজলেই, ঘুমে কি জাগরণে, চোখের সামনে শুধু একটাই ছবি যেন মিছিল করে চলে যেতে দেখছি। "

       " কী ছবি? "

       " দেখছি যেন কিভ,খারকিভ, মারিয়ুপোল, চেরনোবিল জুড়ে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের ভয়ঙ্কর গুলিগোলা চলছে। আর তার মধ্যে খোল কর্তাল মৃদঙ্গ নিয়ে সপার্ষদ শ্রীচৈতন্য দু'হাত তুলে বাহ্যজ্ঞানশূন্য হয়ে নেচে চলেছেন। আর কী আশ্চর্য ট্যাঙ্ক, কামান,বিমান থেকে নিক্ষিপ্ত গুলিগোলা ফুল হয়ে হরিরলুটের মতো ঝরে পড়ছে আর তার ছোঁয়ায় প্রাণ ফিরে পাচ্ছে হাজার হাজার নিহত শিশু-যুবা-বৃদ্ধ-বৃদ্ধা। আর ---"  একটু থামলেন নিমাই কান্তি।

"আর কী বাবা?"

 " চাঁদ কাজির মুখটা কখনও হয়ে উঠছে হিটলারের,কখনও মুসোলিনির, কখনো-বা ভ্লাদিমির পুতিনের...."


**************************************************************************************************************

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন