মায়াগাছ
শতদল মিত্র
বর্ধিত কলকাতার সবুজহীন সরু গলির একানি ফ্ল্যাটবাড়ির তিনতলা, অর্থাৎ সেকেন্ড ফ্লোরের এ চৌখুপি থেকে জানা যায় নি বাইরে কোথাও কোনো বৃক্ষ থেকে শুকনো পাতা ঝরে পড়েছিল কিনা হাওয়ায় ঝড়ের আভাসে! কিন্তু একাকী, নিঃসঙ্গ মৈত্রেয় দত্তের বুক জুড়ে ঝড় ছিল। আকুল, উথালপাথাল। আজ কদিন ধরেই। আর এ ঝড় ক্রমশ তার গতির গড়নে মৈত্রেয়কে আরও কোণঠাসা, আরও বিপন্ন করে তুলছিল। ফলত এ পরিস্থিতি ব্যাখ্যা দাবী করে। ব্যাখ্যাটা আপাত সরল। মৈত্রেয় লেখক। এবং বাজারি নয়। কিন্তু শখেরও নয়। আর এখানেই ওর বিপন্নতা। ও মনে করে ওর কিছু বলার আছে। সমাজ, রাজনীতি কোনো কালেই কখনো স্বয়ংসম্পূর্ণ নয়, তা সতত পরিবর্তনশীল। কখনো মানবের পক্ষে, কখনো মানুষের বিপক্ষে। যদিও কায়েমি স্বার্থ স্থিতাবস্থায় বিশ্বাসী। সুতরাং মানবিকতার পক্ষে সমাজকে চালনা করার দায় থেকেই যায় প্রতিটি মানুষের, বিশেষত যে হোমোসেপিয়ান্সদের মগজে ধূসর পদার্থ অটুট। সেই হেতু বলা, বলার চেষ্টাটুকু অন্তত জারি থাকা জরুরি বলেই মনে করে মৈত্রেয়।
না, কচিকালের মতো সে আর বিশ্বাস করে না যে বলে বা লিখে সমাজ পাল্টানো যায়। তবুও সমাজের নষ্টামিটাকে দাগিয়ে দিতে গেলেও বলা তার লিখিতরূপে জরুরিই। তাই সে লেখে। আজও। শুরু কবিতা দিয়ে। কিন্তু অভিজ্ঞতার সঙ্গে বলার পরিধি বেড়ে গেলে কবিতার ইশারা ছেড়ে তাকে গদ্যে আসতেই হল। যেহেতু গদ্য অনেক সরাসরি, প্রবল। আবার লেখা তো শুধু লেখা নয়! সেখানে কী, কেন, কীভাবে-- এ প্রশ্নও থাকে। অন্তত এ প্রশ্ন মৈত্রেয়র ক্ষেত্রে থাকেই। না, সে জানে লেখাও মূলত জনমনোরঞ্জক। কিন্তু আবারও প্রশ্ন-- কোন জন? আর এখানেই লেখক মৈত্রেয়র বিপন্নতা। যে বিপন্নতায় সে বহুপ্রসবিনী হতে পারে না। তার সৃষ্টিকে অনেকদিন ধরে লালন করতে হয় মনের জঠরে। তখনই সে অস্থির হয়। ঝড় বয় মনে। যতক্ষণ না তার মনে অক্ষর পূর্ণ ব্রহ্মরূপ পায়। এ সময়ে তার মন মায়ার একটা অবলম্বন চায়। তার যন্ত্রণার ওপর কেউ নরম হাত রেখে বলবে--আমি আছি!
এ মায়া কি অলীক! ভাবে মৈত্রেয়। আজ। ভেবেছিল সেদিনও। যেহেতু এ মায়া আজও অধরা তার কাছে। না, মা-স্ত্রী-মেয়ে-- কেউ তাকে সে মায়া দেয় নি। তারা যে তাকে ভালোবাসেনি তেমনও নয়। তবে কি মৈত্রেয় একটু বেশিই চেয়েছিল! জানে না সে। শুধু জানে তারা তার লেখালেখিকে তেমন পছন্দ করেনি। মনোভাব যেন এ সব অসংসারী কাজে মন না দিলে সে বোধহয় আর একটু বেশি অর্থ আয় করত। সংসারটা সচ্ছল হতো আর একটু। কে না জানে চিরকালের সেই পরম প্রবাদ-- জীবন সুখের হয় অর্থের গুণে! মা-বউ তো বটেই, এমনকি মেয়েও কোনোদিন খোঁজ নেয় নি-- লিখছ তো! না, মেয়ে কোনোদিন তার লেখা পড়েছে বলে সে জানে না। এ ক্ষেত্রে মেয়ে মাতৃপন্থী। অথচ সে, মৈত্রেয় চেয়েছিল মেয়ে অন্তত...। দীর্ঘশ্বাস করুণ হাসি আঁকে তার মুখে-- ফ্রয়েডসাহেব বাংলাদেশে ডাহা ফেল! এখানে মেয়েরা মায়ের সখী। অবশ্য এটাও ঠিক মৈত্রেয়র সংসারে সচ্ছলতা কমই। প্রাইভেট কোম্পানিতে কাজ করে, মেয়েকে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়িয়ে হাতে যেটুকু টাকা তার সুদে এ আগুন বাজারে বাঁচা কঠিনই। অনেক কিছু সুখকে ক্রমশ বলি দিতে হচ্ছে। এমন কি ডাক্তার-ওষুধেও! কিন্তু মেয়ে-জামাই দুজনই তো আই.টি.। ব্যাঙ্গালুরুতে। প্রচুর আয়। কই বাবাকে না হোক মা-কে সাহায্য...! বছরে একবার এসে দামী হোটেলে খাওয়ানো! মৈত্রেয় যেতে চায় না। সহ্যও হয় না।
সেদিন এমনই নিশুত ঝড়ের রাতে অস্থির ছিল মৈত্রেয়। ঘুমের ওষুধও ঘুম নামাতে পারেনি চোখে। হালকা গান চালিয়ে শুনছিল, কিংবা শুনছিলও না। শুধু সুরের ঘোরে ভাসছিল। হাতের মোবাইলে আঙুল ঘুরে বেড়াচ্ছিল আনমনে। ফলে মোবাইল বিভিন্ন মাত্রায় আলো উগরে দেওয়ায় ঘরময় আলো নাচছিল যেন। ওইটুকুই যা প্রাণ। বাকি সারা চরাচর নিথর। পাশের বেডরুমে ঘরের মানুষটিও ফেসবুক করতে করতে ঘুমিয়ে পড়েছে কখন। হঠাৎই টুং শব্দে একটা ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট আসে। হয়তো অনেকক্ষণ আগের পাঠানো, এখন জানান দিল তা। প্রিয়াঙ্কা বিশ্বাস। এ নাম মৈত্রেয়র মুখে চিলতে হাসি ঝোলায়। নিশ্চয়ই রাজীব গান্ধী মারা যাবার পর এর জন্ম। প্রাক্তন সে প্রধানমন্ত্রীর সৎকারে সাদা পোশাকের পিতৃহারা রাহুল-প্রিয়াঙ্কা অনেকের মনেই দাগ কেটেছিল। হবু বাবা-মায়েদেরও। মৈত্রেয় প্রোফাইলে যায়। প্রথম কবিতাটাই চোখ টানে। মনও। বেশ মায়া পায় লেখাটায়। জীবনের টান। এ টানে প্রোফাইলের অন্দরে যায় সে। লেখাগুলোয় বড় মায়া বিছানো, যা স্পর্শ করে তাকে। শুশ্রূষা পায় যেন সে। চোখ বন্ধ করে সে মায়ায় আভাং ডুব দিতে সাধ হয় তার।
স্বাভাবিক ভাবেই মৈত্রেয় তার ভালোলাগা জানিয়েছিল তার নতুন বন্ধুকে, বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী যে। প্রিয়াঙ্কার নতুন লেখা পেলে সে আগ্রহের সঙ্গে পড়ে। একবার এক কবিতায় প্রিয়াঙ্কা মৃত্যুর গান আঁকে। ভালো কবিতাই। তবুও মৈত্রেয়র মনে বেসুর তোলে তা। নতুন জীবন মৃত্যুর কথা লিখবে কেন! বিশেষ করে যার যাপনে জীবনের এত মায়া-আলো, যে আলো অন্যকে উজল করে! মৃত্যুর গান গাইবে তো তার মতো বৃদ্ধরা। এ কথা জানায়ও সে তাকে। এর মাস খানেক পরেই হয়তো, মৈত্রেয়কে ট্যাগ করে একটা লেখা পোস্ট করে প্রিয়াঙ্কা-- 'প্রিয় লেখক-কবি মৈত্রেয় দত্তকে, যিনি আমাকে আলোর কবিতা লিখতে বলেছিলেন।' সত্যিই আলোকিত লেখা তা। ফলে মায়াটান গভীর হয় আরও। আবার এ মায়ায় মাটিও থাকে, কেননা তারা দুজনেই একই জেলার। মৈত্রেয়কে গ্রামের বাড়ি যেতে গেলে প্রিয়াঙ্কার স্টেশনের ওপর দিয়েই যেতে হয়।
আর এ মাটি-মায়া বৃষ্টি হয়ে ঝরে, ঝরতেই থাকে মৈত্রেয়র রুখু বুকে। পতিত জমি বতর হয়। জীবন জাগে। যে আবেগ মৈত্রেয়কে দিয়ে বলিয়ে নেয়-- তুমি তো আমার মেয়ের মতো। আমি কি তোমাকে মেয়ে বলে ডাকতে পারি!
দোয়েল শিস দিয়ে ওঠে-- অবশ্যই। আমি তো আপনার মেয়েই।
তারপর সময় গড়ায়। আর মায়া ক্রমশ জড়ায় দুজনকেই। দুজন অসমবয়সী, বন্ধুর মতো দুজনকে লেখা পাঠায়। মতামত বিনিময় করে। সে বিনিময়ে কাটাছেঁড়াও থাকে, দুজনে দুজনের ভালো চেয়ে, ভালোবেসে। প্রিয়াঙ্কা তার পড়া, চাকরির পরীক্ষা, নেট-টেট নিয়ে ব্যস্ত থাকে। এ ঘাসবঙ্গে আগাছা প্রচুর, কিন্তু চাকরি নেই। থাকলেও তাকে কিনতে হয়। ফলত অবসাদ তারও। তবুও শত ব্যস্ততা, অবসাদের মধ্যেও প্রিয়াঙ্কা মৈত্রেয়র খোঁজ নেয়। ছায়া এমনই বিছায়,
--অত রাত জাগেন কেন? শরীর খারাপ করবে তো!
--সময়ে খাবেন। মনখারাপ করবেন না।
মৈত্রেয়র ভালো লাগে। মেয়েটার মধ্যে অদ্ভুত মায়া আছে, ভাবে সে। সেও সে মেয়ের হতাশায় মায়ার হাত রাখে।
--এই তো সবে জীবন শুরু। দেখবে সব ঠিক হয়ে যাবে সময়ে। জয়ী হবে তুমি একদিন নিশ্চয়।
না, ওদের দেখা হয় না। মৈত্রেয় প্রিয়াঙ্কার বাড়ির ওপর দিয়ে নিজের গ্রামে গেছে, কিন্তু ওর বাড়ি যাওয়া হয়ে ওঠেনি, ব্যস্ততায়। তখনও তো সে জীবিকায় যুক্ত। সে মেয়ে অভিমান করেছে, তবুও। আসলে মৈত্রেয় তার গণ্ডি মানে, স্বভাবগুণে।
আর তারপর তো করোনাকাল। সবাই দু-গজি গণ্ডিতে আবদ্ধ। সকল দুঃসময়ের মতো একদিন সে সংকটে পরিত্রাণ মেলে মানুষের। জীবন স্বাভাবিক ছন্দে ফিরতে শুরু করে। সে ছন্দে বইমেলা আসে। মৈত্রেয়ও মেলায় যায়। যতই বর্তমানে তা কর্পোরেট কাঠিন্যের ঘেরাটোপে, তবুও তা আজও যেন কবি-সাহিত্যিকদের মিলনমেলাই। কত দূর প্রান্তের বন্ধুদের সঙ্গে দেখা হয়। বছরে তো ওই একবারই। তাই মৈত্রেয় অন্তত একদিন হলেও যায়। সে মেলাতেই লিটিল ম্যাগাজিন চত্বরে ঘুরতে ঘুরতে দূরের এক স্টলে নজর গেলে এক চেনামুখ ভাসে তার। প্রিয়াঙ্কা না! ততটা নিশ্চয়তা না থাকায় কাছে গিয়ে আলতো শব্দ ভাসায়-- আপনি প্রিয়াঙ্কা তো!
ঘাড় ঘোরায় সে মেয়ে। হাসি ডানা মেলে-- মৈত্রেয়দা!
ওরা তিনবন্ধু ছিল। সবাই লেখার সঙ্গে যুক্ত। ফলে মৈত্রেয়র নাম জানে। মৈত্রেয়ও ওদের লেখার সঙ্গে পরিচিত। সকলেই হৈ হৈ করে ওঠে। ছবি ওঠে। নতুন বই গন্ধ ছড়ায়। গল্প জমে চায়ের আড্ডায়। ওরা দূর মফস্বলের, ফলে ওদের যাওয়ার সময় আসে। প্রিয়াঙ্কা প্রণাম করলে মৈত্রেয় ওর মাথায় হাত রাখে। চলে যায় ওরা বিদায় জানিয়ে। চলে যায় মৈত্রেয়র প্রিয়। আর তখনই মেঘ ছায় মৈত্রেয়র দুচোখে। বৃষ্টি নামে। সে সজলে বিরানভূমি জুড়ে যে মায়াগাছ, তা হাওয়ায় তিরতির কাঁপে।
আবার সজলতার ধর্মেই সে মায়াগাছ ক্রমে শাখা ছড়ায়, ফুলবতী হয়। ফুলের সুবাস ডানা মেলে-- আপনি এত ভালো লেখেন। কিন্তু বড় কম লেখেন। আর একটু বেশি লেখা উচিত আপনার।
মৈত্রেয় কী বলে! শুধু এক প্রশান্ত ভালোলাগায় ভেসে যায়। এই প্রথম কেউ তার লেখায় আদর দেয়! কবিতা জন্ম নেয় সে পুরুষে।
রাতের অন্ধকারে নক্ষত্র এক উড়ে গেলে আপন খেয়ালে
যে নগ্নছায়া মাটিতে নামে
তার মায়ায় শীতলজল স্রোতবতী হয় আসমানে
আঁধার সে জলে
পাঁজরে চকিত ঢেউ ভেঙে মগ্ন শোক
আনমনে লবণ ভাসায় যদি
কৃষ্ণগহ্বর থেকে উজান টেনে নক্ষত্রের দীপ্ত শীত
রাত্রিটি রাঙালো!
আহা বিস্ময়! পুষে রাখি আদরে আজও নিহিত ক্ষতে
শীতার্ত জন্ম, তবু রক্তে আঁকি নোনাঢেউ-- অলোক!
আজ রাতেও এ নিশুত একাকী ঝড় মৈত্রেয়কে একাকী, নিঃসঙ্গ করে। তছনছ হয় যেন সে অন্ধকারে। গতকালও, পরশুও... এক প্রগাঢ অন্ধকার তলিয়ে নিচ্ছে তাকে। আসলে কদিন ধরেই একটা গল্পের আভাস ভেসে উঠে বার বার ডুবে যাচ্ছে। পূর্ণ আদলে ধরা দিচ্ছে না সে মৈত্রেয়কে। অস্থির সে জানলায় দাঁড়িয়ে সিগারেট ধরায়। জল খায়। গানের সুরে নিজেকে ডুবিয়ে রাখার চেষ্টা করে। যদি ঘুম নামে। নিটোল ঘুমের শেষে নতুন জেগে ওঠায় যদি অক্ষর ব্রহ্মরূপ পায়! নাঃ, ঘুমের ওষুধ আজও ঘুম আনে না!
আর তখনই ফোন টুং শব্দে জেগে ওঠে। প্রিয়াঙ্কার মেসেজ-- এখনও জেগে? কী করছেন?
কে যেন মৈত্রেয়কে দিয়ে বলিয়ে নেয়-- মৃত্যুর সঙ্গে দাবা খেলছি।
ফলে ফোন জেগেই থাকে। দূরবাণী ফুটে ওঠে-- কি যা তা... আপনি আমার সঙ্গেই আছেন। আর সারা জীবন সঙ্গেই থাকবেন।
এ অক্ষর যেন বা মেঘমগ্ন। ফলত বৃষ্টি নামে মৈত্রেয়র চোখে। আর সে মুহূর্তে ঝড় নামে বাইরেও বৃষ্টিকে সঙ্গে নিয়ে। প্রথম কালবৈশাখীর ঝড়। সে ঝড়ে ভিজতে বড় সাধ হয় মৈত্রেয়র। ছোট অ্যাপার্টমেন্ট। সবার কাছেই নিচের মেন গেটের আর ছাদের দরজার চাবি আছে। চাবি নিয়ে ফ্ল্যাটের দরজা খোলে মৈত্রেয়।পাশের শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত বদ্ধঘরে ঘুমন্ত মানুষটির কাছে ঝড় আভাসহীনই থেকে যায়। সিঁড়ি ভেঙে ছাদে ওঠে সে। বৃষ্টির অঝর ধারায় চরাচর কেমন যেন মায়ালু। আভাং ভেজে সে বৃষ্টিতে। ঝড় ডাক দেয় তাকে-- আয়! আর সে ক্ষণে আঁধার চিরে বিদ্যুৎ ঝলসালে এক নগ্ন নির্জন হাত জীবন আনন্দে চকিতে সজলতার পরশ আঁকে তার চেতনায়, যে সজলতা পুরাণধ্যানের।
সিঁড়ি বেয়ে ঢেউয়ের বেগেই নামে যেন মৈত্রেয়। ঘরে ঢুকে আকুল ভিজতে ভিজতে নরম হাতে ফোন তুলে নেয় সে।
--তোমার সঙ্গেই আমি আছি প্রিয়ান। সারা জীবন তোমার সঙ্গেই থাকব আমি!
***********************************************************************************************



কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন