মঙ্গলবার, ৩ অক্টোবর, ২০২৩

গল্প * পরাগ জ্যোতি


 



নির্বাক

পরাগ জ্যোতি


আমার শহর কলকাতা অজস্র আবেগের সওদাগর। কলকাতার প্রতিটি গলির ভাঁজে ভাঁজে লুকিয়ে আছে অনেক আবেগ। সেই আবেগ কখনও সুখের, কখনও দুঃখের, কখনও আনন্দের, কখনও বা গ্লানির আবার কখনও ভালবাসার। মানুষের মিছিলে জনৈক্য আমি-রও এরকম অজস্র আবেগ। এই যেমন এখন যে আবেগটা বদহজমের কারণ হয়ে উঠেছে সেটা হল ৬ এম.এল. উপলব্ধি, ১০ এম.এল. চাওয়া-পাওয়া আর বাকিটা লেমন জুসের মতো অনুভূতি দিয়ে বানানো জোরাল আবেগের ককটেল।

পটভূমি

উত্তর কলকাতায় আমাদের এক চিলতে ফ্ল্যাটবাড়ি। আমি-বাবা-মা। নিউক্লিয়ার ফ্যামিলি। একটি ছিমছাম মধ্যবিত্ত পাড়া। আমাদের উপরের তলায় একজন মাঝবয়সি ভদ্রলোক তার পরিবারের সাথে থাকেন। পরিবার বলতে স্বামী-স্ত্রী ও সন্তান। আমাদের মধ্যে সখ্যতা আছে। তবে তা কতটা জল মেশানো বলা মুশকিল। যাই হোক, আমাদের মধ্যে একটি স্পষ্ট বিভাজন আছে। তা মূলত অর্থগত। দুটি পরিবারই মধ্যবিত্তের কোটায় পড়ে। তবে ওনার পরিবার সেই কোটার একদম উপরের দিকে থাকলে আমরা মাঝের থেকে একটু নীচে অবস্থান করছি। এই যা পার্থক্য। প্রসঙ্গটি অর্বাচিন নয় কারণ এই ককটেলে ১০ এম.এল. চাওয়া-পাওয়া আছে। এবার কে চাওয়ার কোটায় থাকবে আর কে পাওয়ার সেটার বিচারক পাঠক।

সকাল

কাহিনীর সূত্রপাত কোন একদিন সকালে। সেদিন ওই ভদ্রলোকের মায়ের পঁচিশতম মৃত্যুবার্ষিকী। সেই উপলক্ষে কলকাতার উপকন্ঠে একটি অনাথ ও প্রতিবন্ধী আশ্রমের শিশুদের খাওয়ানোর ব্যবস্থা করেছিলেন উনি। পাশাপাশি তাদের কিছু আর্থিক সাহায্যও করেছিলেন। একধরনের সমাজসেবা আর কি। উনি অবশ্য এরকম সমাজ সেবা করেই থাকেন। গ্রামগঞ্জে ফ্রিতে খাবার রেশন দেওয়া, গরিব বাচ্চাদের জন্য পড়াশুনার সরঞ্জাম সরবরাহ করা। আরও নানাবিধ কর্মকাণ্ড। নিঃসন্দেহে প্রশংসনীয়। যাই হোক, উনি অনাথ শিশুদের খাওয়ানোর পাশাপাশি আমাদের আবাসনের কিছু প্রতিবেশী ও ওনার নিকটস্থ কিছু আত্মীয়-স্বজনকেও নিমন্ত্রণ করেছিলেন। এটি ঠিক সে অর্থে কোন সামাজিক অনুষ্ঠানের নিমন্ত্রণ নয়। বলা যেতে পারে ওনার উদ্যোগে হওয়া একটি সমাজকল্যাণমূলক কর্মসূচির অংশিদার হওয়ার আহ্বান। কেউ অবশ্য বলতেই পারে, সমাজকল্যাণ না ছাই। নিজে কত মহান তা ঢাকঢোল পিটিয়ে লোককে জানাচ্ছে। আমাদের মতো হিসাব করে চলতে হলে সমাজসেবা জানলা দিয়ে পালিয়ে যেত। আমারও যে কয়েকবার এমনটা মনে হয়েনি তা নয়। হয়তো আমি পক্ষপাতদুষ্ট। মধ্যবিত্ত একটু পক্ষপাতী হয় বৈকি।

আমাদের সেদিন অনাথ আশ্রমে পৌঁচ্ছাতে পৌঁচ্ছাতে বেশ বেলা হয়ে গেছিল। ওদের খাওয়া প্রায় শেষ যখন আমরা পৌঁচ্ছাই। ওরা সবাই কোনো না কোনোভাবে প্রতিবন্ধী তাই আমাদের পৌঁচ্ছানো অবধি ওদের বসিয়ে রাখা সম্ভব হয়নি। বাইরের খাবার ওদের নিষিদ্ধ। আশ্রমের হেঁসেলের কম তেল-ঝাল-মশলার রান্নাই ওরা খায়। একই রান্না আমাদের জন্যও করা হয়েছিল। শুধু মিষ্টিটা আমরা হাতে করে নিয়ে গেছিলাম। আমাদের হাতের মিষ্টির প্যাকেটগুলো দেখে ওদের চোখ চকচক করে উঠেছিল। অবশ্য এই মিষ্টিটা আমার একদম নাপসন্দ। কড়া মিষ্টি। গা গুলিয়ে ওঠে। ওরা যদিও হাপুসহুপুস করে খাচ্ছে। খাওয়া-দাওয়ার পর আমাদের আশ্রমের দোতলার একটি ঘরে নিয়ে যাওয়া হল। সেখানেই ছোট মতো করে ওনার মায়ের ছবিতে মালা পরিয়ে প্রণাম পর্ব সারা হল। এত লোক ওরা সচরাচর দেখতে পায় না। এত লোক দেখে ওরা মনে হয় ভাবছে মোচ্ছব লেগেছে।

একটা বছর বারোর রোগা চিমছাম ফর্সা ছেলের সাথে ভাব জমে উঠল। নাম হারাধন। অসংলগ্নভাবে কথা বলে। বুঝতে একটু বেগ পেতে হয়। তবে ছেলেটির হাতের কাজ অনবদ্য। পুঁথি দিয়ে অপূর্ব সব মেয়েদের হ্যান্ডব্যাগ, পার্স বানিয়েছে। সুতোয় বোনা বড় ব্যাগও ছিল। অনেকে কিনল। আমিও কিনলাম একটা মায়ের জন্য। দামটা বেশ চোখে লাগছে। তবুও হারাধনের হাসিটা আরও চওড়া করে তোলার জন্য এটুকু তো করাই যায়। আবার এটাও ভাবা যেতে পারে যে নিজের মহানত্ব প্রমাণ করার তাগিদে সামান্য অনুদান মাত্র।

আশ্রমের একজন দিদিমণি তখন ডিউটিতে ছিলেন। মাঝবয়স্কা। বেশ ধোপদুরস্থ। কিভাবে এই আশ্রম চলে, কোথা থেকে ফান্ডিং আসে, সরকার কি কি উদ্যোগ নিচ্ছে ওদের জন্য, ওদের জীবনযাত্রার মান কিভাবে বজায় রাখার চেষ্টা করা হয় এসব বলছিলেন আমাদের। আমি অন্যমনস্ক ছিলাম। কারণ হারাধন ওর ব্যাগ অতি উৎসাহের সঙ্গে দেখাছিল। হঠাৎ ব্যাগ দেখাতে দেখাতে ওর চোখ গেল আমরা গলায় ঝোলা হেডফোনে। ও অসংলগ্নভাবে জানতে চাইল, ওটা কি?

- এটা তো হেডফোন। গান শোনে।

- আমি শুনব?

- নিশ্চয়ই।

এই সামান্য আবদারটুকু মেটানোই যায়। আমি ওর কানে হেডফোনটা লাগিয়ে সবে গান চালাতে যাব হঠাৎ ওই দিদিমণি এসে বললেল, এসব ওদের দেবেন না প্লিজ। এখানে ওদের এরকম কোনকিছু দেওয়া অ্যালাও নেই।

নিয়মের সুতোয় আমরা সকলে বাঁধা। তবে হারাধনের মুখটা আরও ফ্যাকাসে হয়ে গেল।

এবার আহারপর্ব। আহার চব্যচোষ্য লেঝ্যপেয় একেবারেই নয়। কাঙ্খিতও নয়। আহারের পর পোষাক বিতরণ পালা। ছেঁড়া-ফাটা জামা-প্যান্ট পরে রঙিন পোষাকের হাতছানিতে উচ্ছ্বল ওদের চোখ। আমি নির্লিপ্তের মতো ভিড়ের মধ্যে দাঁড়িয়েছিলাম। কিছু বোধ হয় ভাবছিলাম। সম্বিত ফেরে দিদিমণির গলার শব্দে, তখন ওইভাবে বললাম বলে কিছু মনে করবেন না। আসলে আমাদের সব ম্যানেজ করতে হয় তো। ওদের কাছে ওইসব জিনিস সোনার-পাথর বাটি। দেখলেন না সামান্য মিষ্টি দেখে কেমন করছিল। আসলে ওরা সেরকম কিছুই তো পায় না। তাই বাইরের এত প্রাচুর্য ওদের কাছে না পৌঁচ্ছানোই শ্রেয়।… আপনি জানেন, আমি ঘড়ি পড়ে আসতে পারি না। আগে পড়তাম। ওরা সেই ঘড়ি নিয়ে হাতে পড়ে দেখতো। আমিও বাঁধা দেইনি প্রথম প্রথম। কিছুদিন পর ফলটা পেলাম। বাচ্চাদের সে কি বায়না নতুন ঘড়ির জন্য! কি কান্না-কাটি! তারপর ঘড়ি পড়াই ছেড়ে দিলাম। ঠিক হল আশ্রমের কোনো স্টাফই খুব কস্টলি বা আই-ক্যাচিং জিনিস আনবে না। অনলি বেসিক নিডস্‌। আপনাদের তো সেটা বলতে পারি না।… আজ যদি আপনার হেডফোন দেখে কাল হেডফোনের বায়না করে কোথা থেকে দেব বলুন?

- বুঝলাম।

তখন প্রায় চারটে বাজে। আমাদের যাওয়ার পালা। তার আগে ওদের একজোট করে লজেন্স দেওয়া হল। সবাই দু’টো করে। লাইনে সারিবদ্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে। আমি দাঁড়িয়ে একটু তদারকি করছি। সামান্য চকলেটের জন্যও হৈ হট্টগোল। কে বেশি পেল। কে ভালটা নিয়ে নিল। সবার চাহিদা মিটিয়ে বিতরণ পর্ব শেষ হল। কোথা থেকে হঠাৎ একটা বছর পাঁচেকের বাচ্চা এসে আমায় বলল, তোমার লজেন্স কই?

- ওটা তো শুধু তোমাদের জন্য।

বাচ্চাটা হাতের ছোট্ট মুঠোয় ধরা দুটো লজেন্সের থেকে একটা আমার দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বলল, একটা তুমি খাও। একটা আমি খাব।

আমি নিঃস্ব। কথা হারিয়ে গেছে। গলার কাছে কি কিছু জমাট বেঁধেছে? অনেক কষ্টে বললাম, এ দুটো তোমার। আমারটা আমি খেয়ে ফেলেছি।

বিকাল

তখন সাড়ে পাঁচটা বাজে। আমরা ওনার গাড়িতে করে ফিরছি। পথে যেতে যেতে অনেক গল্পগাছা হচ্ছিল।আমি জিজ্ঞাসা করলাম, প্রোগামটা করতে কিরকম খরচ পরল? 

- বিশ হাজার মতো। তবে কি বল তো ওদের জন্য এটুকু করতে পেরে আমি খুব স্যাটিস্ফায়েড । এর চেয়ে বেশি তো আর করতে পারব না। সামান্য যা করা যায়…

কথায় কথায় ওনার নতুন ফ্ল্যাটের কথা উঠল। আগেই শুনেছিলাম উনি নাকি এই অঞ্চলে একটা বিলাসবহুল ফ্ল্যাট কিনেছেন। আমরা সেই পথ দিয়েই ফিরছি বলে ওনার নতুন ফ্ল্যাট দেখাতে নিয়ে গেলেন। 

ওনার স্ত্রী মানে আন্টি আর আমার মা পিছনের সিটে বসে গল্প করছে। আন্টি মাকে বিলাসবহুল ফ্ল্যাটের ফিচারস পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে বলছে। কেমন ধূসর দুর্মূল্য পাথরে মোড়া মেঝে, ম্যাট ফিনিশিং চোখ ধাঁধানো। কেমন অত্যাধুনিক প্রযুক্তিতে বানানো মডিউলার কিচেন। বাথরুমে এলাহী আয়োজন। কীভাবে ইতালিয়ান ঝাপসা কাচের দরজা ঠেলে ঢুকে মার্বেলে মোড়া বাথটবে বসতে হবে। কীভাবে আধুনিক সেন্সর লাগানো সাওয়ারের সামনে দাঁড়ালেই অঝোরে বারিধারা বইবে। কীভাবে বেসিনের সামনে হাত পাতলেই জল পড়বে; আবার হাত সরালেই বন্ধ। এমনকি বিখ্যাত ইন্টেরিয়র ডেকরেটার্সের নকশায় বানানো কমোডের কথাও এড়িয়ে গেলেন না। সেখানেও আধুনিকতার ছোঁয়া। ফ্ল্যাশ করার দরকার নেই; কম্ম সারলেই আপসে ফ্ল্যাশের ধারা বইবে। তারপর হোম থিয়েটার, ডলবি সাউন্ড এফেক্ট। সেখানে নাকি রিমোর্ট নিষ্প্রয়োজন। মুখে বললেই চ্যানেল চেঞ্জ হবে, সাউন্ড বাড়া কমা হবে হাতের ইশারায়। ডাইনিং টেবিলে উপর ফরাসি আদলের ঝাড়লন্ঠন। টেবিলে দুটি স্তর। এক স্তরে খাবার থাকবে। অন্যস্তরে খাওয়া-দাওয়া হবে। সুইচ টিপলে নীচের খাবার রাখার স্তরটি উপরে উঠে আসবে, সেখান থেকে খাবার নিয়ে আবার সুইচ টিপলে ওটি নীচে চলে যাবে। সোফাও না কি এল-সেপড আধুনিক স্টাইলে করা। আন্টি বলে চলেছেন। আমরা তাজ্জব হয়ে শুনছি। আমি প্রশ্ন করলাম, কত পড়ল?

- এক কোটি।

আমি এখানেও নিঃস্ব। যাইহোক, ফ্ল্যাটে পৌঁচ্ছে গেলাম পনেরো মিনিটের মধ্যে। গগনচুম্বী বহুতল। নীচ থেকে উপরের প্রতিটি তল যেন পায়রার খোপের মতো। নীচ থেকে কয়েকবার কত তলা গোনার চেষ্টা করলাম কিন্তু গুলিয়ে গেল। অঙ্কতে এখনও বেশ কাঁচা। ওনার ফ্ল্যাট নয় তলায়। নিয়ে গেলেন। প্রবেশদ্বারে সেট দুর্মূল্য পাথরে মোড়া মেঝেতে পা রেখে আমার পা দু’খানিও ধন্য হল। চোখ ধাঁধানো আলোয় আমি ভ্যাবলার মতো চেয়ে রইলাম। অমূল্য আসবাব আর দুর্লভ সো-পিসে আভিজাত্যের ছোঁয়া। বিলাসিতা যে এত মনমুগ্ধকর হতে পারে অভিজ্ঞতা ছিল না। ডাইনিং হলের বাঁপাশে সেই শ্বেত পাথরের রাজকীয় ডাইনিং টেবিল। বসার ঘর পেরিয়ে বেডরুম। রুমে মাঝখানে প্রায় মেঝের সাথে লাগানো খাট। তবে খাট কথাটা বেশ মধ্যবিত্ত। এই এস্থেটিক ভি-সেপড বিছানার সাথে ওই নামটি সামঞ্জস্যহীন। সেখানেও আধুনিক রিমোর্ট কন্ট্রোলের ব্যবস্থা। বেডরুমেও একটা টিভি। খাটে বসে কথায় ইশারায় টিভি চলবে, আলো জ্বলবে। লাগোয়া বারান্দা। সেখান থেকেই সামনের সবুজে মোড়া লন দেখা যায়। বাথরুম দেখলাম। অত্যাধুনিক সরঞ্জামে সজ্জিত হালকা ক্রিম রঙা ঘরটা দেখে প্রথমে বুঝিনি এটা বাথরুম। আন্টি অবশ্য কাচ সরিয়ে বিখ্যাত ইন্টেরিয়র ডেকরেটারের নকশায় বানানো কমোড দেখিয়ে ভুল ভাঙিয়ে দিলেন। ততক্ষণে আভিজাত্যের জৌলুস আমায় বিবশ করে দিয়েছে। কখন যে ঘণ্টাখানেক আগের হারাধনদের মুখগুলো মলিন হয়ে গেছে বুঝিনি।

উপসংহার

এই আমার ১০ এম.এল. চাওয়া-পাওয়ার আবেগের ককটেল। কিন্তু ওই যে বলেছিলাম কে চাওয়ার কোটায় থাকবে আর কে পাওয়ার সেটা বিশ্লেষণ করবেন পাঠক। আপাতত আমি একটা পচা খালের পাশে দাঁড়িয়ে দুর্গন্ধ শুকছি। কারণ ভদ্রলোক সামনের দোকানে সিগারেট কিনতে গেছে। উনি এলেই আমরা বাড়ির পথে রওনা দেব। অজস্র এলোমেলো চিন্তা ভিড় করছে মাথায়। আমি নির্বাক।


*********************************************************************************************


পরাগ জ্যোতি

লেখক পরিচিতি: লেখক প্রাণিবিদ্যায় স্নাতক (কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়) ও স্নাতকোত্তর (পশ্চিমবঙ্গ রাষ্ট্রীয় বিশ্ববিদ্যালয়)। কবিতা ও গল্প চর্চা কিশোর বয়স থেকে। বহু লিটিল ম্যাগাজিনে কবিতা লিখেছেন। গল্প হাতে গোনা কিছু পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে। 


কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন