মঙ্গলবার, ৩ অক্টোবর, ২০২৩

গল্প * শহীদুল ইসলাম

 



সাঁকো

শহীদুল ইসলাম


 

আলাউদ্দিন সাহেব ধনাট্য ব্যক্তি।  শিক্ষিত সুধীজন,সজ্জন। এলাকায় বেশ নাম ডাক। ধান পাটের ব্যবসা করেন। হিন্দু মুসলমান সকলের  তিনি সম্মানীয়। ধার-কর্য দেবার ব্যাপারে উদার মানসিকতা সম্পন্ন।পাওনাদার হয়েও দেনাদার  কারো উপরে তিনি জুলুম করেন না। পারিবারিক ভাবে এটা উনাদের ঐতিহ্য। অসহায় বেদনার্ত মানুষের তিনি নিবেদিত প্রাণ। অগাধ সম্পত্তির মালিক তথায় চাকরির তাগিদ অনুভব করেননি।

দীর্ঘ যুগ এ গ্রামে ভিন্ন ভিন্ন ধর্মের মানুষের পারস্পরিক সহাবস্থান। একে অপরের প্রতি প্রগাঢ় শ্রদ্ধাবোধ বিদ্যমান। ইদানিং আনন্দ বেশ ঋণ-দেনায় জর্জরিত। লজ্জায় সে আলাউদ্দিন সাহেবের সামনে পর্যন্ত আসে না।

কাকতালীয় ভাবে একদা আকড়াখোলা বাজারে তুলসির ওষুধের দোকানে দেখা। দেনার কথা তিনি আনন্দকে বলেননি তবুও সে আপনা থেকেই বলল, রবিবারের দিন সকালে আমাদের বাড়িতে একটু আসবেন। আলাউদ্দিন সাহেব ভাবলেন, হয়তো আনন্দের হাতে নগদ টাকা এসেছে কিছুটা ঋণ পরিশোধ করতে পারে। কথা মতো সেদিন সকালে আনন্দের বাড়ি সাহেব হাজির। বসতে দিলেন বারান্দার তক্তপোশে।

~মাথা নিচু করে ঘাড় চুলকে, আমি আপনার টাকা এ মুহূর্তে দিতে পারবো না। বড্ড অসুবিধার মধ্যে আছি।

~ টাকাটা না হয় পরে দিও,অসুবিধা কী সেটা তো বলবে?

~সারাদিন বিষন্ন লাগে, শরীরে শক্তি পাই না। প্রচুর মাথা ব্যথা। অনেক ডাক্তার কবিরাজ করলাম। কোনো ফল হলো না।

~ সেজন্য ভাবছি একবার ঢাকায় যাবো।

~ হ্যাঁ ঢাকায় নিউরো-সায়েন্সে দেখাতে পারো। একটা পজিটিভ রেজাল্ট আসতে পারে। ঢাকায় উঠার মতো কোনো জায়গা আছে? তোমাকে সব ব্যাপারে সহযোগিতা করতে পারে এমন আত্মীয় বা কেউ?

~ না।

~ কবে যাচ্ছো?

~ এক সপ্তাহ পরে।

~ আচ্ছা ঠিক আছে, যাওয়ার আগে তুমি আমার কাছ থেকে ঠিকানা ও মোবাইল নম্বর নিয়ে যেও। আমি কল করে বিস্তারিত জানিয়ে রাখবো। তবে আজ উঠি।

এমন সময়ে আনন্দের মা সীতা দেবী- দুগ্গা দুগ্গা দুগ্গা কী সর্বনাশ! কী সর্বনাশ! গলা ছেড়ে বউমাকে

ডেকে বলল- আমার গঙ্গা জলের পাত্রটা নিয়ে এসো। শাশুড়ির বাজখাঁই গলা বউমার পরিচিত, কি বলতে কি বলবেন? তড়িঘড়ি করে গঙ্গা জলের পাত্রটা নিয়ে এলো। সীতা দেবী তক্তপোশসহ বারান্দাময় ভক্তি সহযোগে দ্রুত গঙ্গা জল ছিটিয়ে পবিত্র করলেন। হায় হায় রে! জম্মের মত আমার জাত গেল রে! আরে ও আনন্দ এটা তুই কী করলি? সাত সকালে তুই আমার ঘরে মুছলমান তুললি? তোর কী কোনো জ্ঞানকাণ্ডক আজো হলো না? আমি এখন কী করি বল তো? 

আনন্দ লজ্জায় ' থ' মেরে গেল। উঠোনে নেমে আলাউদ্দিন সাহেব আনন্দের মায়ের কান্ডকারখানা প্রত্যক্ষ করলেন। ভাবলেন এ জমানায় মানুষ এত রক্ষণশীল? এত ধর্মের ব্যবধান মানে,এত ঘৃনা করে মানুষ মানুষকে! তিনি কিছুটা অপমানবোধ করলেও বুঝলেন এটা উনার শিক্ষার অভাব। 

বাড়ি ফিরে আলাউদ্দিন সাহেব নিজের মায়ের মুখে শুনলেন, সীতা দেবী বরাবরই শতভাগ গোড়া ধর্মীয় সংষ্কার মানেন। ছুঁয়ে দেয়া তার কাছে দারুন স্পর্শকাতর বিষয়। পানির কলস মুসলমানে ছুঁয়ে দিলে আর তা ঘরে তুলতেন না,সেখানেই ভেঙে রেখে যেতেন। এমনকি তাদের পুকুর থেকে কোনো মুসলমানদের পানি নিতে বা গোসল করতে দিতেন না। হয়তো তাদের ধর্মীয় বিধি নিষেধ থাকতে পারে। ছেলেরও মুসলমানের বাড়ির পানি পর্যন্ত খাওয়া নিষেধ ছিল।

প্রায় মাস ছয়েক অতিক্রান্ত। আলাউদ্দিন সাহেব আনন্দের খোঁজ নিতে তার বাড়ি আর যাননি কারণটা নিশ্চয়ই সীতা দেবী। লোক মুখে শুনলেন তার অবস্থা অতীব শোচনীয়। জমি-জমা সব বন্ধক। চিকিৎসা খরচ চালানোর মতো টাকা নেই। জ্ঞাতি ভাই আত্মীয় স্বজন পর্যন্ত দয়া দাক্ষিণ্য করা ছেড়ে দিয়েছেন। তার মা ঠাকুর ঘরে রাধা-মাধব রাধা-মাধব বলে বুক চাপড়াচ্ছেন। এমতাবস্থায় আলাউদ্দিন সাহেব অপমানের বোঝা মাথায় নিয়ে আনন্দের বাড়ি গেলেন। 

তার বউয়ের কাছে সব শুনলেন। তার মা লজ্জায় কিংবা ঘৃনায় উনার সামনে আর আসলো না,তা বুঝা গেল না। আনন্দের বউ কিছু একটা উপায় করার অনুরোধ করল। সমস্বরে আনন্দ বলল কিছু একটা করতে,সুস্থ হলে পর জমি বিক্রি করে হলেও উনার টাকা শোধ করবে। ক্যান্সারের লক্ষ্মণ, বাংলাদেশী ডাক্তারের প্রতি তাদের আস্থা কম। তাই ইন্ডিয়া যেতে হবে। আলাউদ্দিন সাহেব সব ব্যবস্থা করলেন। পাসপোর্ট ভিসা করতে তিন মাস লেগে গেল। প্রথমে আনন্দকে উনি কলকাতায়, পরে ওখানের ডাক্তারের পরামর্শ মোতাবেক ভেলোরে নিয়ে গেলেন উন্নত চিকিৎসার জন্য। আলাউদ্দিন সাহেব আনন্দের সাথে এক মাস ভেলোরে থাকলেন। এদিকে নিজের ব্যবসার খানিকটা ক্ষতি হয়ে গেল। তবু উনার নিজের  সান্তনা এই,আনন্দকে নিয়ে মোটামুটি সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরলেন। ডাক্তার বলেছে টানা ছয় মাস ওষুধ খেলে পরবর্তীবার আসলে আনন্দ ভালো হয়ে যাবে। 

আড়াল থেকে সব শুনে সীতা দেবী আর থাকতে পারলেন না,শরমের বলাই ত্যাগ করে, আলাউদ্দিন সাহেবের হাত ধরে মিনতির সুরে বলেন --বাবা আমি এতকাল বুঝিনি ধর্মের ব্যবধান থাকে, কিন্তু মানুষ তো মানুষই হয়,পারলে তুমি আমায় ক্ষমা করো,ধর্মীয় গোঁড়ামি আমাকে অন্ধকারে রেখেছিল। 

আজ থেকে তুমি আমার আর এক ছেলে।



************************************************************************************************




শহীদুল ইসলাম

সাতক্ষীরা থেকে লিখছেন ।
পেশা শিক্ষকতা  প্রভাষক, বাংলা বিভাগ, ঝাউডাঙ্গা কলেজ সাতক্ষীরা সদর।



কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন